ইব্রাহীম আ. কাকে যবেহের জন্য নির্দেশিত হয়েছিলেন, ইসমাইল নাকি ইসহাককে আ., সে প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। যদিও এক সামান্য ঘটনার কারণে এ প্রশ্নের জন্ম, তবু একটি ইমানী দায়িত্ব মনে করে, এটাকে সিরফ উড়িয়ে দেয়ার বিষয় মনে না করে সংক্ষেপে ব্যাপারটা খোলাসা করা ইচ্ছায় এ পোষ্টটি লিখলাম। আল্লাহ আমাদেরকে সন্দেহাতীত ইমান দান করুন। আমীন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে মাত্র এক জায়গায় ইব্রাহীম আ. এর জবেহের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কাজেই এই আয়াতকে সামনে রেখে অন্যান্য আয়াতকে পর্যালোচনা করতে হবে। প্রথমে চলুন আয়াতটি দেখে নিই:
সূরা সাফফাতের ৯৯-১১৩ আয়াতসমূহ :
(وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِينِ رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ). [الصافات:99-113].
সে বললঃ আমি আমার পালনকর্তার দিকে চললাম, তিনি আমাকে পথপ্রদর্শন করবেন। হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন। আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছি ইসহাকের, সে সৎকর্মীদের মধ্য থেকে একজন নবী। (সূরা সাফফাত : ৩৭:৯৯-১১৩)
এবার আসুন এই আয়াতের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
এক:
এই আয়াতে দুটো সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
১) ইব্রাহীম আ.স্বদেশ ছেড়ে যখন সিরিয়া চলে যান, তখন আল্লাহর কাছে একটি সৎ পূত্রসন্তানের জন্য দোয়া করেন। এই পূত্রকেই তিনি যবেহের জন্য নিয়ে যান, যা আমরা আয়াত থেকে বুঝতে পারি।
২) আরেকটি সন্তানের নবী হওয়ার সুসংবাদ।
এখানে সুসংবাদ দুটো কীভাবে হলো, তা বিস্তারিত বলার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। একটি সুসংবাদের আদ্যপান্ত বর্ণনার পরই যেহেতু আরেকটি সুসংবাদ আল্লাহ দিচ্ছেন, তাই স্বভাবতই আমরা বুঝে নিই যে, সুসংবাদ এখানে দুটো এবং ভিন্ন। নতুবা একই জায়গায় একই বিষয়ে দুই বার ‘আমি সুসংবাদ দিয়েছি’ বলার কোনো অর্থ হয় না। আর আল্লাহর কোনো কথা নিরর্থক নয়।
যাহোক, দ্বিতীয় সুসংবাদটা নিশ্চিতভাবেই ইসহাক আ. এর ব্যাপারে, কারণ আল্লাহ সেখানে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। কাজেই প্রথম সুসংবাদটা অবশ্যই ইসমাইল আ.এর ব্যাপারেই নির্দিষ্ট হবে। কারণ ইব্রাহীম আ. এর আর কোনো সন্তান ছিল না।
প্রথম সুসংবাদ ইসমাইল আ. এর ব্যাপারে নির্দিষ্ট হলে যবীহও তিনিই হবেন। কারণ প্রথম সুসংবাদটা যার ব্যাপারে দেয়া হয়েছে, আয়াতে যবেহের ঘটনা তাকে কেন্দ্র করেই বলা হয়েছে।
দুই:
ইসহাক আ. এর ব্যাপারে সুসংবাদ দিতে গিয়ে সূরা হুদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَامْرَأَتُهُ قَائِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِن وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ – قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ – قَالُوا أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۖ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ ۚ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَّجِيدٌ – فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ – إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُّنِيبٌ
তাঁর স্ত্রীও নিকটেই দাড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়াকুবেরও। সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এতো ভারী আশ্চর্য কথা। তারা বলল-তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুত বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময়। অতঃপর যখন ইব্রাহীম (আঃ) এর আতঙ্ক দূর হল এবং তিনি সুসংবাদ প্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি আমার সাথে তর্ক শুরু করলেন কওমে লূত সম্পর্কে। ইব্রাহীম (আঃ) বড়ই ধৈর্য্যশীল, কোমল অন্তর, আল্লাহমুখী সন্দেহ নেই। (সূরা হুদ : ১১:৭১-৭৪)
লক্ষ্য করুন, এই সুসংবাদ দেয়ার পূর্বে ইব্রাহীম আ. এর কোনো প্রার্থনা/দোয়া নেই। বরং, তাঁর স্ত্রীর বার্ধক্যজনিত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে এতে। আর এ সুসংবাদের অধীনে ইসহাক আ. এর পূত্র ইয়াকুব আ. এর জন্মের্ও সুসংবাদ আছে, যা সূরা সাফফাতে বর্ণিত প্রথম সুসংবাদে নেই। কাজেই সেই সুসংবাদের সাথে এই সুসংবাদের দ্বৈত্য স্পষ্ট।
আর এই সুসংবাদে যেহেতু ইসহাক আ. এর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কাজেই সূরা সাফফাতের সুসংবাদটি ইসমাইল আ. এর ব্যাপারেই নির্দিষ্ট হয়ে গেল। ফলে, যবীহ ইসমাইলই আ. হলেন, ইসহাক আ. নন।
তিন:
সূরা হুদের উপরোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালা ইসহাক আ. এর সন্তান হিসেবে ইয়াকুব আ. এর জন্মের সুসংবাদ দিয়েছেন। যাতে বোঝা যায়, ইসহাক আ. বেঁচে থাকবেন, নতুবা তার সন্তান আসবে কী করে!শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার কথা বলেন। তিনি বলেন,
قال شيخ الإسلام ابن تيمية – رحمه الله -: “ومما يدل على أن الذبيح ليس هو إسحاق أن الله تعالى قال: (فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِن وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ)، فكيف يأمر بعد ذلك بذبحه؟، والبشارة بيعقوب تقتضي أن إسحاق يعيش ويولد له يعقوب ، ولا خلاف بين الناس أن قصة الذبيح كانت قبل ولادة يعقوب، بل يعقوب إنما ولد بعد موت إبراهيم عليه السلام، وقصة الذبيح كانت في حياة إبراهيم عليه السلام بلا ريب” [مجموع الفتاوى (4/335)].
যাবীহ যে ইসহাক আ. নন, তার বড় দলীল হলো, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়াকুবেরও।” যদি ইসহাক আ. এর সন্তান হিসেবে ইয়াকুব আ. এর জন্মের সুসংবাদ দিয়েই থাকেন, তাহলে আবার কীভাবে ইসহাক আ. এর যবেহের সুসংবাদ দিবেন? কারণ ইয়াকুব আ. এর জন্মের সুসংবাদই প্রমাণ করে যে ইসহাক আ. বেঁচে থাকবেন, তাঁর ইয়াকুব নামে একটি সন্তান হবে (ফলে তার যবেহের কথা বলা নিরর্থক)।
আর এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, যবেহের ঘটনা ইয়াকুব আ. এর জন্মের পূর্বে হয়েছে। বরং, ইয়াকুব আ. তো ইব্রাহীম আ. (দাদা) এর মৃত্যুর পর জন্ম গ্রহণ করেছেন। আর যবেহের ঘটনা নি:সন্দেহে ইব্রাহীম আ. এর জীবদ্দশায় হয়েছে। (ইয়াকুব আ. এর জন্ম ইব্রাহীম আ. এর মৃত্যুর পর। তার মানে, ইব্রাহীম আ. এর জীবদ্দশায় ইয়াকুব আ. এর জন্ম হয়নি। এখন যদি বলা হয় যে ইসহাক আ. কেই যবেহ করা হয়েছে, তাহলে আল্লাহ তাঁর ঘরে ইয়াকুব আ. এর জন্মের যে সুসংবাদ দিয়েছেন, তার কোনো অর্থ থাকে না। কারণ, ইয়াকুব আ. এর জন্মের সুসংবাদ = ইসহাক আ. এর বেঁচে থাকার সুসংবাদ। আর যবেহ তার বিপরীত। কাজে কাজেই সুতরাং, … ইসমাইল আ. ই যবীহ ছিলেন।) – (মাজমুয়ুল ফাতাউই : ৪/৩৩৫)
