কাহিনীর বিরতি
সুমিত এই অনুভূতির সাথে পরিচিত। প্রায় এক যুগ আগে নীলার সাথে প্রথম যখন দেখা হয়েছিলো, ঠিক এই রকম অনুভূতি হয়েছিলো। কিছুক্ষণ স্থির, কিছুক্ষণ অস্থির। একটু পর পর আয়নাতে নিজের চেহারা দেখা। হঠাৎ করেই পোশাকের দিকে নজর দেওয়া! ঘন ঘন মোবাইল ফোনে একটি নির্দিষ্ট নম্বরের বাটন চাপা। প্রায় সারাক্ষণই নীলার সাথে কথা বলার আকুলতা! নীলাকে তো সুমিত ভালবেসেছিলো, কিন্তু শুচিস্মিতাকে? তাহলে কি সে এখন শুচিস্মিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে? তা কি করে হয়? নীলা যে এখন সুমিতের ঘরনী! সুমিত যে এখনো নীলাকে ভালোবাসে। তবে কেনো শুচিস্মিতাকে দেখলে সুমিতের হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়! কেনো বার বার ওর সাথে সময় কাটাতে, ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে! কেনই বা শুচিস্মিতার কথা ভাবতে সুমিতের এতো ভালো লাগে!
কাহিনীর শুরুঃ
নতুন চাকরীতে নতুন জায়গায় এসে শুচিস্মিতার সাথে সুমিতের পরিচয়। প্রথম দিনেই শুচিস্মিতার প্রাণবন্ত কথা আর অদম্য উচ্ছ্বলতায় সুমিত খুব মজাই পেয়েছিলো!
চাকরী হচ্ছে এখন সোনার হরিন! এই সোনার হরিণই যেনো খুব সহজে সব সময় সুমিতের হাতে ধরা দিয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে এই পর্যন্ত এক দিনও ওকে বেকার থাকতে হয় নি। একটার পর একটা চাকরী করেছে, ছেড়েছে, আবার নতুন একটা পেয়েছেও। এরই মধ্যে নীলাকে সাত পাঁকে বেঁধে ফেলেছে। ভালোবাসার বিয়ে। আজকালকার বাবা মায়েরা খুব আধুনিক। ছেলে মেয়েদের ভালোবাসার বিয়েতে কোনো অমত থাকেনা। কিন্তু সুমিতের গ্রামে বাস করা বাবা মা মন মানসিকতায় অনেকটাই সেকেলে। আধুনিক, উচ্চ শিক্ষিত, নম্র এবং সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তাই নীলার সুযোগ হয় নি ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পদধূলি মাথায় নেবার!
নীলার কথাঃ
সুমিতের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় এক যুগের। চঞ্চল, ছটফটে কিন্তু দুষ্টু যে ছেলেটাকে প্রথম দিন দেখেই আমি মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম, তাকে যে আমি আজীবনের জন্য পাবো সেটা চিন্তাই করিনি! তবু যেনো সব কীভাবে হয়ে গেলো! একটা ছোট্ট সংসার হলো আমাদের, টোনাটুনির সংসার। আমি আর সুমিত, সুমিত আর আমি।
স্বপ্নের মতো কেটে গেলো একটি বছর। সুমিতের অফিস থেকে বিকেলে আসার পরে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া- সবকিছুই দ্রুত চলে যেতে লাগলো। নতুন সংসারটিকে সাজিয়ে নিতে আমাদেরও যেনো কিছুটা সময় দিতে চাইলেন বিধাতা। এরই মাঝে একদিন আমাতে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলাম আমি। অদ্ভুত এক শিহরণে শিহরিত হলাম। প্রবল উচ্ছ্বাসে সুমিতকে খবরটা দিতে গিয়েই জানলাম সুমিতকে গ্রামে যেতে হবে ওর বাবার মুখাগ্নি করতে।
সুমিতকে আমি একা ছাড়তে চাইলাম না। সব কাজ শেষ করে যখন আমরা ফিরে এলাম, আমাতে আর প্রাণের অস্তিত্ব পেলাম না! সুমিত কি খুব কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন? জানি না! শুধু এটুকু জানি, আমি খুব কেঁদেছিলাম, অঝোর ধারায়।
পার্শ্ব কাহিনীঃ
এর কিছুদিন পরেই আমেরিকার খুব বড় একটি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সুযোগ পেলো নীলা। সুমিত রইলো দেশে, একাকী। সময় কেটে গেলো দ্রুত। দুই বছর পর বিমান বন্দরে যখন নীলাকে সুমিত দেখতে পেলো, সুমিতের মনে হলো অসম্ভব রকমের বেশি ভালোবাসে সে এই মেয়েটিকে। খুব অবাক হলো, দুইটি বছর নীলাকে ছাড়া সে কীভাবে কাটিয়েছে!
