দেখতে দেখতে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০ প্রায় শেষ হয়ে এলো। মোটে আর দুটো খেলা বাকি, যার একটি নিয়ে কারোই কখনো কোন আগ্রহ থাকে বলে মনে হয় না। এই সিরিজের শেষ আলোচনাটা আজ করছি।
হল্যান্ড-ব্রাজিলের খেলার দিনে, মানে ব্রাজিলের হোচট খাওয়ার দিনে জার্মানির সমর্থক এক বড় ভাই খুশীতে ডগমগ হয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল "অলঅয়েজ লাভার অব ইউরোপিয়ান ফুটবল"! লাতিন সুন্দর ফুটবলের ঘোর সমর্থক হিসাবে আমার কিছু দুর্নাম আছে, তাই হয়তো তিনি ঐ ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন। আমিও হেসে জানালাম, "অলওয়েজ ডিসলাইকার অব ইউরোপিয়ান বোরিং ফুটবল" এবং সেমিফাইনালে স্পেনের চোখ জুড়ানো খেলাটার পরে উপলক্ষ আসলো এবং জানালাম "অলওয়েজ লাভার অব লাতিন ফুটবল"।
ইউরোপিয়ান ফুটবল আর লাতিন ফুটবল বলতে আমি বুঝি দুটো ভিন্ন ঘরানার ফুটবল। একদিকে 'আগে ঘর সামলাও ও তারপরে পারলে কাউন্টার এটাকে গোল করে আসো ও সেই গোল/ লিড ধরে রেখে খেলা শেষ করো' এবং অন্যদিকে 'আক্রমণ, আক্রমণ ও আক্রমণ, ডিফেন্স? অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স- প্রথম থেকেই বলের দখল নিয়ে নাও এবং হামলে পড়ো বিপরীত দুর্গে"। একদিকে রক্ষনাত্মক ও বোরিং ফুটবল, আরেকদিকে আক্রমণাত্মক সুন্দর ফুটবল। এবারের দুঙ্গার ব্রাজিল তাই কোনমতেই লাতিন ফুটবল খেলেনি, সে খেলেছে ইউরোপিয়ান বোরিং ফুটবল (গ্রুপ পর্বের ২য় ম্যাচ ও কোয়ার্টার ফাইনালের ১ম ১৫ মিনিট ছাড়া)। আর, অন্যদিকে এবারের স্পেন টিম লাতিন ফুটবলের অনুপম পসরা সাজিয়ে বসেছে। এই দলের খেলা কেবল মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে থাকতে হয়। থেকেছিও।
তবে, সাথে এটাও এবারে স্বীকার করতে হচ্ছে- জার্মানীর খেলা এবার আমার ভালো লেগেছে। শুরুতে ভেবেছিলাম এবারের কাপ নিবে স্পেন, কিন্তু বাকি তিন সেমি ফাইনালিস্ট হবে ব্রাজিল-উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের হারটা আগে কল্পনাও করতে পারিনি, তবে জার্মানী-ইংল্যান্ডের খেলা দেখার পর থেকেই বুঝতে পারছিলাম স্মরণকালের সবচেয়ে জঘণ্য ডিফেন্স নিয়ে আর্জেন্টিনা জার্মানীর কাছে নাস্তানাবুদই হবে। বাজ্জিওর আমলের ইতালীর পর এইরকম ক্ষিপ্র কাউন্টার এটাক করতে পারা ফরোয়ার্ড দেখলাম জার্মানী দলে। দলটাকে আমার পছন্দ হয়েছে, শারীরিকভাবে সমর্থ, ব্যক্তিগত স্কিলও কয়েকজনের বেশ ভালো। বয়সও কম। সামনেরবার এরা আরো পরিণত হবে এবং ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানীর ভালো সম্ভাবনা দেখছি। আফসোস- এরা লাতিন ঘরানার আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে না! পুরো সামর্থ্যই এদের আছে, খেললে যে কি হতো!!!
মেসির জন্য একটু আফসোস হচ্ছিল, জেনেত্তি-কাম্বিয়াসোদের বাদ দিয়ে এমন ফালতু ডিফেন্স গড়াতেই তো মেসির জাদুটা আর এক-দু ম্যাচ বেশী দেখা হলো না! তবে ম্যারাডোনা যেমন কিম্ভুত দলই গড়ুন না কেন- বিশ্বকাপে কোচ হিসাবে আমি তাকে লেটার মার্কই দিবো। খেলোয়াড়দের বুকে জড়িয়ে নেয়া- আদর করা, ভালো লেগেছে। টিম ফরম্যাট, আক্রমণাত্মক স্টাইল এসবও ঠিক ছিল। কাউন্টার এটাক ঠেকানোর মত ডিফেন্সটা যদি থাকতো- তবে স্পেনের মতই একটা দল হয়ে উঠতো।
আগের পোস্টে বলেছিলাম- ব্রাজিলের ভাগ্যটা খুব ভালো- খুব সহজে ফাইনালে চলে যাবে। ঘটনাটা হল্যান্ডের জন্য হলো। আমি মনে করি এই হল্যান্ড টিমকে স্পেন তো বটেই, জার্মানী-আর্জেন্টিনাও হারানোর সামর্থ্য রাখে (ব্রাজিলকেও)। ফাইনালে স্পেন হল্যান্ডের জালে ১ বা ২ এর বেশী গোল হয়তো দিতে পারবে না, তবে জার্মানী হলে তো হল্যান্ডকে প্রায় ন্যাংটো হতে হতো- মানে ৩-৪ টা গোল খেয়ে ফাইনালে নাস্তানাবুদ হতে হতো!
