মতিন সাহেবের স্ত্রী আস্ত একটা পাগল। তার মস্তিস্ক মাইক্রোওয়েভ ওভেনের চাইতেও দ্রুত গরম হয়, মেজাজের মাত্রা থার্মোমিটারের ডগায় থাকা পারদের মত উঠে থাকে। পারদ নামাতে অল্প ঝাঁকিতে কাজ হয় না, অনেক কসরত করা লাগে। মতিন সাহেব গত কয়েকদিন ধরে এ বিষয়টি নিয়ে বড়ই বিক্ষিপ্ত। তার ছেলের বয়েস সবে দুই বছর। ইদানিং তিনি তার ছেলের মধ্যেও এধরনের ব্যাপার লক্ষ্য করছেন। দুই বছরের বাচ্চা, কিন্তু ভোকাল কর্ডে যেন বিল্ট-ইন মাইক্রোফোন লাগানো; কারণে-অকারণে চিত্কার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। টিভি চ্যানেলগুলো কত হাবিজাবি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, ছোট বাচ্চাদের চিৎকার প্রতিযোগিতা আয়োজন করলেও তো পারে! অবশ্য মতিন সাহেব নিজেও যে ঠান্ডা মাথার মানুষ, তা-ও নয়। ইদানিং তারও দুম করে মেজাজ চড়ে যায়। এটা শুরু হয় সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবার পর থেকে। তার বাসা খিলগাঁও। আলসেমির কারণে গলির মুখ পর্যন্ত হেটে আসতে মন চায় না, তিনি রিক্সায় উঠেন । আজকাল রিক্সায় উঠলেই দশটা টাকা বেরিয়ে যায়। দু'টাকার নোট তো ফকিররাও নেয় না; সরকার কেনো যে একটাকা আর দু'টাকার নোট এখনো উঠিয়ে দিচ্ছে না, কে জানে! রিক্সা থেকে নেমে বাসের জন্যে অপেক্ষা। মাঝে মধ্যে তাড়া থাকলে সি.এন.জি. নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সি.এন.জি. ওয়ালাগুলো হয়েছে বদের বদ । মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে ওদের পাছায় কষে লাত্থি দিতে । ট্রাফিককে বলেও কোনো লাভ হয় না; সে তো বদের উপর আরেক কাঠি।
মতিন সাহেবের স্ত্রীর নাম পারভীন। বিয়ের পরপর আদর করে ডাকতেন পারু বলে। ইদানিং সেটা বেশ কমে গেছে। তার একমাত্র শালীর নাম আলতা। বিয়ের পর তার স্বামী তাকে আদর করে কি নামে ডাকবে সেটা ভেবে তিনি খানিকটা শঙ্কিত। পারুর সাথে তার প্রথম পরিচয় অদ্ভুতভাবে, এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন তুখোড় বিতার্কিক। পরবর্তীতে অসংখ্য বিতর্ক প্রতিযোগিতায় মডারেটর কিংবা বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন। সেরকমই এক প্রতিযোগিতায় পারুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের পক্ষে পারু বিতার্কিক হিসেবে বক্তৃতা দিচ্ছিলো আর তিনি বিচারকের ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন পারুর উপস্থাপনা আর সাবলীল বলিষ্ঠ বক্তৃতায়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই হিসেবে পরিচয়ের সূত্রপাত আর সেখান থেকেই মুন্ডুপাত। বিয়ের পর থেকে পারুর বিতর্ক প্রতিভা দিনে দিনে যেন আরো বিকশিত হয়েছে। যে বিষয়েই ঝগড়া হোক না কেন, মতিন সাহেব কোনটাতেই পারুর সাথে পেরে ওঠেন না। দু'একবার জেতার সুযোগ দিলেও একটা কথা ছিল!
আগামীকাল মতিন সাহেবের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। তিনি ঠিক করেছেন এবারে স্ত্রীর জন্যে কোনো উপহার কিনবেন না, এমনকি বিবাহবার্ষিকী পালনও করবেন না। পারু বলেও ডাকবেন না, এখন থেকে পারভীনই ডাকবেন। সকাল- বিকাল ঝগড়া হয়, কিসের আবার বিবাহবার্ষিকী! আর বাইরে খেতে যাওয়া মানেই তো একগাদা পয়সা খরচ। ঠিক করলেন, আজ অফিস থেকে বের হয়েই সোজা বাসায় যাবেন, রাত বারোটার আগেই ক্লান্ত হবার ভান করে ঘুমিয়ে পড়বেন, সকালে উঠেও এমন ভাব করতে হবে যেন বিবাহবার্ষিকী নামক বস্তুটিকে তিনি চেনেনই না!