এবার মনে হয় সময় হলো টোনাটুনির সংসারে এক নতুন অতিথি আসার। কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় এবারো মুখ তুলে চাইলেন না! রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝে থেকে সুমিত যখন নীলাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো, সুমিতের কাছে তখন যেনো সমস্ত পৃথিবীটাই দুলে উঠছিলো।
সুমিত নীলাকে ঠিকই যমরাজের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলো, এরপর এভাবেই বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেলো। টোনাটুনির সংসারে নতুন কেউ না এলেও, ভালোবাসার যেনো কমতি নেই!
রোচিষ্ণুর কথাঃ
আমি রোচিষ্ণু। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন এই লোকটা আবার কোত্থেকে উদয় হলো! তাই প্রথমেই আপনাদের সমস্ত কৌতুহল মিটাচ্ছি। আর কিছুদিনের মধ্যেই শুচিস্মিতার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। শুচিস্মিতাকে এখনো ভুলে যাননি তো আপনারা? হ্যা, শুচিস্মিতা হচ্ছে সুমিতের কলিগ। শুচিস্মিতার কাছেই আমি সুমিতের অনেক গল্প শুনেছি। অল্প ক’দিনের ভিতরেই সুমিত শুচিস্মিতার খুব কাছে চলে এসেছে। আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী এই ব্যাপারটিতে আমার চেয়েও বেশি চিন্তিত হয়ে পরেছে! আমি কিন্তু কখনই চিন্তিত হই নি। কারণ, সেই ছোটবেলা থেকেই আমি শুচিস্মিতাকে চিনি। ও আমাকে বলেছে, সে সুমিতকে খুব ভালো একজন বন্ধুর মতোই দেখে। এখনো সুমিতকে আমার কথা বলে নি, কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই আমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়ে সুমিতকে চমকে দিবে!
আমি শুচিস্মিতাকে অনেক, অ-নে-ক ভালোবাসি, ঠিক তেমনি অনেক, অ-নে-ক বিশ্বাসও করি।
বিরতির পরঃ
“সুমিত, আগামীকাল সন্ধ্যায় নান্দোসে আসতে পারবে? তোমাকে একটি কথা বলবো, ধরো তোমার জন্য এক সারপ্রাইজ!” সুমিত যেনো এই দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলো শুচিস্মিতাকে সে ‘না’ বলবে না!
