মিতালী রোডের ৩২ নম্বর বাড়ী। একতলা পাকা দালান। গেট দিয়ে ঢুকলে ছোট একটা উঠান। উঠানের পশ্চিম কোণায় একটা কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল গাছটায় প্রতি বছর প্রচুর মুচি ধরে। কাঁচামরিচের থেকে একটু বড় হবার পর মুচিগুলো ঝরে যায়। প্রতিবছরই একবার করে সিদ্ধান্ত হয় গাছটা কেটে ফেলার। কিন্তু কিভাবে জানি বেঁচে যায় গাছটা। উঠানটা ছেয়ে থাকে কাঁঠাল পাতায়। এই বাড়ীতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে হোসেন আছে অল্প কিছুদিন ধরে। বাড়ীর মালিক শাহাবুদ্দীন ব্যাপারীর বয়স পঁয়ষট্টি। তিনি হোসেনের জন্য তার স্টোররুমটি ছেড়ে দিয়েছেন। স্টোররুমটি তে দুনিয়ার রাবিশ ছিল। ভাড়া দেবার জন্য তিনি সেটা পরিষ্কার করেছেন। নিঃসন্তান শাহাবুদ্দীন পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া এই বাড়ীটিতে স্ত্রী নিয়ে থাকেন। আগে একটা ট্যানারীতে কেমিক্যাল সাপ্লাই দিতেন। সেই ট্যানারীও এখন বন্ধ। আয় উপার্জন বলতে তেমন কিছু নেই। তেমন কোন সঞ্চয়ও নেই। বাধ্য হয়ে পেয়িং গেস্ট এর টু-লেট ঝুলিয়েছিলেন বাড়ীর গেটে। যে দিনকাল পড়েছে, কিছু পয়সা আসলে খারাপ কি। টু-লেট ঝোলানোর তিনদিনের মাথায় হোসেনের এই বাড়ীতে আগমন।
কিছু কিছু মানুষের চেহারায় সৃষ্টিকর্তা একটা স্থায়ী বেকুব ভাব দেন। হোসেনের চেহারায় সেই বেকুব ভাব প্রবল। তার উচ্চতা খুব বেশী না, তবে কুঁজো হয়ে হাঁটার কারণে তাকে আরো ছোট দেখায়। কথা বলার সময় সে কারো চোখের দিকে তাকায় না। মাথা নীচু করে নীচু স্বরে কথা বলে। চেহারার বেকুব ভাবের কারনেই শাহাবুদ্দীন ব্যাপারী তাকে পেয়িং গেস্ট করলেন। চালাক চতুর চেহারার কাউকে বাসায় ঢুকিয়ে বিপদে পড়বেন নাকি? শেষে দেখা যাবে ঘরের জিনিষপত্র নিয়ে ভেগে গেছে। শাহাবুদ্দীনের বৃদ্ধা স্ত্রী সালেহা বেগম কিন্তু হোসেনকে বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। স্ত্রী জাতি নিঃসন্তান হলে সাধারণত একটা বয়স পর্যন্ত সবাইকেই সন্তানসম বিবেচনা করে। সালেহা বেগম সেই বয়স পার করে এসেছেন। এখন তার সবকিছুই অসহ্য লাগে। সবচেয়ে বেশী অসহ্য লাগে শাহাবুদ্দীন ব্যাপারীকে। তার কোথাও যাবার জায়গা নেই বলে এখানে পড়ে আছেন। তা না হলে তিনি এই সংসারে লাথি মেরে চলে যেতেন। এই কথাটা তিনি দিনের মধ্যে অন্তন্ত কয়েকবার শাহাবুদ্দীনকে শোনান। একুশ বাইশ বছর বয়সী হোসেনকে ব্যাগ কাঁধে ঘরে ঢুকতে দেখে সালেহার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সময় খুব খারাপ। এরকম সময়ে কারো পেয়িং গেস্ট হবার জন্য আসার কথা না। শাহাবুদ্দীনের টু-লেট দেখে যে সত্যিই কেউ চলে আসবে তা তিনি কল্পনা করেননি। সালেহা বেগম শাহাবুদ্দীনের উদ্দেশ্যে চীৎকার করতে লাগলেন, “বুইড়া তুই দাড়ি রাইখা দরবেশ হইছস? এখন তোর সাগরেদ দরকার? বাসার মধ্যে দরবার বসাবি? তোর দরবারের কি করি তুই দ্যাখ! আইজকা তোর একদিন কি আমার একদিন!” শাহাবুদ্দীন ব্যাপারীর আগে দাড়ি ছিলনা। কিছুদিন আগে থেকে অনেকের পরামর্শে তিনি দাড়ি রাখা শুরু করেছেন। চোখে সুরমা দিচ্ছেন। স্ত্রীর চীৎকার অগ্রাহ্য করে শান্ত গলায় তিনি হোসেনকে বললেন, “চুলা কিন্তু একবেলা ব্যবহার করতে পারবা। মন চাইল চা খাইবা আর অমনি চুলা জ্বালাইয়া বইসা পড়বা এইসব আমার বাসায় চলবনা। একবেলা চুলা জ্বালাইবা। নিজের খাওন নিজে রাইন্ধা খাইবা। ঠিক আছে?”
