মহাত্মা লালন ফকিরের অনুসরণীয় লোকজ ফকিরী ধর্মের মূল বিষয় হচ্ছে তিনটি। সৃষ্টিকর্তা, প্রেরিত মহাপুরুষ ও গুরু। এই তিনকে এক ও অভেদ জেনে গুরুরুপে মান্য করাই হচ্ছে ফকিরী ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট। গুরু বন্দনায় শাস্ত্রীয়বানী হচ্ছে, “অখন্ড মুন্ডলা কারং ব্যপ্তং যেন চরাচরম। তৎপদং দশিতং যেন তন্মৈ শ্রীগুরুরে নমাঃ”।
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকায়া। চক্ষুষ উন্মিলিতং যেন তস্মে শ্রীগুরুবে নমঃ।
অর্থাৎ যিনি নিজ শিষ্যের জ্ঞানান্ধ নেত্রকে জ্ঞানরূপ অঞ্জন শলাকা দ্বারা উন্মেলিত করিয়ে, অখন্ডরূপী বিশ্বপরমপদকে দর্শন করান, তিনিই গুরু। মহাত্মা লালন ফকির বলছেন যে, গুরু তুমি পতিত-পাবন পরম ও ঈশ্বর। তাহলে সহজেই অনুমেয় যে, যুগে-যুগে লোক পরম্পরায় প্রচলিত ফকিরী লোকজ ধর্মে গুরুর স্থানটি শিষ্য হৃদয়ের সমস্তই আবৃত করে আছে, এবং গুরুরূপই তার ধ্যানজ্ঞান ও পরম আরাধ্য। সে চেতন-অচেতনে, ধ্যানে-জ্ঞানে, ইহলোক ও পরলোকে পরমশান্তি লাভের আশায় গুরূপদে আত্মস্থ হয়ে থাকে।
আবার শিষ্যের জন্যে গুরুর বিশেষ নির্দেশনা হচ্ছে :
গুরু সূত্র গুরু পুত্র, গুরু পরিবার,
এ তিন মানিয়া কর আচার বিচার।
অর্থাৎ গুরুর পূর্বপুরুষ হতে আরম্ভ করে গুরুকুলের সবাইকে মান্য করা শিষ্যের একান্ত কর্তব্য। শিষ্য বংশের কাহারো নিকটে গুরু-বংশের কেউ শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারবে না।
পরব্রহ্মেলীন ও মোহমুক্ত হতে হলে সম্যক-গুরুর সানিধ্য লাভ একান্তই আবশ্যক। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা চলে, মহাপুরুষগণ বহুপুর্বে দেহ ত্যাগ করে গেছেন। তাহলে বর্তমানে সাধারণ মানুষকে কোন্ ব্যক্তি শিক্ষা দিক্ষা দিবেন ? বিধায় এখন একমাত্র পরমপুরুষ সাদৃশ্য সম্যক- গুরুদেবই তার অনুরক্ত শিষ্যকে গোপনীয় শিক্ষা-দিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারেন। অন্যত্র বলা হচ্ছে যে, গুরুর মুখ ও ঈশ্বরের মুখ এক ও অভিন্ন। সেই জন্য গুরু ও ঈশ্বরের বাক্য পদ্ম ও অমৃত বাক্যসম। অমৃত বাক্য শ্রবণে মোক্ষলাভের পথ সুগম হয়। এক্ষেত্রে সম্যক গুরুর ত্রি রূপ প্রতিভাত হয়। (ক) শিক্ষা গুরু (খ) দীক্ষা গুরু ও (গ) পরম গুরু।
(ক) শিক্ষা গুরু : শিক্ষা গুরুই হচ্ছেন ফকির ঘরাণার অবতার স্বরূপ। তিনি অখন্ডরূপ ঈশ্বরের প্রতিভু ও বটে। তাকে পরিপূর্ণভাবে জানা ও মানার মধ্যে শিক্ষা-দিক্ষার সমস্ত অন্তর্ভাব নিহিত থাকে। তার কল্যাণ কামনা ও কৃপায়, সহজ ও জটিল সমস্ত কিছুই শিষ্যের নিকটে সহজ ও সম্ভব হতে পারে।
(খ) দীক্ষা গুরু : দীক্ষা গুরু হচ্ছেন জাগতিক সম্যক গুরু, তিনি অনুগ্রহপূর্বক “শিষ্য হৃদয়ে রূপস্থিতির সহায়ক স্থিতি” অংকিত করে দেন। তদপদ সেবাই শিষ্যের মোক্ষপ্রাপ্তির পথ সুগম হয় এবং তার কৃপা গুণে মোহমুক্তির পথনির্দেশনা প্রাপ্ত হতে পারে।
(গ) পরম গুরু : ইনি হচ্ছেন স্বয়ং পরম ঈশ্বরের প্রতিভু বা আলেক সাঁই। পরম গুরুর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শিক্ষা ও দীক্ষা গুরু মিশে থাকেন। তাকে মনুষ্যরূপে চিন্তা করলে শিষ্যের অধ:পথে পতন অর্ণিবার্য।
লালন বলছেন “গুরুকে মনুষ্যজ্ঞান যার,অধ:পথে গতি হয় তার।”
গুরু যিনি তিনি অখন্ডরুপি গোলকবিহারী, স্বয়ং ঈশ্বর। তদপদ বন্দনেই পরম মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। তিনিই একমাত্র পরম-পুরুষ এবং জগতে যা কিছু সবই প্রকৃতি। শিষ্য প্রকৃতি রুপে পরম পুরুষের ভজন- পূজন ও আরাধনা করলে মোক্ষলাভে পরিত্রাণ পাবার সম্ভবনা জাগ্রত হয়। এক্ষণে উপরোক্ত তিন ভাবের গুরুরূপকে “একভাবে নিজ গুরূরূপে” চিন্তাভাবনা ও ভজন- পূজন করা শিষ্যের একমাত্র অন্যতম কর্তব্য। লালন ফকিরের অসংখ্য পদাবলীতে গুরু-মহাত্ম বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও দোহাকোষ, চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী এবং ফকিরী ভাবগীতির পংতিতে পংতিতে সম্যক-গুরুই একমাত্র প্রেরণা দাতা। প্রতিটি ভক্তি ও তত্ত্ব গীতিতে গুরুই হচ্ছেন, প্রাত:স্মরণীয় ও একমাত্র অনুপ্রেরণা দানকারী ব্যক্তিত্ব। দৈন্যপদে গুরুর আর্শীবাণী ব্যতিরেকে কোন ভাব-ভক্তিগীতি স্বার্থকতা লাভ করতে পারেনা। সেই জন্য ভাবগীতির আভোগে পদকর্তার নামোল্লেখের পূর্বে গুরুর নাম উল্লেখ করে দীনতা প্রকাশ করতে হয়। অর্থাৎ গুরুদেবই হচ্ছেন শিষ্য জীবনের পরমপূজ্য ঈশ্বরের স্বরূপসম সম্যক চালিকা শক্তি। কথিত আছে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ মৃত্তিকা পাত্রের পূন:পূন ঘর্ষণে কঠিন পাথর যেমন ক্ষয় হয়ে গর্তের সৃষ্টি হতে পারে, তেমনিই সম্যক সদগুরুর শিক্ষা-দীক্ষার গুণে নিরেট বুদ্ধিহীন শিষ্যেরও বোধোদয়ের উন্মেষ ঘটে। শিষ্য যদি নিষ্ঠা মনে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে গুরুর দিব্য প্রভাবের ফলে শিষ্যের কল্যাণ সাধন হবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে ?
পরিশেষে বলা চলে যে, সম্যক গুরূরূপ ও তদপদে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলীন করলে আত্মরূপের উন্মেষ ঘটে। আত্মরূপ দর্শন হলে গুরুরূপের রূপাশ্রয়ে অটল রূপের দর্শন মেলে। এক্ষণে নিজরুপ, গুরূরূপ ও অটল রুপের মাখামাখির ফলে সমস্ত রূপ একীভূত হয়ে একটি নতুন রুপের সৃষ্টি হয় । যার নাম “স্বরূপ”। সেই জন্য মহাত্মা লালন ফকির গেয়েছেন
“স্বরূপে রূপ আছে গিলটি করা”। এ বড় অমূল্য তত্ত্বকথা বা গুরুবাদী ধর্মের মূল কথা। স্বরূপে রূপ প্রতিভাত হলে অন্তদৃষ্টি খুলে যায় এবং মোক্ষপ্রাপ্তির পথ সুগম হয়।
(নিয়ামত মাষ্টারের লালন ফকির বিষয়ক শতাধিক প্রবন্ধ থেকে উৎকলিত)