লাদাখ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত উত্তরে কুনলুন পর্বতশ্রেণী এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত একটি অঞ্চল। এই এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত। ঐতিহাসিককাল ধরে বালটিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, জাংস্কার, লাহুল ও স্পিটি, রুদোক এবং গুজ সহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা লাদাখের অংশ ছিল। বর্তমানে লাদাখ শুধুমাত্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লেহ জেলা এবং কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত।
সেং-গে-র্নাম-র্গ্যাল লাদাখের নামগ্যাল রাজবংশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা ছিলেন। লাদাখে তিনি সিংহ রাজা নামেও সমাদৃত।
১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে সেং-গে-র্নাম-র্গ্যালের পিতা 'জাম-দ্ব্যাংস-র্নাম-র্গ্যালের শাসনকালে তিনি বাসগো বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। সেই বৌদ্ধবিহারে তিনি একটি ২৪ ফুট উচ্চ মৈত্রেয় মূর্তি ও লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি ৩২ ফুট উচ্চ বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ করেন।১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে সেং-গে-র্নাম-র্গ্যাল লাদাখের সিংহাসনে বসে পশ্চিম তিব্বতের মালভূমির বেশ কিছু অংশ দখলে আনেন। লাদাখের সঙ্গে পূর্বে তিব্বত এবং পশ্চিমে কাশ্মীরের ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
সেং-গে-র্নাম-র্গ্যাল মুসলমানদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার এবং কারুকীর্তিগুলির পুনর্নির্মাণ করে লাদাখের পুরাতন গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তিনি লেহ প্রাসাদ নির্মাণ করে রাজধানী শে থেকে লেহতে সরিয়ে আনেন। ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হেমিস বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। তিব্বতী বৌদ্ধভিক্ষু স্তাগ-ত্শাং-রাস-পা-ঙ্গাগ-দ্বাং-র্গ্যা-ম্ত্শোর সহায়তায় হানলে বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন ও তার প্রভাবে দ্রুগপা গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত হলে সেং-গের আমল থেকেই লাদাখের নামগ্যাল রাজবংশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় লাদাখে হলুদ টুপি গেলুগ বৌদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়ে। তাছাড়াও সেংগে স্পিটির টাবো বৌদ্ধবিহারের স্বর্ণ মন্দিরের সংস্কার করেন।
লাদাখের বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত খোদিত প্রস্তরখন্ড থেকে জানা যায় যে নব্য প্রস্তর যুগেও এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল।এই অঞ্চলের প্রথমদিককার অধিবাসীদের মধ্যে মিশ্র ইন্দো-আর্য মোন ও দর্দ জাতির মানুষ ছিলেন। হিরোডোটাস গান্দারিওই এবং জারেক্সেসের গ্রীস আক্রমণের উল্লেখ করার সময় দাদিকাই নামে এক জাতির উল্লেখ করেন। মেগাস্থিনিস ও নিয়ার্কোস এবং প্রথম শতাব্দীতে প্লিনি স্বর্ণ প্রস্তুতকারক দর্দ জাতির উল্লেখ করেছেন। টলেমি সিন্ধু নদ উপত্যকার উপরের অংশে দারাদাই নামক জাতির উল্লেখ করেন। কা-লা-র্ৎসে বা খালাতসের নিকটে প্রাপ্ত উভিমা কভথিসার খরোষ্ঠী লিপি থেকে জানা যায়, প্রথম শতাব্দীতে লাদাখ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাং চুলুডুয়ো বা কুলু থেকে লুয়োহুলুয়ো বা লাহুল পর্যন্ত এক যাত্রার উল্লেখ করে বলেন যে চুলুডুয়ো থেকে এক হাজার আটশো বা নয়শো লি উত্তরে পর্বত এবং উপত্যকার কঠিন পথ ধরে গেলে লুয়োহুলুয়ো দেশে পৌছানো যায়। সেখান থেকে আরো দুই হাজার লি উত্তরে কঠিন বাঁধার মধ্যে দিয়ে শীতল ঝড় ও তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে গেলে মার-সা দেশে যাওয়া যায় এই মার-সা বা মো-লো-সো লাদাখের অপর নাম মার্যুলের সঙ্গে সমার্থক। এই ভ্রমণ রচনা থেকে জানা যায় যে এই মো-লো-সো সুবর্ণগোত্র রাজ্যের পার্শ্ববর্তী রাজ্য। গ্যুসেপ তুচ্চির মতে সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয়দের কাছে ঝাংঝুং বা তার দক্ষিণ অংশ সুবর্ণগোত্র বা সুবর্ণভূমি বা স্ত্রীরাজ্য নামে পরিচিত ছিল।