মন্তেনিকো
গভীর জঙ্গলের মধ্যে মেঘের উপরে এক দেশ। মেঘের উপর বললাম কারণ সতেরো হাজার ফুট উচ্চতায় সে দেশের বাচ্চারা যখন বুনো ফড়িং এর পেছনে দৌড়ে বেড়ায় তখন তাদের পায়ের অনেক নীচ দিয়ে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ। আর গভীর জঙ্গলের কারণে বাইরে থেকে সে দেশে মানুষ বেড়াতে যায় খুব কম। দেশটির নাম মন্তেনিকো। স্থানীয় ইতিহাসে আছে যে একবার একদল সন্নাসী জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই দেশে হাজির হয়। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত সন্নাসীরা এখানে পৌঁছে সুস্বাদু কিছু ফলের সন্ধান পায়। একই সাথে একটা ছোট কিন্তু গভীর হ্রদ খুঁজে পায় তারা। ফল এবং খাবার পানি পেয়ে তাদের জীবন বেঁচে যায়। এখানেই শেষ নয়। গভীর রাতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তারা দেখে পশ্চিম আকাশে থালার মত নীলচে রঙের একটা চাঁদ উঠেছে। হতভম্ব সন্নাসীরা দেশটির নাম দেয় মন্তেনিকো। তাদের ভাষায় মন্তেনিকোর অর্থ হল নীল চাঁদ। সেই থেকে দেশটির নাম মন্তেনিকো।
বর্তমানে মন্তেনিকোতে পাঁচ বছর পর পর ভোট হয়। দেশ পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদ। তবে রাজা রাণীও আছেন। দেশের মানুষ তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। মাত্র বিশ হাজার লোকের এই দেশে একটাই শহর, যার নামও মন্তেনিকো। দেশের নামে নাম। যেমন সিঙ্গাপুরের রাজধানী সিঙ্গাপুর সিটি, সেরকম আরকি। মন্তেনিকোর জাতীয় প্রতীক হল বাঁশী। এই বাঁশী কি করে তাদের জাতীয় প্রতীক হল এ নিয়ে একটা গল্প আছে। অনেক অনেক বছর আগে মন্তেনিকোয় এক রাজা ছিলেন। রাজা থাকলে রাণী থাকতে হয়। তবে সেই রাজার কোন রাণী ছিলনা। রাজা বড় ভাল মানুষ ছিলেন। যুদ্ধ টুদ্ধ বিশেষ জানতেন না। অবশ্য জঙ্গলের মধ্যে রাজ্য হবার কারণে অন্য দেশ তাদের সাথে লড়াই করতেও উৎসাহ পেতনা। রাজার ছিল গান বাজনার নেশা। সারাক্ষণ গান বাজনা নিয়েই থাকতেন। বছরে একবার তাঁর দেশে গানের আসর বসত। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে সেই গানের আসরে গান শুনিয়ে রাজাকে মুগ্ধ করত। সেই রাজা একবার জঙ্গলে গেলেন শিকার করতে। এমনিতে তিনি শিকার ব্যাপারটা যে খুব পছন্দ করতেন তা নয়, তবে তাঁর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ শিকারের ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখাত। তাদের উৎসাহে তিনি একবার বের হলেন। এবং অদ্ভুত ভাবে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললেন। এই জঙ্গলের প্রতিটা গাছ তিনি জন্মলগ্ন থেকে দেখে এসেছেন। পথ হারাবার তাঁর কোনই কারণ নেই। কিন্তু রাজা বিস্ময়ের সাথে দেখলেন, জঙ্গলটা তাঁর কাছে অপরিচিত ঠেকছে। তাঁর দ্রুত হাঁটার অভ্যাস ছিল। দ্রুত হাটার কারণে তিনি কোন এক ফাঁকে দলের লোকজন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি সেটা টের পান নি। আবার রাজা যে হারিয়ে গেছেন সেটা তাঁর দলের লোকজনও বুঝে উঠতে পারেনি। তিনি বুঝলেন যে মাথা গরম করা চলবেনা। চীৎকার করলেও কেউ শুনবেনা কারণ জঙ্গল এতই ঘন যে চীৎকার বেশীদূর যাবেনা। সুতরাং তিনি হাঁটতে লাগলেন। হ্রদটার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলে তিনি ফিরে যেতে পারবেন এ আশা তাঁর আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে হ্রদটা যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। কিছুতেই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ হাঁটার পর তিনি একটা মৃদু সুরেলা শব্দ শুনতে পেলেন। শব্দটা তাঁর কাছে অচেনা। কিসের শব্দ এটা? অনেকটা পাখীর গানের মত কিন্তু অত্যন্ত চমৎকার। চেনা একটা ঘুমপাড়ানি গানের সুর বেজে চলেছে সেই অচেনা আওয়াজে। শব্দটা লক্ষ্য করে রাজা এগিয়ে চললেন। এবং পৌঁছে গেলেন হ্রদের তীরে। পৌঁছে যা দেখলেন তার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকগুলো পাহাড়ী হরিণ হ্রদের তীরে গোল হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। মাঝখানে এলো চুলে বসে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির হাতে ছোট্ট একটা কাঠের টুকরোর মত কিছু। মেয়েটা সেটা দিয়ে ঘুম পাড়ানী গানের সুর তুলছে। হরিণগুলো চুপ করে শুনছে। রাজা তাঁর জীবনে এমন অসাধারণ দৃশ্য কখনো দেখেননি। বাঁশী জিনিষটা তিনি চিনতেন না। নিজে তিনি খুব ভালো ঢোল বাজাতে পারতেন। তাঁর কাছে যারা গান শোনাতে আসত তারাও ঢোল কিংবা হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই বাজিয়ে গান করত। কিন্তু এই যন্ত্রের আওয়াজের কাছে যেন ঢোল কিছুইনা। অসাধারণ বাদ্য যন্ত্রটার সুর রাজাকে মুগ্ধ করে ফেলল। তার থেকেও তিনি মুগ্ধ হলেন সেই মেয়েটাকে দেখে। বনের হরিণ যার কাছে এসে চুপ করে থাকে। তিনি সম্মানের সাথে মেয়েটার সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। এবং জানলেন এই বাদ্যযন্ত্রটির উদ্ভাবক মেয়েটি নিজেই। রাজার বিস্ময় আরো বাড়ল। সাঙ্গপাঙ্গরা ততক্ষণে রাজাকে না পেয়ে বন উজাড় করে ফেলেছে। যতক্ষণে তারা রাজাকে হ্রদের তীরে আবিষ্কার করল, ততক্ষনে রাজা মেয়েটার সাথে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। এবং বুঝতে পেরেছেন বাকী জীবন তিনি যদি এই মেয়েটার সাথে কাটাতে না পারেন তাহলে এ জীবনের কোন মানেই হয় না।
রাজা মেয়েটিকে নিজের রাণী করলেন। বাঁশীকে করলেন নিজের দেশের প্রতীক। গল্পে আছে রাজা গভীর রাতে রাণীকে নিয়ে মাঝেমাঝেই হ্রদের তীরে হাজির হতেন। তাঁর সাথে থাকত ঢোল। রাজা নিজে রাণীকে ঢোল বাজিয়ে গান শোনাতেন। রাণীর চুল ছিল অনেক লম্বা। তিনি একটা পাথরের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতেন আর রাজার গান শুনতেন। রাত আরো গভীর হলে সেই থালার মত নীল চাঁদটার উদয় হত। রাজা রাণী পাশাপাশি বসে চুপ করে সেই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেন। হ্রদের জলে টলমল করত তাঁদের ছায়া।
অত্যন্ত সুখী ছিলেন রাজা। কিন্তু সুখ তো আর চিরকাল থাকেনা। তাদের খাবার জলের একমাত্র উৎস সেই হ্রদটা কোন অজ্ঞাত কারণে শুকিয়ে যেতে লাগল। শুধু তাইনা, ঝকঝকে হ্রদের জলটা হয়ে উঠতে লাগল কালো। স্বাদ হয়ে যেতে থাকল বিস্বাদ। যত দিন যেতে লাগল ততই খাবার জলের সমস্যা প্রকট হতে লাগল। কেউ বুঝতে পারছিলনা কেন এটা হচ্ছে। রাজ জ্যোতিষী রাজাকে তখন একটা অদ্ভুত কথা শোনালেন। জ্যোতিষী বললেন দু হাজার বছর পরপর এই হ্রদে নাকি একটা বড় সাপ আস্তানা গাড়ে। সাপটা থাকে জলের ভেতর। এই সাপ মারা না যাওয়া পর্যন্ত হ্রদের জল বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে এই সাপ কারো হাতে মারা পড়বেনা। একমাত্র রাজ্য প্রধানের হাতেই এ সাপের মৃত্যু হবে। জ্যোতিষীর কথা সবাই হেসে উড়িয়ে দিল। তারপরও দেশের সাহসী বীর বলে যাদের সুখ্যাতি আছে এমন কয়েকজন হ্রদে নেমে হ্রদ তোলপাড় করে ফেলল। কিন্তু কোন সাপ পাওয়া গেলনা। রাজ জ্যোতিষী মুচকি মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে রাজার কাছে মনে হল একটু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। রাজ জ্যোতিষির কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, আর সেখানে সত্যিই যদি সাপ থেকে থাকে তবে তো তাঁর কারণেই সাপটা মারা পড়ছেনা। তাঁর দেশের মানুষ খাবার জল না পেয়ে ছটফট করছে। এটাতো তিনি হতে দিতে পারেন না। তিনি ঘোষনা করলেন যে একা হ্রদে নেমে তিনি ব্যাপারটা দেখতে চান। সবাই নিষেধ করল। সবার নিষেধাজ্ঞা রাজা অগ্রাহ্য করলেন। রাণী অনেক নিষেধ করলেন। কিন্তু তিনি কারো কথা শুনলেন না। রাজ পোশাক ছেড়ে তিনি সাধারণ একটা পোশাক পরলেন। হাতে নিলেন ছোট একটা ছুরি। সূর্য ডুবে যাবার সময় রাজা ঝাঁপ দিলেন হ্রদের জলে। জল কমে গেলেও হ্রদ ছিল তখনো যথেষ্ট গভীর। ঝাঁপ দেবার পর রাজাকে আর দেখা গেল না। উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে রাণীসহ সবাই হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল, কিন্তু রাজা উঠে আসছেন না। আরো কিছুক্ষণ পর সবার কাছে মনে হল ডুবে যাওয়া সূর্যটা যেন হ্রদের মধ্যে আবার উদয় হচ্ছে। জলের রঙ যাচ্ছে পাল্টে। কালো থেকে জলের রঙ হয়ে যাচ্ছে টকটকে লাল! সবার মধ্যে হইচই পড়ে গেল। জলের ভেতর কিছু একটা যে হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কোন তোলপাড় নেই। কোন আলোড়ন নেই। রাজারও কোন খবর নেই। সেই অবস্থায় বেশ কয়েকজন জলে ঝাঁপ দিল রাজাকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু অনেকক্ষণ পর তারা উঠে এল ভগ্ন মনোরথে। সারারাত দেশের লোকেরা হ্রদ ঘিরে বসে রইল এই আশায়, হয়ত রাজা উঠে আসবেন জল থেকে। কিন্তু রাজা আর ফিরে এলেন না। সকাল বেলায় দেখা গেল জলের রঙ আবার আগের মত হয়ে গেছে। হ্রদ আবার পূর্ণ হয়ে গেছে কানায় কানায়। জলের স্বাদও হয়ে গেছে ঠিক আগের মত। হ্রদের মাঝখানে ভেসে আছে রাণীর সেই ছোট্ট কাঠের বাঁশীটা। বাঁশীটা সবসময় রাণীর গলায় ঝোলানো থাকত। রাণী দেখলেন বাঁশীটা গলায় নেই। কোন্ ফাঁকে জলে নামার সময় বাঁশীটা রাজা নিয়েছিলেন, রাণী তা লক্ষ্য করেননি।
রাণী সারাদিন কারো সাথে কথা বললেন না। নিজের ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সারাদিন, সারারাত। গভীর রাতে দূর থেকে কতগুলো পাহাড়ী হরিণ মরাকান্নার মত আওয়াজ করতে লাগল। পরের দিন কেউ আর রাণীকে খুঁজে পেলনা। সতেরো হাজার ফুট উপরের সেই মেঘের দেশ থেকে রাণী হারিয়ে গেলেন চিরতরে।
---------------------------------------------------------------
ছবিতে যে মূর্তিদুটো দেখা যাচ্ছে সেগুলো আমি দার্জিলিং থেকে কিনেছিলাম ২০১২ সালে। পিতলের তৈরি মূর্তিগুলোর দিকে যতবার তাকাই আমার মাথায় একটা গল্প আসে। মনে হল গল্পটা লিখে ফেলা যায়। মন্তেনিকো বলে কোন দেশ পৃথিবীতে নেই। অন্তত এখন পর্যন্ত নেই।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন