somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৩৫ বছর পর // শেখ রেহানা

১১ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩৫ বছর পর
শেখ রেহানা

প্রকৃত প্রাপকের কাছে সে চিঠি পৌঁছেনি। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর খেলা, পঁয়ত্রিশ বছর আগে আব্বা মা- ভাই-ভাবীদের কাছে যে চিঠি লিখেছিলাম আজ সেই চিঠিগুলো আমাকেই খুলতে হলো। চিঠিগুলো জার্মানি থেকে লেখা। খামের মুখ বন্ধ। ডাকপিয়ন তারমতো করে যথারীতি ডাকবাক্সে রেখে গিয়েছিল। চিঠিগুলো আপা যখন বত্রিশ নম্বর থেকে আমার হাতে এনে দিলেন, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। বুকের ভেতরটা কষ্টে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল। আমার হাতের লেখা আমাকেই পড়তে হলো। এই চিঠিগুলোর পরিবর্তে যদি সেই প্রাণপ্রিয় মানুষগুলো ফিরে পেতাম। আল্লাহ তো কত কিছুই করতে পারেন। আমার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমন চমকপ্রদ ঘটনা কি কখনও ঘটতে পারে? এতো বছর ধরে তো দেখছি, জীবনের একটা বড় সময় চলে গেলো। চোখ দুটো এখনও প্রিয়জনদের খোঁজে। দু'চোখে অশ্র", কষ্ট, অস্থিরতা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দুই বোন সাহস সঞ্চয় করে খামটা খুলে চিঠিগুলো পড়লাম। ওই কিশোরী বয়সে লেখা চিঠিগুলোয় আমার মনের কথাগুলো তুলে ধরেছিলাম। ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে আসে। বনে মরহুম রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় বেড়াতে গেলে তার হাতে চিঠিগুলো খামে ভরে দিয়েছিলাম। তিনি এগুলো ঢাকায় বত্রিশ নম্বরের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন। ধূলায় মলিন হয়ে গেছে কাগজের পাতা, লেখার কালিও ঝাপসা। কিন্তু অক্ষরগুলো আমি ঠিকই পড়তে পারলাম।
আব্বা-মায়ের কাছে কত আবদার, বিদেশ যাবার সময় ছোট্ট রাসেলের ফরমায়েশ, নতুন ভাবীদের নিয়ে মজা করবো ফিরে এসে। নতুন পরিবেশে যাতে ওদের কোনো সমস্যা না হয়। আমি দেশে ফিরে সব সমাধান করে দেব। আব্বার কাছে জার্মানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে গিয়ে তার প্রিয় সোনার বাংলা যে কোনো অংশে কম নয়, প্রাচ্যের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করা যায় সেকথাও লিখতে ভুলিনি। আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আব্বা বেশি চিন্তা করতেন। আমি যে লক্ষ্মী মেয়ের মত সব ঠিকমত খাচ্ছি সেটাও জানাতে ভুল করিনি, যাতে পড়ে তিনি খুশি হবেন।
ছোটখাটো সব ধরনের খবর দিয়ে মাকে চিন্তা করতে নিষেধ করেছি। আমি সব ধরনের কাজ করতে পারি সেটাও লিখেছি। জয় ও পুতুলের জন্য মা যেন কোনো চিন্তা না করে। ওরা আমার সব কথা শুনতো- তাই যেন চিন্তা না করে। বড় ভাবীকে লেখা স্বপ্নের শহর প্যারিস যাবো জানাতে পেরে একটা রোমাঞ্চ ছিল আমার মনে তখন। তার বিয়ের সময় তোলা রঙিন ছবিগুলো বিদেশে ওয়াশ করে কেমন হয়েছে তাও জানিয়েছিলাম। কেননা ঢাকায় তখন রঙিন ছবি ওয়াশ হতো না। জামাল ভাইকে লিখি- আমরা যখন Karlsruhe শহরের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলাম; এটা দেখে এতো মুগ্ধ হই যে, তাকে জানাই- আব্বার যদি টাকা থাকতো ও অনুমতি পেতাম তাহলে আমিও এখানে লেখাপড়ার জন্য থেকে যেতাম। ভাগ্যের নির্মম নিষ্ঠুর পরিহাস আমার বিদেশ থাকার ইচ্ছা পূরণ হলো এমনভাবে যে আব্বা ও মায়ের অনুমতির প্রয়োজন হলো না। পঁচাত্তর থেকে পরবাসেই রয়ে গেলাম। বাবা - মা ছাড়া নিরাপদ ও আনন্দময় আশ্রয় আর কে দিতে পারে? পরবাসে দিন কাটাতে হলো জীবনযুদ্ধ করে। দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ও বঞ্চনা কত ধরনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয় তাও জেনে গেছি।