শাহাবুদ্দীন পত্নীর চিৎকারে হোসেন এমনিতেই বিভ্রান্ত। এবার সে আরো বিভ্রান্ত হয়। পেয়িং গেস্ট মানে তো রান্না করার কোন ঝামেলা থাকার কথা না। আগে যে বাসাটায় সে পেয়িং গেস্ট থাকত সেটা অনেক ভাল ছিল। স্বামী স্ত্রী আর তাদের তিন বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে নিয়ে ছোট পরিবার। বাচ্চা মেয়েটা হোসেনকে ডাকত “হোচেন”। ভদ্রলোক একটা প্রেসে কাজ করতেন। নিতান্তই অল্প আয়ের চাকরী বলে বাধ্য হয়ে পেয়িং গেস্ট রেখেছেন। সেই বাসায় নিজের রান্নাবান্নার ঝামেলা তো ছিলই না বরং খাবার টেবিলে সবার সাথে বসে তাকে খেতে হত। ভদ্রলোকের স্ত্রী হোসেনকে ছোট ভাইয়ের মত আদর করত। খাবার সময় আরেকটু ভাত নেবার জন্য সে যখন হোসেনকে পীড়াপীড়ি করত তখন মাঝেমাঝে হোসেনের চোখে জল চলে আসত। তার মনে হত এত ভাল মানুষও হয় পৃথিবীতে! সেই অতি অল্পবয়স্ক হাসিখুশী স্ত্রীটির হঠাৎ একবার প্রচন্ড জ্বর হল। তিনদিনের দিন বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় সে তার মেয়েটাকে ডেকে বলল, “মামনি, আমি গেলাম। তোমার বাবাকে দেখে রেখ।” হতভম্ব পরিবারটির এবং হোসেনের চোখের সামনে মেয়েটা মারা গেল। সেই ভদ্রলোক নিজের মেয়েকে নিয়ে তার পৈত্রিক বাড়ী মুন্সিগঞ্জে চলে গেলেন। হোসেনকেও যাবার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। হোসেন রাজী হয়নি। তাকে ঢাকায় থাকতে হবে। একটা চাকরী জোগাড় করতে হবে। বাবা মারা গেছেন তিন বছর হয়েছে। তার উপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। তার মাথার উপর অনেক দায়িত্ব।
রান্নার ঝামেলা সত্ত্বেও শাহাবুদ্দীনের বাড়ীতে উঠতে হোসেন আপত্তি করেনি। তার মাথার উপর একটা ছাদ দরকার। মিতালী রোডের বাসাটায় পাঁচ ফুট বাই নয় ফুট ঘরটাতে আছে শুধু একটা চৌকি। যতক্ষন সে এই বাড়ীতে থাকে ততক্ষন তার কাজ হচ্ছে চৌকিতে শুয়ে ছাদে মাকড়শার জাল দেখা। এই রুমে একটা মা মাকড়শা আর চারটা ছানা মাকড়শা আছে। মাঝে মাঝে একটা ছানা মাকড়শা কোথায় জানি গায়েব হয়ে যায়। কোন ছানাটা গায়েব হয় এটা সে ধরতে পারে, কারণ এর আটটা পায়ের একটা পা সাদা রঙের। বাকী তিনটা ছানা ঘরের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে। শুধু মা মাকড়শাটা সারাদিন পেটে একটা বিশাল সাইজের ডিম নিয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকে।
প্রায় বছর খানেক এখানে সেখানে ঘুরেও হোসেন তেমন কোন সুবিধা করতে পারছেনা। নিজের খরচ জোগানোর জন্য তিনটি টিউশনি অবশ্য সে জুটিয়েছে। টিউশনির সময় ছাড়া সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তাকে দেখা যায় শঙ্কর বাসস্ট্যান্ডের গলির ভেতর কুমিল্লা বই বিতানে। এখানে স্কুল কলেজের বিভিন্ন বই, খাতা, রাবার পেন্সিল বিক্রি হয়। বয়স্ক দোকানদারের নাম নাম ইমান আলী। বইয়ের দোকানের উপরের তলায় তার বাসা। সন্ধ্যার পর ইমান আলী সাহেব কিছুক্ষন হালকায়ে জিকির করেন। জিকির তার বাড়ীতেই হয়। এই সময়টায় হোসেন তার দোকান পাহারা দেয়। টুকটাক বইখাতা বিক্রি করে। বিনিময়ে এ বাড়ীতে সে রাতের খাবারটা খেতে পায়। যখন কোন খদ্দের আসেনা তখন সে বসে বসে নবম দশম শ্রেনীর র্যাপিড রিডার পড়ে। টেস্ট পেপার পড়ে। তার কাছে মনে হয় আবার যদি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারত তাহলে সে খারাপ করতনা। হয়তো আগেরবারের চেয়ে ভালই করত।