অষ্টম শতাব্দীতে লাদাখে পশ্চিম দিক থেকে তিব্বতের ও মধ্য এশিয়া থেকে চীনের আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়। ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত ব্রু-জা বা গিলগিট আক্রমণ করলে সেখানকার রাজা চীনের সহায়তা প্রার্থনা করেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিব্বতকে কর প্রদানে বাধ্য হন। কোরীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হায়েচো ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার পথে চীন যাওয়ার পথে কাশ্মীরের উত্তর পূর্বে অবস্থিত তিনটি রাজ্য সম্বন্ধে তাঁর ভ্রমণ কাহিনী ওয়াং ওচেওনচুকগুক জেওন গ্রন্থে বলেন যে এই রাজ্যগুলি তিব্বতের শাসনাধীনে থাকলেও বৌদ্ধমঠ ও বুদ্ধের শিক্ষার কোন অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। রিজভির মতে এই উক্তি প্রমাণ করে যে অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে লাদাখ তিব্বতের অধীনে থাকলেও সেখানকার মানুষ তিব্বতী ছিলেন না।৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে চীনের সেনাপতি গাও জিয়ানঝি মধ্য এশিয়া ও কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা খোলার চেষ্টা করলে লাদাখ অঞ্চলে তিব্বতের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তালাস নদীর তীরে আরবদের বিরুদ্ধে গাও পরাজিত হলে তিব্বতের প্রভাব ফিরে আসে।
তুষার চিতা লাদাখের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাণী
লাদাখের প্রাণীজগৎ
লাদাখের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেন অস্ট্রীয়-চেক জীবাশ্মবিজ্ঞানী ফার্ডিনান্ড স্টোলিস্কা। ১৮৭০ সালের দিকে তিনি এ অঞ্চলে এক বিশাল অভিযান পরিচালনা করেন। লাদাখের সাথে মধ্য এশিয়ার বন্যপ্রাণীদের মধ্যে অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তিব্বতী মালভূমিতে যে সমস্ত বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়, তাদের অধিকাংশই লাদাখের উপত্যকাগুলোতে দেখা যায়। তবে কয়েক প্রজাতির পাখি এখানে দেখা যায় যেগুলো আবার তিব্বতী মালভূমি বা মধ্য এশিয়ার কোনখানেই দেখা যায় না। এসব পাখি শীতের পরে ভারতের উষ্ণতর অঞ্চলগুলো থেকে এখানে পরিযান করে আসে। রুক্ষ অঞ্চল হলেও লাদাখে বসবাসকারী পাখি প্রজাতির সংখ্যা অনেক বেশি এ পর্যন্ত মোট ২২৫ প্রজাতির পাখি এখান থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসব পাখিরা প্রধানত সো মরিরির মত উঁচু পাহাড়ি জলাভূমিতে বসবাস ও প্রজনন করে।
গ্রীষ্মকালীন পাখিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির তুতি, রবিন, লালগির্দি আর মোহনচূড়া এখানে সচরাচর দেখা যায়। এছাড়া এ সময় চুংথাং অঞ্চলের হ্রদগুলোতে আর সিন্ধু নদে প্রায়ই খয়রামাথা গাঙচিলকে বিচরণ করতে দেখা যায়। আবাসিক পাখির মধ্যে রয়েছে খয়েরি চখাচখি ও দাগি রাজহাঁস । তিব্বতী মালভূমির বিরল কালোঘাড় সারসকে গ্রীষ্মকালে লাদাখের বেশ কিছু অংশে প্রজনন করতে দেখা যায়। অন্যান্য পাখির মধ্যে র্যাভেন, তিব্বতী তুষারমোরগ এবং চুকার বাতাই প্রধান। শিকারী পাখির মধ্যে গৃধিনী এবং সোনালি ঈগল, এই দু'টি প্রজতি প্রায়ই দেখা যায়
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৭