মাকে লিখেছিলাম বন থেকে ১১.৮.১৯৭৫ তারিখে।
".....পুতুলী অনেক কথা বলে। আব্বা ও তুমি কেমন আছ? আমি এখন অনেক কাজ করি। তোমার জন্য অনেক জিনিস কিনতে ইচ্ছে করে। সুন্দর সুন্দর জিনিস। কামাল ভাইয়ের বিয়ের পর এটাই প্রথম জন্মদিন। সুন্দর একটা প্রেজেন্ট দিও। দুলাভাইয়ের কাজ করে ১ মার্ক পেয়েছি। কালকে বেশি কাজ করলে ৫ মার্ক দেবে।"
আব্বাকে চিঠি লিখি Karlsruhe থেকে ৫.৮.১৯৭৫ তারিখে।
"আব্বা,
আমার সালাম নেবেন। আপনি কেমন আছেন। আমরা ভালো আছি। Karlsruhe খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু অসম্ভব গরম। গত রবিবার ব্ল্যাক ফরেস্ট গিয়েছিলাম। কিন্তু আব্বা জানেন, রাঙ্গামাটি থেকে খুব একটা পার্থক্য বুঝলাম না। এখানকার লোক খুব ভদ্র ও ভালো। আমি অনেক কাজ করি। দুধ খাই, খাবার ঠিকমত খাই। আজকে কামাল ভাইয়ের জন্মদিন। দোয়া করবেন। আপনার স্নেহের রেহান।"
কামাল ভাইকে লিখি বন থেকে।
"কামাল ভাই,
কেমন আছ? আমি ভালো আছি। ভাবী যা বলে শুনবে। দোয়া করো। স্নেহের রেহান"।
বড় ভাবী সুলতানা কামালকে চিঠি লিখি বন থেকে।
"বড় ভাবী,
আমার সালাম নিও। কেমন আছ। তোমাকে আগেও চিঠি দিয়েছি। কালকে বনে এসেছি। এখানে গরম ঢাকার মতো। অবশ্য আজকে বৃষ্টি হয়েছে। তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে। তোমার ফটোগুলো সুন্দর উঠছে। আমার ক্যামেরা পুতুলী নষ্ট করে দিয়েছে। তাই ফটো ওঠাতে পারছি না। মন খুব খারাপ। আমরা যে জায়গায় থাকি খুবই সুন্দর। ছোট্ট শহর। বাসা থেকে দোকানের রাস্তাটা ঠিকই চিনে ফেলেছি। তোমার কথা খুব মনে হয়। গতকাল কোলন গিয়েছিলাম। ওটাও খুব সুন্দর শহর। খুব ভালো লেগেছে। .....আজকে জাহাজে যাবো। মঙ্গলবার আমস্টারডাম। তারপর যাবো ব্রাসেলস এবং তারপর যাবো প্যারিস - আমার স্বপ্নের দেশ। দুই বউতে আব্বা-আম্মার সব আদর নিও না। নীচে ঠিকানা দিচ্ছি চিঠি দিও। আমার সালাম নিও। ইতি রেহানা।"
জামাল ভাই ও রোজীকে চিঠি লিখি বন থেকে।
"জামাল ভাই ও রোজী,
কালকে বনে এসেছি। আজকে কলোনে গিয়েছিলাম। আজ এখানে বৃষ্টি হয়েছে। ডলির বিয়েতে কেমন মজা করলে। চিঠি দিও। চিঠি পেলে খুব খুশি লাগে। তোমার বন্ধুদের সাথে কথা হয়েছে। তারা তোমার বিয়ের গল্প শুনতে চায়। Karlsruhe ফিরে তোমাকে ফোন করবো। চিঠি দিও। রেহানা"
রাসেলকে চিঠি লিখি ট্রিবার্গ থেকে ৩.৮.১৯৭৫ তারিখ।
"রাসুমণি,
আজকে আমরা Triberg গিয়েছিলাম। এটা জার্মানির সবচেয়ে বড় ঝর্না। অনেক উপরে উঠেছিলাম। এদের ভাষায় বলে Wasserfalle । আজকে ব্ল্যাক ফরেস্ট গিয়েছিলাম। ......পড়াশুনা করো। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করবে। মা'র কথা শুনবে। তোমার জন্য খেলনা কিনবো। লন্ডনের চেয়ে এখানে অনেক দাম। ছোট্ট ছোট্ট গাড়িগুলো প্রায় দুই পাউন্ড দাম। তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া ও পড়াশুনা করো। ইতি রেহানা আপা।"
এই চিঠির অক্ষরগুলো যেন আমার মনের সঙ্গে কথা বলে। মনে মনে ভাবি মা কী উত্তর দিতো। দেশে ফিরলে কত কথা শুনতে চাইতো। আব্বা কী উপদেশ দিতেন। ভাই ও ভাবীরা কত মজা করে উত্তর দিতো। রাসেল খেলনা পেলে কী খুশি হতো! এখন এই চিঠিগুলো আমার কাছে তাদের স্মৃতিময় সম্পদ। এ বড় কষ্টের, এ বড় বেদনার।
৯.৮.২০১০