আজ বিকেলে হোসেন রান্না করেছে। ভাত, ডিম ভুনা, আলুভর্তা আর ডাল। টিফিন ক্যারিয়ারে রান্না করা খাবারটা সে ভরল। কিছুক্ষনের মধ্যে মাগরিবের আযান দেবে। এই খাবার দিয়ে একটু পর ইফতার করা হবে। ট্যানারী মোড়ের একটা বাসায় হোসেন টিউশনি করাতে যায়। দোতলায় ক্লাস টেনের একটা মেয়েকে সে পড়াতে আসে। তিনতলাতে তার দুজন বন্ধু থাকে। তিনতলাটা ব্যাচেলর কোয়ার্টার। মতিন আর মনসুর একটা রুম নিয়ে থাকে সেখানে। এ বাড়িতে পড়াতে আসার সুবাদে এদের সাথে তার পরিচয়। হোসেন মাঝে মাঝে এদের জন্য রান্না করে। রান্নার পুরো খরচ এরা দেয়। হোসেনের রান্নার হাত ভাল। তার বন্ধুরা অনেক দিন থেকেই তাকে তাদের সাথে এসে ওঠার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। সেটা তার সঙ্গ পাবার থেকেও রন্ধন সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার আশায়। রান্না করার বুয়া তাদের একজন ছিল। তবে তার রান্না মুখে দেওয়া যেতনা। একদিন ডালে লবন কম হয়েছে বলে মনসুর বুয়ার সাথে একটু উচ্চবাচ্য করেছিল। বুয়া শীতল চোখে কোন কথা না বলে সেসব হজম করে গেল। তবে সে যে আসলে কিছুই হজম করেনি তা বোঝা গেল পরের দিন। মনসুর ডাল বিলাসী লোক। খাবার শুরু করে ডাল দিয়ে। আবার শেষ করার পর এক প্লেট ডাল চুমুক দিয়ে খায়। সে তার স্বভাবমত আধাপ্লেট ভাতের সাথে তিন চামচ ডাল মেখে খাওয়া শুরু করেছিল। প্রথম লোকমা মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিতে হল। ডালে কম করে হলেও আধা পোয়া লবন দেয়া হয়েছে। সেদিনই পত্রপাঠ বুয়াকে বিদায় করে দেয়া হয়। বাড়িওয়ালীকে বলে কয়ে অনেক কষ্টে মতিন আরেকটা বুয়া জোগাড় করেছিল। মার্চ মাসের পর থেকে সেই বুয়াও গায়েব। কিছুদিন মনসুর আর তার রুমমেট মতিনের খুব কষ্টে কাটল। তারপর তাদের পরিচয় হল হোসেনের সাথে। এদের রান্নার সমস্যা দেখে হোসেন একদিন নিজে থেকে এদের জন্য ভুনা খিঁচুড়ি আর ডিম ভাজি করে খাওয়ালো। মতিন আর মনসুর খেয়ে মুগ্ধ। মনসুর বলল, “ভাই হোসেন, আমার মাও এত ভাল খিঁচুড়ি রান্না করতে পারেনা। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের জন্য মাঝে মাঝে একটু রান্না করে দিও ভাই। তোমারও দাওয়াত থাকবে সেদিন, কি বল?” হোসেন এ প্রস্তাবে আপত্তি করেনি। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। এখন তারা বন্ধুর থেকেও বেশী কিছু।
নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই এবার হালকা শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই এবারের রোজায় তেমন কোন কষ্ট হচ্ছে না। অবশ্য সময়টা একই সাথে উত্তেজনার এবং অবসাদের। মানুষ খুব বেশী সময় উত্তেজনা ধরে রাখতে পারেনা। সে অবসাদগ্রস্ত হয়। অবসাদগ্রস্ত মানুষের প্রথম যে অনুভূতি কমে আসে তা হল ক্ষুধার অনুভূতি। মার্চ মাস থেকেই হোসেন এবং এই শহরের আরো অনেকে প্রায়ই একবেলা খেয়ে থাকে। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এতে তারা এখন কোন কষ্ট অনুভব করেনা। এ শহর হোসেনের কাছে এখনও নতুন। তারপরও রায়েরবাজার এলাকায় সে আছে প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল। গত বছরও সে দেখেছে কত গমগম করত এলাকাটা। অনেকগুলো কুমোর পরিবার ছিল আখাড়ার মন্দিরের আশেপাশে। এরা সবাই পাল। জায়গাটাকে সবাই বলে পাল পাড়া। মে মাসের পর থেকে পালরা প্রায় সবাই রাতের অন্ধকারে ঘরবাড়ি ফেলে রেখে চলে যায়। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারেনা। কুমিল্লা বই বিতানে হেঁটে যাবার পথে গদিঘরের পাশে একটা টং দোকান পড়ে। এই দোকানে সে চা খেত। চায়ের দোকানের ছেলেটার সাথে হোসেনের কিছুটা সখ্য হয়েছিল। বসন্ত নামের ছেলেটাও একমাস হল তার টং বন্ধ করে চলে গেছে। হোসেনের তিনটা টিউশনির মধ্যে একটা কোনমতে টিকে আছে। তাও বেতনের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বাকি দুই পরিবার দেশের বাড়ি চলে গেছে। আদৌ তারা ঢাকায় ফিরবে কিনা বলা যাচ্ছেনা।
শেষ বিকেলে হোসেন বের হল। হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। সে এমনিতেই হালকা পাতলা গড়নের। তার উপর আজকে তার পরনে একটা পাতলা পাঞ্জাবী আর পায়জামা। হঠাৎ তার বেশ শীত করতে লাগল। রাস্তায় নেমে তার মনে হল গেরুয়া রঙ্গের যে চাদরটা তার আছে সেটা নিয়ে এলে কেমন হয়? সে কি বাসায় ফিরে যাবে? কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আযান দেবে। দোটানায় পড়ে কিছুক্ষন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার সে লক্ষ্য করে। রাস্তায় কোন মানুষ নেই। এমনিতেই ইদানীং এ সময়ে রাস্তায় তেমন একটা মানুষ থাকেনা। তারপরও দু একজন দেখা যায়। আজ রাস্তা একেবারেই খালি। হোসেন টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে একটু অস্বস্তি করতে লাগল। তবে কি যাওয়া বাদ দেবে সে? তার এই অস্বস্তির কারণ কি? কখনও তো এরকম লাগেনা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে হাঁটা দিল দক্ষিন দিকে। তাকে যেতেই হবে। সব কিছু প্ল্যান করা হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অর্থহীন অস্বস্তির কারণে এখন সে উল্টাপালটা কিছু করতে পারেনা।
নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ, শুক্রবার। ১৯৭১ সাল। হোসেন যখন ট্যানারী মোড়ের দিকে যাচ্ছে ঠিক সে সময় রায়েরবাজার থেকে হাজারীবাগের দিকে এগিয়ে আসছিল একটা আর্মি জীপ। মেজর সালিকের নেতৃত্বে পাকিস্তান মিলিটারীর একটা ছোট গ্রুপ এই জীপে অবস্থান করছিল। গাড়িতে বসা মেজর সালিককে অত্যন্ত বিরক্ত দেখাচ্ছিল। কিছুক্ষনের মধ্যে মাগরিবের আযান দেবে। ইফতারীর কি আয়োজন তা তিনি জানেননা। আব্দুল মালেক নামে হাজারীবাগের একজন ইনফর্মার নিজের বাসায় তাকে ইফতারীর দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি দাওয়াত গ্রহন করেননি। লোকাল লোকজনের সাথে এত দহরম মহরম তার পছন্দ না। যদিও অনেক ইনফর্মেশনের জন্য তাকে লোকাল লোকজনের উপর ভরসা করতে হয়। তিনি আব্দুল মালেককে বলেছেন হাজারীবাগ কলেজ মাঠে তার জন্য ক্যাম্প করতে। সেখানেই ইফতারীর আয়োজন যা হয় কিছু একটা করার জন্য। তার বিরক্তির আরেকটা কারণ হল তার নিজের এলাকা ছেড়ে এখানে আসা। এখানে তার আসার কথা না। ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট এসেছে যে কিছু যুবক এখানে গোপনে সংঘবদ্ধ হয়ে বড় ধরণের কোন নাশকতার পরিকল্পনা করছে। তার উপর নির্দেশ এসেছে এখানে ছোটখাট একটা অভিযান চলানোর। এ ধরণের অভিযানে সাধারণত কিছু লোকজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিছুমাত্র সন্দেহ হলে ফায়ার করা হয়। উদ্দেশ্য এলাকার সবার মধ্যে ভয় ঢোকানো। নাশকতার কোন পরিকল্পনা যদি কেউ করেও থাকে সেটা ঘটানোর আগে সবাই যেন দশবার ভাবে।
ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া হোসেনকে আনোয়ার স-মিলের সামনে থেকে আটক করা হল। জীপের পেছনে আসা একটা পিকআপে তোলা হল তাকে। টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়েই সে উঠল। একজন সৈন্য টিফিন ক্যারিয়ারটায় রাইফেলের গুতো দিয়ে জিগ্যেস করল, “ইস মে রস্গুল্লা হ্যায় ক্যায়া?” একবার কোন এক গ্রামে এক হিন্দু ময়রার দোকানের রসগোল্লা সে চেখেছিল। তারপর থেকে সে রসগোল্লার ভক্ত। ময়রাকে মেরে ফেলার আগে তার বক্তব্য ছিল এটা তার অফিশিয়াল ডিউটি, কিছু করার নেই। তবে রসগোল্লার কথা সে মনে রাখবে। হোসেন বাংলায় বলল, “এতে ভাত আছে স্যার। আমার ইফতার। আমি রোযাদার”। ভাত শব্দটা বোধহয় সৈনিকের পছন্দ হলনা। একটা নাক সিঁটকানোর ভঙ্গি করে সে সরে বসল। পিকআপে আগে থেকেই আরো কিছু ছেলেকে উঠিয়ে আনা হয়েছিল। তার মধ্যে দুজনকে হোসেন চেনে। তারাও হোসেনকে চেনে। কিন্তু এখন তারা এমন ভাব করছে যেন কেউ কাউকে চেনে না। সবাইকে হাজারীবাগ মাঠে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করানো হল। বিভিন্ন বয়সী প্রায় বিশজন যুবক। একজন একজন করে সবাইকে একই প্রশ্ন করা হচ্ছে। অর্থহীন সব প্রশ্ন। তারা মুক্তি কিনা। তারা কোন মুক্তিকে চেনে কিনা। যে ছেলেগুলোকে ধরে আনা হয়েছে তারা সবাই মুসলিম। তারপরও জিগ্যেস করা হচ্ছে তারা মুসলিম কিনা। আরো কিছু জিগ্যেস করা হচ্ছে। যেমন রোযা রেখেছে কিনা। সেহরির নিয়্যত বলতে পারে কিনা ইত্যাদি। হোসেনের সামনে এসে মেজর সালিক দাঁড়ালেন। এক ঝলক তাকিয়েই ছেলেটাকে তার কাছে আপাদমস্তক নির্বোধ মনে হল। চেহারায় একটা মানুষের অনেক কিছু ধরা পড়ে। এই