দুঙ্গার বিদায় ব্রাজিলের জন্য এবং আমাদের মতো লাতিন সুন্দর (জোগো বনিতা) ফুটবলের সমর্থকদের জন্য সুখবর, সে হিসাবে ব্রাজিলের এমন লজ্জার বিদায় একরকম আশীর্বাদই। আশা করবো, লুসিও-সিজার ভিত্তিক দল না হয়ে ব্রাজিল অচিরেই রবিনহো-কাকা-পাতো নির্ভর দল হয়ে উঠবে। রবিনহোরা মাঝে মাঝে জোগো বনিতার যে ঝলক মাঠে দেখিয়েছিল - সেটাই হবে ব্রাজিলের আসল খেলা। লুসিও-সিজাররা থাকবে বিপক্ষ দলের হাতে গোনা কয়েকটা প্রতি আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্বে। সামনের বার যে লাতিন দেশেই বিশ্বকাপ! ফুটবলের দেশেই বিশ্বকাপ। লাতিনেই বিশ্বকাপটা থাকুক আর না থাকুক- চাইবো লাতিন ফুটবলের যাদুতে বিশ্ব মোহিত হয়ে যাক বিশ্বকাপ ২০১৪ এর আসর।
শেষে- ফাইনাল ম্যাচ। কিছু বলার নেই। স্পেনের খেলা দেখার জন্য বসবো। সুন্দর ফুটবল দেখার জন্য বসবো। গোল্ডেন বুট- গোল্ডেন বল দুটাই ভিয়া জিতলে খারাপ হয় না, এবারে সে অসাধারণ খেলেছে। তবে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে মুলার- ক্লোসা গোল করে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে ভালোভাবে আসতে পারে, বিশেষ করে ক্লোসার দুটো গোল খুব চাচ্ছি- রোনালদোর রেকর্ড ভাঙ্গার সাক্ষী হতে চাই। গোল্ডেন বলের জন্য দাবীদার আমার মনে হয় জাভিও। আমি জাভির অসম্ভব রকম ফ্যান। মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্য যার ফিফা বর্ষসেরা হ্ওয়াটা সম্ভব হচ্ছেনা - হয়তোবা হবেও না- কিন্তু বার্সাতে মেসি-জাভি জুটির খেলা যারা দেখেছেন- বুঝবেন জাভি কি জিনিস!
পরিশিষ্ট:
১। ব্রাজিল যেদিন হারলো- পরপরেই দেখি এলাকায় বড় মিছিল। হল্যান্ডের এত সাপোর্টার দেশে নাই বলে জানতাম। তাকিয়ে দেখি মিছিলের শ্লোগানে হল্যান্ডের "হ"-ও নেই। সবাই "ভুয়া"র সাপোর্টার। অনেক মজা পাইলাম।
২। এরপরে যখন আর্জেন্টিনা রীতিমত নাস্তানাবুদ হলো জার্মানীর কাছে- আগের রাতের চেয়েও মিছিল থেকে আওয়াজ জোরে শোনা গেল। যথারীতি কেউ জার্মানীর নয়- "ভুয়া"র সাপোর্টার। ব্রাজিলের সমর্থকেরা পুরো বিশ্বকাপে ঐ রাতেই সবচেয়ে আনন্দ করেছে বলে মনে হলো।
৩। আর্জেন্টিনার কিছু সমর্থককে আল্লাহ বিল্লাহ করতে দেখেছি। গোলের জন্য- মেসির জন্য- ম্যারাডোনার জন্য। ব্রাজিলের সমর্থকও মনে হয় অনেকে দোয়া দরুদ পড়েছেন। খ্রিস্টান-ইহুদীদের জন্য মুসলমানদের দরদ দেখে দারুন মজা পাইলাম। ভালো ভালো। কোরআনে কাফের-নাসারাদের তো মুসলামনদের আজীবন শত্রু হিসাবে উল্লেখ করা আছে বলেই জানতাম। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখি মুসলমানদের কোরআন ভুলিয়ে রাখতেও সক্ষম হচ্ছে!!!!
১ম পর্ব (Click This Link)
২য় পর্ব
(Click This Link)