দুঘণ্টার বেশি হয়ে গেল লাবণ্য শুয়ে আছে। ঘুম আসে না কিছুতেই। পাশেই মামাতো বোনটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। লাবণ্য আটষট্টিতম বারের মত পাশ ফিরে শোয়। সেলফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখে আবারও- রাত তিনটা ছাব্বিশ।
কিছুতেই সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না ও— কী করা উচিত ওর?ও কি ফোনটা করবে সজীবকে, নাকি করবে না!বিবেক বলে- “কোনও দরকার নেই। যে তোমাকে ফেলে এইভাবে চলে গেল, যে তোমার এতটুকু খোঁজ খবর নেয় না, কেন তুমি তার জন্য আকুল হবে? হোক না আজ একটা বিশেষ দিন… দেখো তার হয়ত মনেই নেই। সে ত তার জীবন সাজিয়ে নিয়েছে নিজের মত করে, তুমি কেন এতদিন পরে আর তাকে বিরক্ত করতে যাবে? চুপচাপ শুয়ে থাকো এবং ঘুমিয়ে যাও।” আবেগ তখন কথা বলে ওঠে- “ছেলেবেলার স্মৃতি গুলো তুমি ভুলে গেলে? তোমাদের পরিচয়, বন্ধুত্ব, স্কুল পালানো আর হাত ধরে হাঁটার দিনগুলো? ও না হয় ভুলে গেছে, তুমি তো ভোলোনি,তাহলে তুমি কেন ফোন করবে না? আজ তোমরা প্রথম একে অপরকে ভালোবাসি বলেছিলে… এখনও তো তুমি তাকে ভালোবাসো… তাহলে কীসের এত দ্বিধা তোমার? সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ফোন করো ওকে, শুভেছা জানাও।”
আবেগ আর বিবেকের বিতর্কে বিভ্রান্ত লাবণ্য আবার সেলফোন হাতে নেয়, সময় দেখে- তিনটা ঊনপঞ্চাশ। ওর আঙ্গুলগুলো আনমনে ডায়াল করে বসে ০১৭১৯******…
“হ্যালো!”বিরক্তি মাখা ঘুম জড়ানো কণ্ঠ সজীবের। প্রায় বছর খানেক পর ওর কণ্ঠ শুনে লাবণ্য আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না… দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ফোয়ারা নেমে আসে, গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকানো… একটা শব্দও বের হয় না মুখ দিয়ে। ফোনের ওপাশে সজীব-“হ্যালো! হ্যালো! কথা বল বন্নি। হ্যালো! কথা না বললে এত রাতে ফোন করলি কেন? হ্যালো! হ্যালো!…” বিরক্ত হয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয় সজীব।
লাবণ্য উঠে বসে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে আঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে,প্রাণ খোলা কান্না। আজ আর কেউ বাধা দেবার নেই। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কেউ আর বলে না, “তোর চোখ দিয়ে আর এক ফোঁটাও যদি পানি পড়ে, আগামী তিনদিন আমি না খেয়ে থাকব।” হঠাৎ কেন যেন লাবণ্যর মনে পড়ে যায় জুন মাসের সেই রাতটির কথা। প্রচণ্ড গরম… তাই জানালা দরজা সব খোলাই ছিল। সামনে ভর্তি পরীক্ষা। ঘুমাতে প্রায়ই গভীর রাত হয়ে যেত ওর। সেদিনও অনেক রাতেই বিছানায় গিয়েছিল।কিন্তু ঘুম আসছিল না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল ও। চাঁদের রহস্যময় আলোয় সব কিছু কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছিল। হঠাৎ করে আমগাছের ছায়াটা কেমন যেন অশরীরী মনে হয় ওর। গা ছম ছম করে ওঠে। পাশ ফিরে শোয় ও। আর হঠাৎ করেই মনে হয়, সজীব যেন ওর পাশে, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, “ভয় কীরে পাগলী, আমি আছি না!”
ধড়মড় করে উঠে বসেছিল লাবণ্য। কেন যেন ওর ভিতরটা তখন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। বার বার শুধু মনে হচ্ছিল সজীব ওকে ছেড়ে চলে যাবে। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। আর লাবণ্য কেঁদেছিলও সেই রাতে – ঠিক যেমন করে কাঁদছে আজ রাতে। পরদিন তাই খুব ভোরে বাসার অন্য সবাই ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগেই চুরি করে আম্মুর সেলফোনটা নিয়ে ছাদে চলে গিয়েছিল লাবণ্য, আর সেলফোনের ওপাশে ছিল সজীবের নিষ্প্রাণ কণ্ঠ- “বন্নি, কাল সারা রাত আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি।অনেক ভেবে দেখলাম,আমি পারব না। আমাকে তুই মাফ করে দিস। I am sorry….”।আর কিছু শুনতে পায়নি লাবন্ন।অর চোখ তখন ঝাপসা… মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবী যেন দুলছে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই গড়িয়ে পড়েছিল সিঁড়ি বেয়ে।
মাথা আর কোমরের ব্যাথা আজও ভোগায় লাবণ্যকে, যেমন ভোগায় সজীবের সাথের স্মৃতিগুলো। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে যায়… ফজরের আজান ভেসে আসে… নামাজের পাটিতে বসে লাবণ্যর মোনাজাতে একটি আকুতিই ঝরে পড়ে… “খোদা, আমার মনটাকে তুমি শান্ত করে দাও প্লিজ।”
পত্রিকার লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:৫৯