ভালোবাসা ব্যাপারটাই এরকম। যারা বলে থাকে জীবনে একবারই মাত্র ভালোবাসা হয়, সুমিত সেই দলের নয়। যে কারণে গুইনেভারা রাজা আর্থারকে ভালোবাসলেও, ল্যান্সেলটের প্রেমে পড়তে কোনো সমস্যাই হয় না। আবার বিয়ে করলেও যে অন্যের সাথে ভালোবাসা আর হবে না, সুমিত সেটাও বিশ্বাস করে না। এমনকি এটাকে সে অনৈতিকও ভাবে না! কারণ, রাঁধা তাহলে বিবাহিতা হয়ে কীভাবে কৃষ্ণের সাথে প্রেম করে? লাইলী মজনু বা রোমিও জুলিয়েটের কাহিনী আর বর্তমান যুগে খাটে না। “ভালোবাসা এমন কোনো বিষয় নয়, শুধু একজনে সীমাবদ্ধ থাকবে,” নিজেকে বোঝালো সুমিত। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললো।
একটু কি খারাপ লাগলো সুমিতের? নীলার জন্য কেমন যেনো মনটা টন করে উঠলো না! “সেটা একসাথে অনেক দিন থাকার জন্য। নীলার প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছে না! কিন্তু সেটা শুধুই মায়া, ভালোবাসা নয়”, আবারো নিজেকে নিজেই উত্তর দিলো সুমিত।
সবচেয়ে মোক্ষম উত্তরটা একটু পরেই নিজেকে শোনালো সুমিত, “আমি বাবা হতে চাই”।
কাহিনীর শেষের আগেঃ
অফিসে আজ শুচিস্মিতা আসে নি, ছুটি নিয়েছে। সুমিত ওকে না দেখতে পেয়েই ফোন দিয়েছিলো। শুচিস্মিতা জানিয়েছে, এক বিশেষ কাজে ব্যস্ত। বিকেলে দেখা করার কথাও মনে করিয়ে দিলো। সুমিত স্মিত হেসে বললো, “মনে আছে!”
অফিস থেকেই সুমিত সোজা ধানমণ্ডির নান্দোসে গিয়ে শুচিস্মিতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার প্রহর যেনো দীর্ঘ! সহজে শেষ হতে চায় না! বার বার ঘড়ির দিকে আর প্রবেশ পথের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ করেই যখন শুচিস্মিতাকে দেখলো, কোথায় যেনো নীলার ছায়াটাও দেখতে পেলো সুমিত! শুচিস্মিতা একা আসেনি, সাথে একজন সুদর্শন যুবকও আছে!
“এই হচ্ছে রোচিষ্ণু, সামনের সপ্তাহেই আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে তোমার জন্য সারপ্রাইজ......” আরো কি কি যেনো বলছিলো শুচিস্মিতা, কিন্তু কোনো কথাই মনে হয় শুনতে পাচ্ছিলো না সুমিত!
নীলার শেষ কথাঃ
আজকে আমার খুব আনন্দের দিন! কয়েকদিন আগেই আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। আজ সকালে সুমিত অফিসে চলে গেলে আমি কনফার্ম হবার জন্য হাসপাতালে গেলাম। যা ভেবেছিলাম! আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে বলছে আমি ‘মা’ হতে যাচ্ছি! নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এতো বছর পর!
এতদিন নিশ্চিত না হয়ে সুমিতকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। ভাবলাম অফিস থেকে এলে চমকে দিবো ওকে। কিন্তু আজ এই আনন্দের দিনেই ও খুব দেরী করে বাসায় এলো। দরজা খুলে ওর দিকে তাকাতেই কেমন যেনো বিধ্বস্ত লাগলো ওকে। ওকে সুস্থির হবার সময় দিলাম।
“তোমার বাবুর নাম তুমি কি রাখবে?” রহস্য করে সুমিতকে বললাম। সুমিত মনে হয় আমার কথাটা বুঝতে পারলো না, ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি হাসিমুখে আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। পড়তে পড়তে দেখতে পেলাম, ও কাঁদছে। আনন্দের কান্না! হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “আমি তোমায় ভালোবাসি”।
আর যেনো কি বলতে লাগলো! ওহ হ্যা, মনে পড়েছে! আর বার বার বলতে লাগলো ‘আমায় ক্ষমা করো’।
সুমিত আসলেই খুব বোকা! কোন দিনে কি কথা বলতে হবে, এখনো শিখলো না! অফিসে কাজের চাপ এতো! যাহোক, কাঁদুক ও, কাঁদুক। বাবা হওয়ার সম্ভাবনায় কাঁদুক। ওর কান্না দেখতে আমার খুব ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে আমিও কাঁদি, মা হওয়ার সম্ভাবনায় কাঁদি আর বলি, “সুমিত, আমি তোমায় খুব ভালোবাসি”।