আজ যেন অফিসের সময় ফুরোচ্ছেই না। ফেসবুকও আজকে বিরক্ত লাগছে। মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট-এর তারেক সাহেব তো মনে হয় সারাদিন ফেসবুকেই পড়ে থাকে, সবার লিখাতেই কমেন্ট না দিতে পারলে উনার পেটের ভাত হজম হয় না! আর ফাইন্যান্স-এর জালাল তো দেখি ঘন্টায় ঘন্টায় স্ট্যাটাস পাল্টায়! জালাইল্যার সমস্যা কি! আরেকজন আছে বাল্যবন্ধু মনসুর, কথায় কথায় ট্যাগ মারে। উফ! মনসুরকে আন-ফ্রেন্ড না করা ছাড়া দেখি উপায় নাই! ডেস্কে বসে মতিন সাহেব লক্ষ্য করলেন এমডি সাহেবের রুম থেকে পিয়ন ব্যাগ নিয়ে বেরুচ্ছে, তার মানে এমডি স্যার এখুনি বেরুবেন। তিনি দ্রুত ফেসবুক ক্লোজ করে একটা এক্সেল ফাইল ওপেন করলেন। এমডি ব্যাটা বদের হাড়ি, সুযোগ পেলেই টুকটাক পার্সোনাল কাজ মতিন সাহেবকে দিয়ে করায়ে নেন। 'না' বলাটা শিখতে হবে, মতিন সাহেব ভাবলেন।
- মতিন সাহেব, দুইটা নতুন অর্ডার এসেছে, পেপারস গুলো আজকের মধ্যেই রেডী করে ফেলেন, ok?
- Ok স্যার।
- ওহ, আরেকটা ফেভার দরকার। আগামীকাল আমার একটা বিয়ের দাওয়াত আছে, একটা নেকলেস অর্ডার দেয়া আছে কাঁপন জুয়েলার্স এ, পেমেন্ট দেয়া আছে, ওটা জাস্ট পিক করে নিয়েন আপনি, কালকে অফিস এ আমাকে দিয়েন।
- Sure স্যার।
কেমন লাগে মেজাজটা। এবারও না বলা হলো না। মতিন সাহেব ফেসবুকে মন খারাপের স্টেটাস দিয়ে পেপারস রেডি করতে বসলেন। এমডি স্যারের সব কাজের ঝামেলা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বাজলো। পারভিনের চোখমুখ দেখে ভাবচক্কর বোঝার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তেমন কিছু আঁচ করতে পারলেন না; তবে শালী আলতার চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন, বোধহয় বোনের জন্যে কোনো গিফট এনেছেন কিনা, সে ব্যাপারে কৌতুহল। তা যতই প্রশ্নবোধক কিংবা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেখাও, এবার আর তোমার বোনের জন্যে কোনো উপহার আশা করো না, মনে মনে ভাবলেন মতিন সাহেব।
রাত ১১:৩০; মতিন সাহেব স্টাডি রুমে একটা বই নিয়ে বসেছেন। পড়া তো নয়, পড়ার ভান করা আর কি। কোনো মতে সাড়ে বারোটা বাজলেই ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়বেন। বারোটা বাজার মিনিট দশেক আগে আলতা ঢুকলো, হাতে একটা প্যাকেট।
- দুলা- -ভাই
- হু
- উঠেন, উঠেন আর এই প্যাকেট এর কাপড়টা চটপট পড়ে ফেলেন
- কি বলো, এই মাঝরাতে এই নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়তে যাবো কেনো, আমাকে কি আবার বিয়ে দিবা নাকি!
- আরে উঠেন তো, এইটা আপা আপনার জন্যে কিনেছে, বিবাহবার্ষিকীর গিফট।
- বলো কি! কাল কি আমাদের বিবাহবার্ষিকী নাকি!
- কতো যে ঢং জানেন দুলাভাই! মুখে ভাব দেখান, এদিকে তো দেখি দামী নেকলেস ঠিকই গিফট দেন। ভাগ্যিস আপনার ব্যাগের সাইড পকেটটাও শেষ মুহুর্তে চেক করেছিলাম। আপনি তাড়াতাড়ি উঠেন তো, আপা অপেক্ষা করছে। আমি বাবুকে নিয়ে গেস্ট রুমে থাকবো।
মতিন সাহেব আঁতকে উঠলেন। এ তো বসের গিফটের নেকলেস! হায় হায়!! এখন কিভাবে এটা বৌএর কাছ থেকে ফেরত নেবেন! তার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। দু:খ ভারাক্রান্ত মতিন সাহেব পাঞ্জাবির প্যাকেটটা হাতে নিলেন। টাইট পাঞ্জাবি, পড়ার সময় বগলের দিকটার সেলাই খুলে গেলো আর একটা বোতাম খুট করে নিচে পড়ে গেলো। তিনি সেভাবেই বেডরুমে ঢুকলেন।
পারভীন বিয়ের শাড়িটা পড়েছে। নতুন নেকলেসটাতে তাকে দারুন মানিয়েছে। পারভিনের চোখে মুখে যে খুশির ঝিলিক, নেকলেসের আসল কাহিনী বলে তা মুছে দিতে মতিন সাহেবের ইচ্ছে করলো না। এরকম দিন বছরে বারবার আসে না। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, 'পারু, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।'
এর পরের সময়টা তার বেশ ভালই কাটলো। শুধু শেষ রাত্রের দিকে তিনি গোঙানির মতো করে 'শালী' কথাটা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। তবে শালী দিয়ে তিনি সত্যিই তার শালীকে বোঝালেন নাকি কোনো গালি বোঝালেন সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৪:১৫