প্রাণ জুড়াই তব স্নেহের শীতল পরশে...
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
রাতের ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে চলে গেল। ট্রেনের বাঁশি শুনলেই আমার মনে হয় ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও চলে যাই। সেই যে একটা গান আছে না...
চল যাব তোকে নিয়ে/এই নরকের অনেক দূরে
এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে...
আচ্ছা! কারো কি জানা আছে কোথায় সেই সীমানা??আমার খুব ইচ্ছে একদিন সেই সীমানা পেরিয়ে যাব...একজন খাঁটি মানুষের দেখা পাব, যার সাথে দুদণ্ড গল্প করে উপলব্ধি করব আত্মার শুদ্ধতা। জানি, শুদ্ধ আত্মা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। নেতিবাচক দিক গুলো আছে বলেই তো আমরা মানুষ... হাসি কান্নায়, দোষে গুনে ষড়রিপুর প্রলোভনে তাড়িত এক আজব সৃষ্টি। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পিছে ছুটতে গিয়ে বিসর্জন দেই বিবেক, মেঝেতে গর্ত হলে সস্তা দরে সঠিক মাপে কার্পেট কিনে ঢেকে দেই, নিচে সাপ খোপ বা তেতুল বিছে থাকে থাকুক না! মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষের যদি আবেগ না থাকতো, তাহলে কি হত? হয়ত মানুষ ভালবাসতে জানত না... একই সাথে হয়ত মানুষের মাঝে ঘৃণাও থাকতো না।স্নেহ মমতা যেমন থাকতো না, তেমনি হয়ত হিংসা দ্বেষ বা মারামারিও থাকতো না। তখন মানুষের জীবন কেমন হত?? মানুষ কি তখন যন্ত্র হয়ে যেত?? ... এই পর্যন্ত এসে আমার কল্পনার দৌড় থেমে যায়। ছোট মাথায় এর বেশি আর ঢোকে না।কেমন জানি হতাশ লাগতে থাকে। মানুষ আবেগ শুন্য হয়ে গেলে আমি বাঁচতাম কি করে? আমার কি উচিত আবেগ শুন্য মানুষের কথা চিন্তা করা! চলতে পথে আমি নিজেই যে কত মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েছি! কত মানুষের স্নেহের গহীন ঘরে যে আমার বাস! আর সেই আমিই কিনা ভাবছি আবেগশুন্য মানুষের কথা! আসলেই আমি বড্ড বেশি স্বার্থপর...
ছেলেবেলার কথাই বলি।আমাদের বাসায় তখন আমার দূরসম্পর্কের এক ফুপাত ভাই থাকতো- শাহীন ভাইয়া।আমার অক্ষরজ্ঞান ওনার কাছেই। এই মানুষটা যে আমাকে কী ভীষণ স্নেহ করেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ছোটবেলায় আমার যাবতীয় অদ্ভুত আবদার ছিল ভাইয়ার কাছেই। আমি যখন কেজিতে ভর্তি পরীক্ষা দেই, তখন রমজান মাস ছিল। বাবা অফিসে, রেজাল্ট হয়েছে শুনে দুপুরের কাঠ ফাটা রোদের মধ্যেই রোজাদার মানুষটা বাইসাইকেল চেপে চলে গেল রেজাল্ট আনতে। আমাদের বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৮কিলোমিটার। ভাইয়া যখন রেজাল্ট নিয়ে ফিরে এলো, ওর মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। তারপরও মানুষটা আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল-“আমার বোন জীবনের প্রথম পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছে-আমিই আজ সবাইকে মিষ্টি মুখ করাবো।”
মনে পড়ে, ভাইয়া যতদিন আমাদের বাসায় ছিল, আমি ক্লাসে প্রথম হলেই ভাইয়া সবাইকে মিষ্টি খাওয়াত। জীবনে প্রথম (এবং শেষ) বারের মত ভাইয়াই আমাকে “মনিহার”-এ নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়েছিল। মুভিটার নাম ধাম সব ভুলে গিয়েছি... শুধু মনে আছে নায়ক ছিল ইলিয়াস কাঞ্চন, আর তার চরিত্র ছিল পুলিশ অফিসারের।
সেই ভাইয়াকে একদিন বলেছিলাম- “তুমি কোথাকার কে যে আমার ওপর শাসন ফলাচ্ছ?? আমাকে শাসন করার জন্য আমার আম্মু আব্বু আছেন।”ভাইয়ার অপরাধ- দুই ঘণ্টার ওপরে পুকুরে লাফঝাঁপ করায় ভাইয়া আমাকে বকা দিয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিল ভাইয়া সেদিন, আর আমার কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ হয়েছিল। আমি এখন কষ্ট পাই। ভাইয়ার কথা মনে হলেই এই কষ্টটা আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি জানি না ভাইয়া তুমি এই কথা মনে রেখেছ কিনা, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিজে কোনদিন ভুলতে পারব না। আমি তোমার খুব খারাপ বোন ভাইয়া, তাই তোমার স্নেহের ঋণ এমনি করে শোধ দিয়েছিলাম। যদি পারো, বোনটাকে ক্ষমা করে দিও ভাইয়া। বিশ্বাস করো, তোমার ছোট বোনটা এখন বুঝতে শিখেছে... সে সত্যিই অনুতপ্ত।
আমার বড় ভাইয়া(চাচাতো ভাই) আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। তারপরও ওর সাথে আমার ঝগড়া হত, মারামারিও লাগত, যদিও আমিই সব সময় হেরে যেতাম, আর চাচাসোনাকে নালিশ করে ওকে মার খাওয়াতাম। আমাদের এই রেষারেষির কারন ছিল গল্পের বই। দুইজনই বইয়ের পোকা ছিলাম, আর শখ ছিল লাইব্রেরি বানানোর।বই চুরি কি জিনিস আমি তখনও ভালো করে বুঝতে শিখি নি, ও বুঝত।আমি প্রায়ই দেখতাম আমার দুই একটা বই নাই হয়ে যেত,আর পরে পাওয়া যেত ওর ঘরে।একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি আমার “Round The World In Eighty Days” নেই।আমি সাথে সাথে রণমূর্তি ধারন করে সোজা ওর ঘরে চলে গেলাম।ওকে তখন টিচার পড়াচ্ছিল। সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না করে ওর চুল মুঠি করে ধরে ঠাশ ঠাশ দুই তিন চড়- “তুই চোর! তুই চোর!” চাচাসোনা ওকে খুব পিটিয়েছিল সেইদিন, আর আমাকে আম্মা। পরের দিন ওই বই এসে ফেরত দিয়ে গিয়েছিল আমার ফুপাত ভাই!!!
