আগের দুটো এখানে
প্রথম পর্ব
Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব
Click This Link
পুতুল নাচের ইতিকথা’র কুসুমঃ
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আরো একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।আর এই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র পরাণের স্ত্রী তেইশ বছরের বাঁজা মেয়ে কুসুম।প্রকৃ্তপক্ষে কুসুম এক অস্থির, বেপরোয়া,ও দূর্বোধ্য গ্রাম্য রমণী।পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে লেখক কুসুমের মৃতপ্রায় অস্তিত্বের এক ভিন্ন রূপ উন্মোচন করে নারী সম্পর্কে আমাদের আবহমান ধারনাকে ভেঙ্গে দিয়ে এক নতুন ধারনার জন্ম দেন।এই উপন্যাসে কুসুম শুধু একজন নারীই নয়,অসম্ভব প্রানবিহ্বল,মনোদৈহিক কামনা বাসনার অন্তর্দহনে জ্বলমান এক বিমূর্ত রূপ।যার কাছে দেহ ও মনের দাবী সমানভাবে মূল্যবান।কুসুম তার মনোদৈহিক আকাংক্ষার পরিপূর্নতার জন্য সমাজের প্রচলিত সংস্কারকে ভেঙ্গে দিতেও ছিলো দ্বিধাহীন।আর তাইতো গাওদিয়া গ্রামের একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত কুসুমের অন্তঃপুর নতুনভাবে জেগে উঠে গ্রামের সুদখোর মহাজন গোপালের কলকাতা ফেরত ডাক্তার ছেলে শশীর আবির্ভাবে।মনের গভীর কোনে কুসুম শশীর জন্য লালন করে গভীর প্রনয়।কুসুম তাই সামাজিক নিয়তি আর নারীর সহজাত ভীরু অস্তিত্বের দ্বিধাকে অস্বীকার করে অকপটে প্রকাশ করে তার ভালোবাসার কথা।কিন্তু শশীর নিস্পৃহতা,তার নিরবলম্বভ ব্যাক্তিত্বের নিষ্ক্রিয়তা কুসুমকে আশাহত করে।তাই সব ছেড়েছুড়ে নিজের জৈবিক ট্র্যাজেডিকে ভুলে কুসুম যখন স্বামীর সাথে গাওদিয়া ছেড়ে চলে যেতে চায়,তখনই একা আর পরাজিত শশী তার প্রেমের মহার্ঘ্য নিবেদন করে কুসুমের কাছে।কিন্তু তাতানো লোহার মত কুসুম তখন একেবারেই ঠান্ডা।তাই কুসুম বলে-
-চিরদিন কি একরকম যায়??মানুষ কি লোহার গড়া যে সে চিরদিন একরকম থাকবে,বদলাবে না?বলতে বসেছি যখন তখন কড়া করেই বলি,আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাবোনা।আপনি কি ভেবেছিলেন আপনার সুবিধামতো সময়ে আমাকে ডাকবেন আর আমি চলে আসবো?
মানিক বন্দোপাধ্যায় সর্বদাই তার রচনায় মানুষের বিশেষ করে নারীদের মনোজাগতিক চিন্তাকে উন্মোচিত করেছেন।এই ক্ষেত্রে কুসুমও তার ব্যতিক্রম নয়।পৃথিবীর জৈবিক দৈহিক অভিঘাত কুসুমের অন্তর্দেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তার বাস্তব রূপায়নই কুসুমের অস্তিত্বকে এক কম্পলেক্স প্রোজেকশনে রূপ দিয়েছে।
দেবদাস এর চন্দ্রমুখীঃ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য লেখক এ কথা অনস্বীকার্য।তার প্রত্যেকটি লেখা আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি।দেবদাস আমি প্রথম পড়েছি ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়।তখন এত কিছু বুঝিনি।বড় হয়ে সিনেমা দেখলাম,বাংলা, হিন্দি,তামিল,আরো কত ভাষায়!!সিনেমাতে অনেক কিছুই বেশী বেশী ছিলো যা মূল উপন্যাসটিতে নেই।তারপর ও ভালো লেগেছে।যেহেতু মূল উপন্যাসটি অনেকদিন আগে পড়া সেহেতু বেশী কিছু হয়তো লিখতে পারবোনা এ নিয়ে।
এই উপন্যাসের চন্দ্রমুখী চরিত্র আমার কাছে পার্বতীর চেয়ে বেশী ভালো লেগেছে।পার্বতীর কারনে দেবদাস রাস্তায় নেমেছে আর চন্দ্রমুখী দেবদাসকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে।চন্দ্রমুখী এক রূপবতী,মায়াময়ী,ভালোবাসার অনুরাগী এক নারী।দেবদাসের প্রতি যার ছিলো অপরীসীম ভালোবাসা।নিষ্পাপ,আর নির্মোহ ভালোবাসার গভীর সমুদ্রে অবগাহন করে চন্দ্রমুখী নিজেকে নতুন করে চিনতে পেরেছিলো।বাঈজীর কাজ ছেড়ে দিয়ে এক ভক্ত অনুরাগীর মত দেবদাসের সেবাযত্নে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে সে।দেবদাসের সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ধন ,দৌলত ,রূপ যৌবন এ সবকিছুই ছিলো চন্দ্র’র হাতের মুঠোয়,চাইলেই সে হাত বাড়িয়ে নিতে পারতো অনেক কিছু।তারপরও এই যশ-জৌলুশ সব কিছু ধুলোয় মাড়িয়ে চন্দ্র দেবদাস কে হৃদয়ে ধারন করে যার ভালোবাসা সে কোনদিনই পাবার নয়।তবুও দেব কে ভালোবেসে সে নিজেকে ধন্য মনে করতো।চন্দ্রমুখী চরিত্রের এই গভীরতা ,তার ভালোবাসার ব্যাপকতা,তার ত্যাগ এই সবকিছুর জন্যই পার্বতীকে ছাড়িয়ে চন্দ্রমুখীই হয়ে উঠেছিলো দেবদাসের নায়িকা।