চার:
আল্লাহ তায়ালা যবেহ হওয়া সন্তানের গুণ বর্ণনা করে বলেছেন,তিনি غلام حليم বা সহনশীল বালক। (সূরা সাফফাত ৩৭:১০১)
আর ইসহাক আ. এর গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
তিনি غلام عليم বা জ্ঞানী বালক।
قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ [١٥:٥٣]
তারা বললঃ ভয় করবেন না। আমরা আপনাকে একজন জ্ঞানবান ছেলে-সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। (১৫:৫৩)
ওদিকে ইসমাইল আ. এর গুণ বর্ণনায় তিনি বলেন,
১. তিনি ধৈর্য্যশীল।
(وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا الْكِفْلِ كُلٌّ مِنَ الصَّابِرِينَ) [الأنبياء:85]
এবং ইসমাঈল, ই’দ্রীস ও যুলকিফলের কথা স্মরণ করুন, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সবরকারী। (সূরা আম্বিয়া: ২১:৮৫)
(يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ).
সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (সূরা সাফফাত : ৩৭:১১২)
২. তিনি অঙ্গীকার পালনকারী।
{إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ } [ مريم : 54 ]
তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী (সূরা মরিয়ম : ১৯:৫৪)
লক্ষ্য করুন, যবেহ হওয়া সন্তানের গুণের সাথে ইসমাইল আ. এর গুণাগুনই মিলছে। সহনশীল আর ধৈর্য্যশীল সমার্থক শব্দ। যেহেতু আল্লাহ এই গুণবাচক শব্দটি উল্লেখ করেছেন, কাজেই এই গুণ দিয়ে একজনকে অপরজন থেকে পৃথক করে বোঝানোই উদ্দেশ্য হবে। সুতরাং, সহনশীল সে বালক হবেন ইসমাইল আ., অন্য কেউ নন।
পাঁচ:
ইসহাক আ. এর জন্ম হয়েছে তাঁর মা সারার বৃদ্ধাবস্থায়। ফলে তা ইব্রাহীম আ. এর একটি মুজিযা ছিল। আর যেহেতু উভয়েই বৃদ্ধ ছিলেন, তাই এটি উভয়ের জন্যই সুসংবাদ ছিল।
وَامْرَأَتُهُ قَائِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِن وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ – قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ – قَالُوا أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۖ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ ۚ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَّجِيدٌ – فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ – إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُّنِيبٌ -
তাঁর স্ত্রীও নিকটেই দাড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়াকুবেরও। সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এতো ভারী আশ্চর্য কথা। তারা বলল-তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুত বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময়। অতঃপর যখন ইব্রাহীম (আঃ) এর আতঙ্ক দূর হল এবং তিনি সুসংবাদ প্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি আমার সাথে তর্ক শুরু করলেন কওমে লূত সম্পর্কে। ইব্রাহীম (আঃ) বড়ই ধৈর্য্যশীল, কোমল অন্তর, আল্লাহমুখী সন্দেহ নেই। (সূরা হুদ : ১১:৭১-৭৪)
অথচ জবেহের ব্যাপারে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, সে সুসংবাদ কেবল ইব্রাহীম আ. এর জন্য ছিল। এবং তা তিনি তার মাতৃভূমি ত্যাগ করা মাত্রই পেয়েছিলেন। (সূরা সাফফাত : ৩৭:৯৯-১০১)
