স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে ক্যানবেরা পৌঁছুলাম ২০০৪ এর আগস্টের ১৪ তারিখ। হাড় কাঁপানো শীতের সাথে এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম। প্রানের বন্ধু অভিজিতকে এয়ারপোর্টে জড়িয়ে ধরতেই শীত শীত ভাবটা অনেকটাই কমে গেলো। মানিক ভাই এর কথা অনেক শুনেছিলাম, দেখা হলো এই প্রথম। এরপর মানিক ভাই এর গাড়িতে ক্যানবেরার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে অভিজিতের বাসায় ওঠা আর বাকিদের সাথে আলাপ পরিচয়। জানলাম এখানকার মানুষের কথা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা আর জানলাম ক্যানবেরার বাংলা রেডিওর কথা। পৌঁছানোর ঠিক দুদিন পরেই অর্থাৎ আগস্টের ১৬ তারিখে রেডিওতে অভিজিতের প্রোগ্রাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো কিছু অংশ পাঠ করতে চাই কি না। এসব ব্যাপারে আমার আগ্রহের কখনই কমতি ছিল না, তাই না করার প্রশ্নই উঠে না। এভাবেই শুরু হলো বাংলা রেডিওর সাথে আমার পথ চলা। পরের সপ্তাহে মানিক ভাই এর প্রোগ্রামে আরো অনেক বেশি কিছু করার সুযোগ হলো। স্ক্রিপ্টিং মানিক ভাই এর ছিল কিন্তু ভয়েস ওভার পুরোটাই আমার। এরপর খেকে মানিক ভাই এর প্রোগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলাম আমি।
মানিক ভাই, অভিজিত দুজনেই অনেক গুনী মানুষ। ধীরে ধীরে পরিচয় হলো বাংলা রেডিওর সাথে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক গুনী মানুষের সাথে। এহসান ভাই, খুকি ভাবি, সাদেক ভাই, মিতুল আপা, শিরীন আপা, বদিউজ্জামান আন্কেল, ডালিয়া আন্টি, হুদা ভাই এবং আরো অনেকে। ২০০৫ খেকে আমি একক ভাবেই অনুষ্ঠান করা শুরু করলাম। সেসময় ৬ জন প্রেজেন্টার ছিলেন, রোটেশন পদ্ধতিতে একেক সোমবার একেকজন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। সাদেক ভাই ছিলেন কো-অর্ডিনেটর। ২০০৮ এর জানুয়ারীতে বাংলাদেশে চলে আসার আগ পর্যন্ত আমি মোটামুটি নিয়মিতভাবেই বাংলা রেডিওর অনুষ্ঠান পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলাম। যদিও লাইভ প্রোগ্রাম, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে আমরা স্ক্রিপ্টিং করে সেই অনুযায়ী রেকর্ড করে পুরো ত্রিশ মিনিটের সিডি রেডি করে ফেলতাম আর সময়মত যেয়ে ওটা প্লে করে দিতাম।
রেকর্ডিং আর কারিগরী ব্যাপারে সিনিয়র ভাইয়ারা যে ধরনের সাহায্য করেছেন, তা কখনই ভোলার নয়। মানিক ভাই অনেক ধৈর্য ধরে এডিট করতেন, কোনো অংশ ভালো না লাগলে আবার রেকর্ডিং করিয়ে নিতেন। সাদেক ভাই এর বাসায় আমি বহু অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করেছি, আমার বেশিরভাগ প্রোগ্রামের ফাইনাল এডিটিং উনারই করা। মনে আছে, একবার রেকর্ডিং করার পরদিন সাদেক ভাই ফোন দিয়ে জানালেন যে আমার ভয়েস ওভারের ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছু জায়গায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ চলে এসেছে। সেদিন রাত্রে যেয়ে আবার রেকর্ডিং করে এসেছিলাম। এহসান ভাই এর বাসায়ও বার দু'য়েক রেকর্ডিং এর জন্যে গিয়েছি। উনি অনেক যত্ন নিয়ে সবকিছু করেন। উনি ঢাকাতে এসে আমার জন্যে রেকর্ডার নিয়ে এসেছিলেন যেন আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন সাক্ষাত্কার কিংবা যেন কিছু রেকর্ড করে পাঠাতে পারি। একবার একুশে বই মেলা কাভার করেছিলাম কিন্তু পরে আর সেভাবে কিছু করা হয়নি। আমার অনুষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও আমি যথেষ্ট সময় দিতে পারি নাই ভেবে এখন অনেক আফসোস হয়। আরো অনেক বেশি সময় দিতে পারলে অনুষ্ঠানগুলোর সার্বিক মান আরো অনেক ভালো হত বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
যদিও বাংলাদেশে আছি, ক্যানবেরার সাথে আমার আত্নিক বন্ধন থেকেই যাবে। এখন নতুন পুরনো মিলিয়ে অনেক প্রডিউসার এবং প্রেজেন্টার রয়েছেন যাদের অনুষ্ঠান আমি নিয়মিত ফলো করি। এটা সম্পূর্ণই ভলান্টিয়ার জব, তাই যারা এটার পেছনে শ্রম দেন, সময় দেন, তারা সবাই অনেক বড় মনের মানুষ। মানুষের জন্য, দেশের জন্য ভেতর খেকে তাগিদ অনুভব করেন বলেই তারা এটা করেন, কোনো কিছু পাওয়ার আশা খেকে নয়।
বাংলা রেডিও ক্যানবেরা আমাদের রেডিও, এটা আমাদের প্রানের কথা বলে, আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। বাংলা রেডিও ক্যানবেরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যাক, এর ব্যাপ্তি আরো বেড়ে উঠুক, কামনা এটাই।