দুপুরে কোচিং শুরু হয়ে শেষ হতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। লোপা কোচিং শেষে রিক্সায় একই সাথে বাড়ি ফিরে কোচিংয়ে পরিচিত নতুন বান্ধবী সোমার সাথে। লোপার বাসার একটু পরেই সোমার বাসা তাই দুজনেই এভাবে একই সাথে যাতায়াত করে। সামনে ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা তাই মডেল টেস্ট দিচ্ছে লোপা আর সোমা একই কোচিংয়ে। লোপার সাথে একদিন কোচিংয়ে সোমা ওর বড় ভাই সাকিবকে পরিচয় করিয়ে দিল। লোপা ও সোমা' র বন্ধুত্বের সুবাদে সাকিবের সাথে প্রায়ই লোপার দেখা হতো। কিছুদিন পর একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সাকিবের সাথে দেখা হয় লোপার । সাকিব ও তার কলেজের বন্ধুরা মিলে ছোটখাটো একটা ব্যান্ড দল তৈরি করে এবং সেখান সাকিব গিটার বাজাতো। ওই গায়ে হলুদের প্রোগ্রামে সাকিব গিটার বাজাচ্ছিলো এবং সেই অনুষ্ঠানে লোপা সবুজ জমিনে হলদে পাড়ের মাথায় এক ঝাঁক গাঁদা ফুল পড়ে গিয়েছিল। সাকিব বারবার মুগ্ধ নয়নে দেখছিল লোপাকে।
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে....
এই গানটি যখন হচ্ছিল তখন সাকিব গিটারে যে ঝড় তুলেছিল তা যেন মনেরই ভাষার অন্য এক প্রতিচ্ছবি। লোপা ও বারবার তাকাচ্ছিল সাকিবের দিকে । লোপার তুলনায় সাকিব একটু বেশি সুদর্শন কিন্তু লোপার চোখ ছিল ভীষণ আকর্ষণীয়। সাকিবের মনে হয়তো সেদিন থেকেই লোপাকে ভালোলাগা শুরু । সাকিব এখন তার বোন সোমাকে কোচিংয়ে আনা - নেওয়ার ডিউটি শুরু করলো ইচ্ছে করেই যাতে করে লোপাকে এক নজর দেখা যায়। লোপা বেচারী একা যায় কোচিংয়ে একা আসে। এভাবে চলছে আর কিছুদিন পরেই সাকিবের বি.কম সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না। যেভাবেই হোক লোপাকে ওর মনের কথা জানাতে হবে। সাকিব অনেক ভেবে চিন্তে লোপাকে একটি চিঠি লিখলো কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগল ছোট বোনের ক্লাসমেট কিভাবে দেয়? অবশেষে সাকিব লোপাকে একটি চিঠি লিখলো এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই চিঠি পড়ে লোপা মনে মনে ভাবল এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি ....
আট মাস সাকিব ও লোপার চোখাচোখি, দূর থেকে দেখে মিষ্টি হাসি আর ভেতরের কিছু লুকানো জমানো কথা এবার একটা প্রেম নামে ভূষিত হলো । ১৯৯৯ সালের কোনো এক পহেলা বৈশাখে সাকিব ও লোপা একসাথে ঘুরতে বের হয়। অনেকগুলো লাল গোলাপ সুনীলের প্রথম প্রেম বই উপহার পায় লোপা সাকিবের কাছ থেকে। সপ্তাহে অন্তত ৪-৫ দিন ১০ মিনিটের জন্য হলেও সাকিব ও লোপার সাথে দেখা হতো। তখন মোবাইলে খুব একটা প্রচলন ছিল না শুধু টিএনটি ফোনে টুকটাক কথা হতো আকার-ইঙ্গিতে।
লোপা দের বাসায় ডাবলসের ছিল টিএনটি ফোনের তাই কথা কম হতো । সাকিব ও লোপার সম্পর্ক বছর খানেকের কিন্তু ওদের দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল খুব ভালো । সাকিব প্রোগ্রাম করে অল্পস্বল্প কিছু টাকা যা পেতো তা জমিয়ে লোপাকে রুপার নুপুর পোশাক শাড়ি এটা-সেটা সব সময় উপহার দিতো । এটা নিয়ে লোপাকে খুব বিব্রত অবস্থায় এবং ঘরে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতে হতো। সাকিবের বন্ধুরা ও লোপার বান্ধবীদের নিয়ে শহরের অদূরেই পিকনিকে গেলো সবাই। সেখানে গিয়ে সাকিব সবার সামনেই লোপাকে বললো এবং বুঝালো, শাকিবের পরিবার চাইছিল শাকিব দেশের বাইরে চলে যাক। সাকিবের ইচ্ছা কিন্তু লোপাকে রেখে কিভাবে যাবে? সিলেট সাকিবের আদি নিবাস আর লন্ডন তো সাকিবকে যেতেই হবে। যেটা ছিল সাকিবের ফ্যামিলি ট্রেডিশন।