ছেলের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এ একটা নিরেট গর্দভ। একে পিকআপে করে উঠিয়ে আনাই ভুল হয়েছে। রাস্তায় একটা চড় দিয়ে ছেড়ে দিলেই হত। তাও রুটিন রক্ষার্থে জিগ্যেস করলেন নাম কি। কোথায় থাকে। এই সন্ধ্যার সময় সে কেন বাইরে। এবং এই টিফিন ক্যারিয়ারে কি আছে। মাথা নীচু করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হোসেন সব প্রশ্নের জবাব ঠিকমতই দিল। শেষের প্রশ্নটার উত্তরেও সে একই কথা বলল যে এটা তার ইফতার। কথাটা বলার সময় কেন জানি একটু কাশি চলে এল তার। মেজর সালিক তীক্ষ্ম চোখে হোসেনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষন পর বললেন, তুমি টিফিন ক্যারিয়ার খোলো। হোসেন এক মুহুর্ত ইতস্তত না করে টিফিন ক্যারিয়ার খোলা শুরু করল। প্রথম বাটির ঢাকনা খুলতেই গরম বসা ভাতের একটা তীব্র গন্ধ এসে মেজরের নাকে ঢুকল। মেজর মাথা সরিয়ে নিলেন, কিন্তু চোখ সরালেন না। হোসেন প্রথম বাটি নামিয়ে রেখে নিবিষ্ট মনে দ্বিতীয় বাটিটি খুলছে। এমন সময় পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “আরে হোসেন না? তুমি কি করবার লাগছ এইহানে?” হোসেন তাকিয়ে দেখে আব্দুল মালেক। এই এলাকায় মুক্তি বাহিনীর খবর যারা পাকিস্তান আর্মিকে সরবরাহ করে ইনি হচ্ছেন তাদের নেতাগোছের। মেজর সালিক আব্দুল মালেকের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, “তুমি একে চেন?” –“চিনি তো এইহানের ছবতেরেই। তবে এরে ভাল মত চিনি। ছাহ্বুদ্দীন ব্যাপারীর বারিত্ থাকে। পোলাটা ভ্যান্দা। আসল চিজ ফালাইয়া এইছব আবাল পোলাপাইন ধইরা আনছেন দেইখা ছরমিন্দা হইলাম।” আব্দুল মালেকের কথার টোনটা মেজর এর পছন্দ হলনা। তবে যতটুকু বাংলা তিনি বোঝেন তাতে বুঝতে পারলেন এই ছেলেটার ব্যাপারে তার নিজের ধারণা সঠিক। একে শুধুশুধুই ধরে আনা হয়েছে। মেজর সালিক লক্ষ্য করলেন তার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। তিনি হোসেনকে টিফিন ক্যারিয়ার বন্ধ করতে বললেন। টিফিন ক্যারিয়ার ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়াতেই হোসেন কানের নীচে প্রচন্ড এক চড় খেল। -“সন্ধ্যার সময় বাসার বাইরে যাবে না। নাউ গেট লস্ট!” সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিয়ে হোসেনকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে আদেশ দিলেন তিনি। বেরিয়ে যাবার সময় পিকআপের সেই ছেলেদুটোর সাথে তার চোখাচোখি হল। হোসেন দেখল তাদের চোখের তারায় আতংকের সাথে কিছুটা যেন কৌতুক।
ইফতার করতে বসে হোসেন গুলির আওয়াজ পেল। ট্যানারী মোড় থেকে হাজারীবাগ কলেজের মাঠ এমন কোন দূরত্ব নয়। বেশ জোরেই শোনা গেল আওয়াজ। খাওয়া থামিয়ে মনসুর, মতিন আর হোসেন একজন আরেকজনের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।