সূবর্নলতা’র সূবর্নঃ
আশাপূর্না দেবীর বিখ্যাত একটি ত্রিলজী হচ্ছে,প্রথম প্রতিশ্রুতি,সূবর্নলতা আর বকুলকথা।এর মধ্যে সূবর্নলতাই জনপ্রিয় বেশী।এই উপন্যাসটি আমি যখন পড়েছি, এর মধ্যে হারিয়ে গেছি।কয়েকদিন মাথায় শুধু সূবর্নই ঘুরতো।সূবর্নর স্থানে নিজেকে কল্পনা করতে বেশ লাগতো তখন।
সূবর্নলতা শুধু সূবর্ন’র জীবনের গল্পই নয়।এটা একটা সময়ের গল্প,যে সময়টা চলে গেছে কিন্তু তার ছায়া আমাদের উপর, আমাদের মনে প্রানে,আমাদের সমাজে রয়ে গেছে।সূবর্নলতা এক অসহায় বন্দী আত্মার কান্নার গল্প।সময়ের সাথে এক অসহায় একাকী নারীর সংগ্রামের গল্প।এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রই হচ্ছে সূবর্ন,মাত্র নয় বছর বয়সে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ীতে এসেছিলো সূবর্ন।ছোটবেলা থেকেই সূবর্ন খোলা মনের মুক্ত চিন্তাধারার মেয়ে,যে সবসময় নিজেকে সবরকমের কুসংস্কার আর অর্থোডক্স মনমানসিকতা থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলো।কিন্তু রক্ষনশীল শ্বশুরবাড়িতে এসে সুবর্নর সেই সব ইচ্ছা প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে চূর্ন-বিচূর্ন হয়।শ্বশুরবাড়ীর রীতি-নীতি আর নিয়ম কানুনের যাতাকলে সূবর্নর আত্মপরিচয়ই চাপা পরে যায়।একটুখানি খোলা বারান্দার জন্য তাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সাথে।তাই নিজের আত্মমর্যাদা আর আত্মপরিচয়ের জন্য সূবর্ন একাই পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে।মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামের আত্মকথনেরই আরেক নাম সূবর্নলতা।
চোখের বালি’র বিনোদিনীঃ
চোখের বালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অনবদ্য সৃষ্টি।তিনিই প্রথম সামাজিক উপন্যাসে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষন প্রবর্তন করে উপন্যাস শিল্পকে বাস্তবধর্মী করে তুলেন,আর চোখের বালি এরই এক অনবদ্য প্রয়াস।বিনোদিনী-আশা-মহেন্দ্র আর বিহারীর মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য।বিনোদিনী এই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র।বিনোদিনী অগ্নিশিখার মত উজ্জ্বল,আত্মমর্যাদার অধিকারী এক নারী।সেই আগুনের শিখা ঘরের প্রদীপরূপে জ্বলে আবার ঘরে আগুনও ধরিয়ে দেয়।মহেন্দ্র কে সর্বদাই জয় করতে চেয়েছে,আর তার এই চাওয়াই মহেন্দ্র আর আশার সংসারে জটিলতার সৃষ্টি করেছে।আবার সেই বিনোদিনীই যখন মহেন্দ্র কে জয় করে সদর্পে সংসার করতে পারতো,নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারতো ,তখনই রাজলক্ষীর দেয়া হাজার টাকার নোট আর জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে কাশীতে চলে যায় বিনোদিনী।নিজে জীবন বঞ্চিতা হয়েও আশা আর মহেন্দ্রকে ফিরিয়ে দিলো সুখের সংসার।বিনোদিনীর অন্তর-নৈঃসঙ্গ্য ও বহুভূজ মানসিক জটিলতা,সংযম-আসংযমের আত্মপীড়ন তদুপরী রাজলক্ষীর ঈর্ষা বিনোদিনীকে নিষ্করুন পরিনতির দিকে ঠেলে দেয়।মূলত বিনোদিনীর ব্যক্তিচরিত্রের সংঘাত-উত্থিত দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণা,অসংযমের আত্মপীড়ন, আশ্রিতা হিসেবে লাঞ্ছনা আর বেদনার গল্পকথনই চোখের বালি উপন্যাসকে উপন্যাস হিসেবে শিখরে পৌছিয়েছে।
অ.টঃ
আরো বেশ কয়েকজনকে নিয়ে গুছিয়ে লিখতে চেয়ছিলাম।কিন্তু হলনা। অনেক উপন্যাস এখনো পড়াই হয়নি।না পড়ে কিভাবে লিখি?? আগে সবগুলো পড়ে নেই তারপর দেখি আরো কিছু লেখা যায় কিনা। আপাতত এটাই শেষ।সবাইকে ধন্যবাদ কষ্ট করে আমার এসব হাবিজাবি লেখা পড়ার জন্য।