ওই সুসংবাদে সন্তানের মায়ের কোনো বর্ণনা নেই, নেই বার্ধক্যের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো প্রকাশ। কাজেই উভয় সুসংবাদের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট। আর বার্ধক্যের সুসংবাদে যেহেতু ইসহাক আ. এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাই অপর সুসংবাদটি যে ইসমাইল আ. এর ব্যাপারে, তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকছে না।
ছয়:
আল্লাহ যেসব আয়াতে ইব্রাহীম, ইসমাইল ও ইসহাক আ. এর নাম একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, সেসব আয়াতে ইব্রাহীম আ. এর পরই ইসমাইল আ. এর নাম উল্লেখ করেছেন। (উদাহরণস্বরূপ : সূরা বাক্বারা : ২:১৩২-১৩৩)
এতে বোঝা যায় যে তিনি ইব্রাহীম আ. এর প্রথম সন্তান ছিলেন। আর সূরা সাফফাতের আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে তিনি তাঁর প্রথম সন্তানকেই যবেহ করেন। কারণ, স্বগোত্রকে ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি নি:সন্তান থাকাবস্থায় নেক সন্তান কামনা করে দোয়া করেন।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ [١٤:٣٩]
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাকে এই বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন নিশ্চয় আমার পালনকর্তা দোয়া শ্রবণ করেন। (সূরা ইব্রাহীম : ১৪:৩৯)
সাত:
তাওরাতে বর্ণনা আছে যে, ইব্রাহীম আ.এর প্রতি নির্দেশ এসেছিল “اذبح ابنك وحيدك” (তোমার একমাত্র সন্তানকে যবেহ করো।) আর এ কথায় মুসলিম-অমুসলিম কারো কোনো দ্বিমত নেই যে ইসমাইল আ. ই ইব্রাহীম আ. এর একমাত্র সন্তান ছিলেন। এবং অনেক পরে গিয়ে ইসহাক আ. এর জন্ম হয়।(মাজমুয়ুল ফাতাওয়া : ৪/৩৩২)
আট:
এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ একমত যে, যবেহের ঘটনা মক্কায় হয়েছে। আর মক্কায় ইব্রাহীম আ. এর সাথে কোনো সন্তান ছিলেন তার জবাব নিম্নের আয়াতে :
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ পরওয়ারদেগার! আমাদের থেকে কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাক্বারা : ১২৭)
এতে বোঝা যায় যে, মক্কায় ইব্রাহীম আ. এর সাথে ইসমাইল আ. ছিলেন। ইসহাক আ. শৈশবে কখনো মক্কা গিয়েছেন কিনা, তার কোনো প্রমাণ মেলে না।
ঘটনা হলো, ইব্রাহীম আ. আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে (যা বাগানে পরিণত হয়) স্বদেশ মিশর ছেড়ে সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে ইসমাইল আ. এর জন্ম হলে তাকে তার মা হাজেরা সহ মক্কায় নিয়ে আসেন। যেখানে জমজম, সাফা-মারওয়ার সায়ীসহ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ঘটে। সেখানেই ইসমাইল আ. বড় হলে তাকে নিয়ে তিনি কাবা পূন নির্মাণ করেন। আর এই মক্কাতেই তাকে যবেহ করার নির্দেশ লাভ করেন।
সারকথা, ইব্রাহীম আ. যাকে যবেহের ব্যাপারে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তিনি ইসমাইল আ.। ইহুদীরা তাওরাতের শব্দ (তোমার একমাত্র সন্তানকে যবেহ করো) এর পর “ইসহাক” শব্দটি জুড়ে দিয়ে লিখে দেয়, (তোমার একমাত্র সন্তান ইসহাক কে যবেহ করো)। (মাজমুয়ুল ফাতাওয়া : ৪/৩৩২) এ কারণেই ইসহাক আ. এর ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
--------
পূর্বে প্রকাশিত : http://yousufsultan.com/posts/ismail-was-jabih-not-ishaq/