সাড়ে সাতটার দিকে মেজর তার দলবল নিয়ে যখন ফেরত যাচ্ছিলেন হোসেন তখন হেঁটে হেঁটে কুমিল্লা বই বিতানের দিকে যাচ্ছে। হাতে তখনও টিফিন ক্যারিয়ার। মেজরের গাড়ী তাকে ক্রস করার সময় একজন সৈনিক বলে উঠল, “স্যার, দেখিয়ে, উয়ো ডাব্বাওয়ালা।” মেজর সেদিকে না তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ফরগেট ইট।”
শঙ্কর বাস স্ট্যান্ডের গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন রতন শিকদার। হোসেনের সিনিয়র বন্ধু। রায়েরবাজার মোহাম্মদপুর এলাকার ছোট একটা গেরিলা দলের সদস্য তিনি। হোসেনের সাতটা চল্লিশে এখানে আসার কথা। রতন ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাতটা চল্লিশ বাজে। ঘড়ি থেকে চোখ উঠিয়েই দেখেন গলির মাথায় ধীর পদক্ষেপে হোসেন আসছে। তিনি জানতেন হোসেন আসবে। কমিটমেন্ট কখনও মিস করেনা সে। চলে ঘড়ি ধরে। একটু স্লো হাটে ছেলেটা। স্লো বাট স্টেডি। হোসেন ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টিফিন ক্যারিয়ারটা রতনের হাতে দেয়। -“বুঝে নিন।” হোসেনের ভাবলেশহীন গলা। -“বুঝে নিলাম।” রতন হাসেন। -“মনসুর আর মতিনকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। এ মাসে এটাই ছিল তোমাদের শেষ মিশন। এরপর অন্য একটা দল কাজ করবে।”
---------o---------
গল্পের এই পর্যায়ে এসে আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করি, “আপনাকে যখন ধরল তখন আপনার টিফিন ক্যারিয়ারে কী ছিল?” আব্বা হাসেন। “আমি মিথ্যা বলিনি। সেখানে ইফতারই ছিল। আমার, মনসুর আর মতিনের খাবার।” আমি কনফিউজড হয়ে জিগ্যেস করি, “তাহলে আপনি রতন সাহেবকে কি দিলেন?” –“রতন ভাইকে দিলাম যা দেবার তাই। ফেরার পথেও আর্মিরা আমাকে দেখেছিল। আটকালোও না, কিছু জিগ্যেসও করলনা। কেন করল না তারাই জানে। আটকালে অবশ্য কি হত বলা যায়না।” আমার নির্বোধ আব্বা দুলে দুলে হাসতে থাকেন। আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি।
---------o---------
পাদটিকাঃ আব্দুল মালেক স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন আগে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দলের হাতে হাজারীবাগ ইটের ভাটায় নিহত হয়। মেজর সালিকের অফিস ছিল তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরীর নীচতলায়। দোতলায় ছিল নির্যাতন কক্ষ। গোটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রশিক্ষক সালেহ মুস্তাফা জামিল তাঁর “মৃত্যু-গুহায় তিনদিন” লেখনীতে এই মেজর সালিকের কিছু কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন। উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। আব্দুল মালেক আমার বাবার চেহারা দেখে একটু ভুল ধারণা করেছিলেন। এই একই ভুল করেছিলেন মেজর সালিক। প্রকৃতি মাঝেমাঝে কিছু মহৎ কাজের জন্য সবচেয়ে অনুপযোগী চেহারা দিয়ে কাউকে পাঠায়। তাদের চালচলন, কথাবার্তার কারণে তারা সমাজে বিবেচিত হয় নির্বোধ হিসেবে। তবে এই নির্বোধ চেহারা নিয়েও মহৎ কাজটি তারা নিষ্ঠার সাথেই সম্পন্ন করে যায়।