সেদিন বেশ রাতের দিকে বড় ভাইয়া ফোন করেছিল হঠাৎ-“তোর মনে আছে, গল্পের বই নিয়ে আমরা কত মারামারি করতাম! অথচ আজ দেখ তুই ও বাসার বাইরে, আমিও বাসার বাইরে... আর আমাদের বইগুলো হয়ত উইপোকা কাটছে!” কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল সেদিন... কী জানি নেই... একটা শুন্যতা... গলার কাছে এসে কান্নারা দলা পাকিয়ে গিয়েছিল...
আর আমার ফুপাত ভাই! ও ছিল অসম্ভব ট্যালেন্ট আর অসম্ভব পাজি। কিন্তু ও আবার আমাকে খুব বেশি স্নেহ করত... মনে হয় কাজিনদের মধ্যে ওই সবচাইতে বেশি স্নেহ করত আমাকে। ভাইয়ার সাথে মারামারির স্মৃতি নেই আমার, তবে ওর কথা মনে হলে যে স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, সেটা ২০০৫ সালের ঘটনা। ভাষা প্রতিযোগে আমি সেবার পুরস্কার পাই নি, ও হায়ার সেকেন্ডারিতে চ্যাম্পিয়ন। ওই দিন আবার আমাদের একটা দাওয়াত ছিল। আমি দাওয়াত খেতে যাব স্কুল ড্রেস পরে, অথচ পুরস্কার ছাড়া! কী লজ্জা! কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলাম।আমার কান্না দেখে ভাইয়া ওর টি শার্ট আর মেডেল পরিয়ে দিয়েছিল আমাকে। বই গুলো হাতে দিয়ে আদর করে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল- “আমি সবাইকে বলব তুই পুরস্কার পেয়েছিস। তুই যেন আবার কাউকে বলে দিস না গাধা!”
ভাইয়ার সেই বই, সেই মেডেল আর টি শার্ট আমার কাছে সযত্নে তোলা আছে, শুধু ভাইয়াটা আমার কাছে নেই। স্কলারশিপ নামক একটা জিনিস নিয়ে যান্ত্রিক পাখির ডানায় ভর দিয়ে উড়ে গেছে হাজার মাইল দূরে। আর আমিও যেন কেমন হয়ে গেছি... আবেগ গুলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে বন্দি... ফেসবুক বা ইয়াহুতে মেসেজ- “মিসিং ইউ ভাইয়া। কেমন আছিস?”
তোদের কাছে আমার অনেক ঋণ রে ভাইয়া। জানি ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না, তাই সেই চেষ্টাও করি না কখনো। শুধু যতটুকু পারি তোদেরকে ভালোবেসে যাই। বিশ্বাস কর ভাইয়া,সত্যি তোদেরকে খুব ভালোবাসি আমি। খুব মিস করি তোদের, খুব বেশি মিস করি তোদের সাথে খুনসুটি গুলো, ঈদের দিন সকালে তাড়া করে সালাম করা আর দুই টাকা সালামির জন্য সারাদিনের ঘ্যানর ঘ্যানর। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস, বড় না হলেই বোধ হয় ভালো হত। সারাটা জীবন তোদের স্নেহের ছায়াতেই থাকতে পারতাম! ভাইয়া, ওই দেখ, আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠল। জানিস তো,
চাঁদমামা আজ বড্ড একা বড় হয়েছি আমি
রোজ রাতে আর হয়না কথা হয়না নেয়া হামি
রোজ রাতে আর চাঁদের বুড়ি কাটেনা চরকা রোজ
ও বুড়ি, তুই আছিস কেমন হয়না নেওয়া খোঁজ
কোথায় গেলো সে রুপকথার রাত হাজার গল্প শোনা
রাজার কুমার, কোটাল কুমার, পঙ্খীরাজ সে ঘোড়া
কেড়ে নিলো কে সে আজব সময় আমার কাজলা দিদি
কে রে তুই, কোন দৈত্যদানো সব যে কেড়ে নিলি
কেরে তুই, কেরে তুই সব সহজ শৈশবকে
বদলে দিলি কিছু যান্ত্রিক বর্জ্যে
যত বিষাক্ত প্রলোভনে আমায় ঠেলে দিলি
কোনো এক ভুল স্রোতে।।
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন