“অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ” কবি শামসুর রহমান খুব যথার্থই বলেছিলেন। প্রতিটি জায়গায় তার প্রতিফলন। এই যেমন ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নিয়ে ব্যাংকারদের নাজেহাল অবস্থা। প্রথমেই আসি, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার উদ্ভব কবে এবং কেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬ সালে ইন্সিটিউিট অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ তৈরি হয়। তাদের হাত ধরেই সে বছরেই প্রথম ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দরকার হলো?
যুদ্ধ বিদ্ধস্থ দেশ, শিক্ষাহীন অবস্থা প্রায় ২-৩ বছর। সে সময় যারা নূন্যতম এসএসসি (ম্যাট্রিকুলেশন) পাশ করেছে তাদেরকেই ব্যাংকে নিয়োগ এর ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কারন ব্যাংক তো চালাতে হবে। কিন্তু ব্যাংকিং এর সাধারন জ্ঞানটুকুও না থাকার কারনে বিপত্তি দেখা দেয় অচিরেই। সেই বিপত্তি যাতে দ্রুত এড়ানো যায় এবং ব্যাংকিং সম্পর্কে কিছু সাধারন ধারনা নিয়ে কর্মকর্তা - কর্মচারীগন যেনো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন তাই ব্যাংকিং ডিপ্লোমার যাত্রা শুরু।
মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও এই ব্যাংকিং ডিপ্লোমার যৌক্তিকতা। কেবলমাত্র যৌক্তিকতা বললে ভুল হবে, বরং এখন তো বাংলাদেশ ব্যাংক এটাকে একরকম বাধ্যবাধকতার আওতায় নিয়ে এসেছে। ধরুন আপনি বিআইবিএম থেকে এমবিএম করলেন, লাভ নাই। আপনি বিবিএ, এমবিএ করলেন, লাভ নাই। আপনি ফাইন্যান্স এন্ড ব্যংকিং থেকেও অনার্স/মাস্টার্স বা পিএইচডি করলেন, লাভ নাই। আপনি ডিপ্লোমা তো করেন নাই। আপনার প্রমোশন হবেনা সে আপনি যতই তুখড় ব্যাংকার হন না কেন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমার ডিগ্রিটার এতো মর্যাদা যে পৃথিবীর যেকোন বিদ্যাপিঠের সার্টিফিকেটও এর সমতূল্য নয়। আবারো বলতে হয় “অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ”।
এবার আরো মজার জায়গায় আসি। ১৯৭৩ সালে যখন ব্যাংকিং ডিপ্লোমা চালু হল, কাদের জন্য চালু হলো? যারা স্বল্প শিক্ষিত বা ব্যাংকিং সম্পর্কে কম ধারনা রাখেন তাদের জন্য। আর এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের জন্য বাধ্যতামূলক করলেন? যারা ব্যাংকিং সম্পর্কে মোটামুটি সব জানেন তাদের জন। আর কাদের এই বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যহতি দিলো? আইটি - যারা ব্যাংকিং সফটওয়ার তৈরি করেন এবং যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে কোন ধারনা নাই, ল-অফিসার - যারা ব্যাংকের মামলা পরিচালনা করবেন, কিন্তু তারা জানেনই না কিভাবে একটা একাউন্ট ওপেন হয়, যা কিনা ব্যাংক ও গ্রাহকের সাথে প্রথম চুক্তির ডকুমেন্ট। আর ল-ইয়ার দের ব্যাংকিং জ্ঞান সম্পর্কে না হয় নাই বললাম, কারন সেটা ওনাদের পড়ার বা জানার আওয়াততেই ছিলনা। তাহলে দেখা গেল, যারা বিবিএ, এমবিএ, ফাউন্ডেশন ট্রেইনিং সব করে ব্যাংকিং করছেন তাদের জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক আর যাদের ব্যাংকিং জ্ঞ্যান নাই কিন্তু ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ন কাজে নিয়োজিত আছেন তাদের ব্যাংকিং ডিপ্লোমার কোন প্রয়োজন নই। কবি ঠিকই বলেছেন কবি - “অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ”।
মজার গল্প আরো শুনবেন? ব্যাংকিং ডিপ্লোমার কারিক্যুলাম আর পরীক্ষা বিষয়ক। ইন্সিটিটিউশন আছে, কিন্তু বই নাই, ক্লাস নাই, সিলেবাস নাই, কারিক্যুলাম নাই। কিন্তু সেই ইন্সিটিটিউশন এর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এটা ছাড়া প্রমোশন হবেনা। আর পরীক্ষা পাস করা আর রবার্ট ব্রুস এর গল্পকে হার মানানোর সমান কথা। একেকজন ১০ - ১২ বছর ধরে পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু কোন না কোন একটি সাবজেক্টে ফেল করছে। দুই পার্ট কোন ভাবেই শেষ হচ্ছেনা। ভাবছেন ছাত্র খারাপ। মোট্ই না। একাউন্টিং এ প্রথম শ্রেনীতে অনার্স - মাস্টার্স করে ৭ বছর ধরেও ডিপ্লোমার একাউন্টিং সাবজেক্টে ফেল করছে এমন নজিরও আছে। তারই খাতা দেখে হুবুহু লিখে তারই সতীর্থরা পাশ করছেন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পরীক্ষা এবং পাশের গল্প ব্যাংকারদের কাছে কৌতুক ছাড়া আর কিছুই না। ব্যাংকারদের ব্যাংকিং ডিপ্লোমার কথা জানতে চাইলেই হেঁসে বলেন, বাদ দেন ভাই, “অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ”।
আজ ব্যাংকিং খাত নিয়ে অনেক হৈচৈ হচ্ছে। কিন্তু শর্ষের মাঝেই যে ভুত তাকে কে তাঁড়াবে? প্রদীপের নিচের অন্ধকরা দূর করবে কে? যারা এসব নিয়ম তৈরি করে বাহাবা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাদের বুদ্ধির দিপ্ততা ব্যাংকিং ডিপ্লোমার মত ছোট ছোট সিদ্ধান্তের মাঝেই অনুধাবন করা যায়। আর তাদের হাতে ব্যাংকিং খাত কতটা নিরাপদ সেটা তো বলাই বাহুল্য। দিনে দিনে তো ব্যাংকিং খাতের কংকালসাড় অবস্থা তো প্রকাশ পা্চ্ছেই।
আসলেই “অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ”। মনে মনে ভাবি, তাও ভালো, এখনো উটের পিঠে আছি, গাধার পিঠে তো নাই। এই পরম শান্তি !!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১