লোপা অনেক আগে থেকেই জানতো সাকিব আজ অথবা কাল হয়তো লন্ডন যাবেই কিন্তু লোপা ও সাকিবের উভয়ের বড় ভাই বোন বিয়ের বাকি। এবং ওই সময় সাকিব কিছুই করে না কিভাবে প্রস্তাব পাঠাবে কিভাবে কি করবে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। জমজমাট প্রেমপর্ব চলার সময়ে দুজনের মনের আকাশে কালো মেঘের বজ্রপাতের বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু সকিব নিরুপায় ওকে যেতেই হবে। লোপা চাইছিল গোপনে কোট মেরেজ করে রাখুক কিন্তু সাকিব রাজি হলো না। লোপাকে সাকিব বোঝালো তুমি পড়াশোনা শেষ করো আর আমি ২ - ৩ বছর পর এসে তোমাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করবো ।
লোপার আর কিছুই করার ছিল না, একমাত্র ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া।
সাকিব লন্ডনে স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়ার পর লোপার সাথে ফোনে কথা বলে এবং প্রায়ই বড় করে চিঠি লেখে । লোপা ও বাংলাদেশ থেকে সাকিবকে চিঠি দিতো এবং ফোনের দোকানে গিয়ে আইএসডি কল করে শাকিবের সাথে কথা বলতো। এভাবে প্রায় বছরখনেক যাওয়ার পরেই ভিসা জটিলতার কারণে সাকিব বিয়ে করে ওখানকার সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য। সাকিব বিয়ের পরে যোগাযোগ রাখে এবং বলে গ্রীন কার্ড পেলে এই বউকে ডিভোর্স দিবে। লোপাও সবার অগোচরে অবুঝের মতো সাকিব এর আগে যোগাযোগ রাখে। এ সম্পর্কে শেষ পরিণতি কি তাহলে সাকিব তার বউকে ডিভোর্স দিয়ে পরে আবার লোপাকে বিয়ে করবে?
একটা সময় লোপা বুঝতে পারলো এটা অন্যায়। এভাবে তিন বছর যাওয়ার পর লোপার বিয়ে হয়।
লোপার বিয়ের পর শাকিবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। লোপার দিন - কাল সংসার জীবন ভালোই যাচ্ছে স্বামীর সাথে। প্রায় আরো দেড় বছর পর শাকিব ফেসবুকের মাধ্যমে লোপার সাথে যোগাযোগ করে। লোপাকে বলে যা হওয়ার হয়েছে ভুল হয়েছে এখন সে লোপাকে আবার বিয়ে করতে চায় এবং লোপাকে বলে ওর হাজব্যান্ড কে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য।
লোপা সাকিবকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে এটা কোনভাবেই সম্ভব না। তখন সাকিব লোপাকে বলে আমি বিয়ে করার পর পরই তোমাকে জানিয়েছি এবং বলেছি ওকে আমি ডিভোর্স করবই গ্রীন কার্ড পাওয়ার পর এখন আমি রাজি তাহলে তুমি রাজি হচ্ছো না কেন?
লোপা কিছুটা দুটানায় পড়ে যায় কি করবে স্বামী ডিভোর্স দিবে? কিন্তু না, ভেবে দেখল এটা কোনভাবেই সম্ভব না। নিরপরাধ মানুষের সাথে এত বড় বেঈমানী উপরওয়ালা সহ্য করবেন না।
লোপার সম্পূর্ণ ভাবে সাকিবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। সাকিব অনেক চেষ্টা করেও লোপাকে ফেরাতে পারিনি । লোপা অস্বাভাবিক কষ্টের জীবন পেছনে ফেলে সুখের দেখা হয়তো পেয়েছে।
কিন্তু সাকিব .....
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:২৬