বিডি নিউজ ২৪ থকে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:০৩
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঠকানোটাই ভাল শিখেছি আমরা

লিখেছেন ফেনা, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৭



এই বিশাল মহাকর্ষীয় বস্তু সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়—এমনকি আলোও পালাতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতরে কী ঘটে? সেখানে সময় ও স্থান কেমন আচরণ করে? এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরব বিশ্বে নারীরা অপমানিত? আমার অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬



বহুদিন ধরে একটি কথা শুনে আসছি—“নারীরা আরব দেশে অসম্মানিত অবস্থায় থাকে।”
কিন্তু আমি আরব দেশে গিয়েছি, থেকেছি, এবং প্রায় দুই মাস ধরে একাধিক জেলায় ঘুরেছি।
সত্যি বলছি—আমি সেখানে কোথাও নারীদের অসম্মানিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা : অরাজকতার পালে নতুন হাওয়া!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:০৩


বাংলাদেশে আজকাল দাবি না জানালে কেউ আর মানুষ থাকে না—ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, পুলিশ, পিয়ন, কবি, কুস্তিগির, সবাই 'অধিকার' চায়। তবে অধিকার মানে এখানে মোটেই দায় বা কর্তব্য নয়, বরং ছিনিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্পা এবং দেহ ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে রেগে যাবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৪৯



পুরো পৃথিবীতে স্পা এর সংখ্যা ১ লক্ষ ৮১ হাজার। এইসব স্পা-গুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ইউরোপে। এশিয়া - প্যাসিফিকের দেশগুলোতেও স্পা-এর সংখ্যা কম নয়। ৫১ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে স্পা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মিরর ডোল, নিজের মনের অশান্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩৫

ব্লগার মিরর দৌলাকে বলছি।
আপনাকে কিছু কড়া কথা আজ বলবো। ব্লগে বর্তমানে আপনার কোন অবদান নেই। সামুর যে ব্লগপেইজটা আপনি চালান, সেখান থেকে সব পোষ্ট আপনি ড্রাফটে নিয়েছেন। সেটা আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×