আগের পর্ব
Click This Link
যে কয়টি উদ্দেশ্য নিয়ে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল কোন মসজিদে জুম্মা নামায পড়া। কিন্তু সকালের ঘুম আমার কিছুতেই কাটছে না। শেষে ঘুম থেকে উঠার মত বিরাট কষ্ট সহ্য করে উঠে পড়লাম। টাইমস স্কোয়ার থেকে বের হয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় কোন মসজিদের দেখা পেলাম না। বুঝলাম তারা মুসলমান হলেও আমাদের মত সাচ্চা মুসলমান না যে মোড়ে মোড়ে মসজিদ থাকবে!! এক সিকিউরিটি গার্ডকে মসজিদ/মস্ক বলেও মসজিদের ঠিকানা পেলাম না। শেষে কান পর্যন্ত হাত তুলে বুঝালাম। সে আমাকে মার্কেটের ভিতরের প্রেয়ার রুম দেখিয়ে দিল যা তারা সুরাহ নামে ডাকে। কিন্তু সেখানে তো আর জুম্মা হবে না। শেষে হাটতে থাকলাম যে কোন একদিকে। কিছুদূরের মধ্যে মসজিদ পেয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু টানা অনেকক্ষন হেটেও কোন মসজিদ পেলাম না। যখন মসজিদের খোজে কিছুটা দিশেহারা তখনই ভেসে আসল আযান। ব্যস, পেয়ে গেলাম মসজিদ। মসজিদের বাইরে ভিক্ষারত লোকজন, ফুটপাথের খাবারের দোকান সব পেরিয়ে মসজিদে ঢুকলাম। নামায পড়লাম তাদের সাথে। শুনেছিলাম তারা সুন্নত শেষে পাশের মুসল্লির সাথে হাত মিলায়। আমি অবশ্য সুন্নতের পরে ঢুকেছি তাই এইটা দেখিনি। তবে আত্তাহিয়াতুর পর এক আঙ্গুল তুলেই রাখে।
বলা হয় নি যে সকাল থেকেই আমার ছেলে কান্নাকাটি করেছে খুব। তাকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে এই কারনে। তবুও বিকেলের পর সবাই মিলে বের হলাম টুইন টাওয়ার দেখতে। টাইমস স্কোয়ার থেকে টুইন টাওয়ার দেখা যায়। মনে হয় যেন ঐ বিল্ডিং এর পরই টুইন টাওয়ার। আমরা হেটে হেটেই রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য এই পথে মালয়েশিয়ার লোকজনের জীবনাচার যদি কিছু দেখা যায়। তখন অফিস ফেরত মানুষের পদভারে মুখরিত কেএল। সবাই অফিস শেষে হয়ত উইকএন্ডের আনন্দে মশগুল। ক্যাফেতে খুব ভীড়। তবে ইয়ং ছেলেমেয়েদের দেখলাম সারাক্ষনই মোবাইলে ইন্টারনেটে ডুবে থাকে। এমনকি পাশাপাশি বসে কফি খাচ্ছে। সেখানেও গল্প না করে ইন্টারনেট। পথ আমাদের আর শেষই হয় না। শুধু টুইন টাওয়ারের মাথা দেখা যায়। এই দেখে দেখেই হাটছি, কোলে তখনও আমার ছেলে। একসময় দেখা পেলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের। মনে হল যেন মালয়েশিয়া আসার স্বপ্ন পূরন হল। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে এবং এই লম্বা পথ হেটে এসে খুবই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও কেন যেন আবার পায়ে হেটে ফেরার প্ল্যান করলাম। তবে এবার পথ হারিয়ে ফেলেছি। যে কয়জনকে ডিরেকশন জিজ্ঞেস করেছি তারা একেকজন একেক দিক দেখিয়েছে। পরে নিলাম একটি নীল ট্যাক্সি যার ড্রাইভার ভারতীয়। বলা ঠিক না তবুও বলে রাখি, মালয়েশিয়াতে নীল ট্যাক্সি এবং ভারতীয় ড্রাইভারের গাড়ীতে না উঠাই ভাল। ট্যাক্সি থেকে নেমে গেলাম একটু পরই। তারপর পায়ে হেটে ধীরে ধীরে ফিরলাম হোটেলে। তখন বুঝলাম প্রায় সবারই ডিরেকশন ঠিক ছিল। কারন এত এত পথে টাইমস স্কোয়ার আসা যায় যে একেকজন একেক ডিরেকশন দিতেই পারে। তবে কথা হচ্ছে পথঘাটেই কিছু সাইন দেয়া থাকে বা আকাশপথে চলা মনোরেলের রুট খেয়াল করলেই গন্তব্য বুঝা যেতে পারে।
পরদিন যাওয়ার প্ল্যান ছিল গ্যান্টিন হাইল্যান্ড। কিন্তু আমার ছেলের প্রায় অবিরাম কান্নাকাটির কারনে আর গেলাম না। আমাদের ফেরার টিকেট ছিল সিঙ্গাপুর থেকে। তাই পরদিন সিঙ্গাপুর চলে যাওয়াই ঠিক করলাম। একারনেই এই সিরিয়াল পোস্টে মালয়েশিয়া না লিখে কুয়ালালামপুর লিখলাম। হোটেলের নিচেই আছে টিকেট কাউন্টার। ৪৫ রিঙ্গিত পার হেড দিয়ে টিকেট কাটলাম। নিয়ম হচ্ছে এই বাস সিঙ্গাপুর যাবে। সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেষনে লাগেজসহ নেমে যেতে হবে। বাস ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে যারা ইমিগ্রেষন এবং কাস্টমস শেষ করে আসতে পারবে তারা এই বাসে যাবে। আর যারা মিস করবে তারা টিকেট দেখিয়ে একই কোম্পনীর পরের বাসে উঠবে। তাই বাসেই ইমিগ্রেষন ফরম ফিলাপ করে রাখা ভাল। আমি করে রেখেছিলাম এবং তার জন্য বেশ তাড়াতাড়ি আমার কাজ শেষ হয়েছিল। বাস টাইমস স্কোয়ার থেকে যাত্রা শুরু করল। এয়ারপোর্ট থেকে শেষ যাত্রী তুলে শুরু হল হাইওয়ে দিয়ে চলা। বাসে মাল্টি কালচারের যাত্রী। হাইওয়ে কি তাই যেন এই প্রথম আমি বুঝলাম। ড্রাইভার সাহেব গাড়ী স্টার্ট দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্পিডে রেখে যেন ঘুমিয়েই পড়ল। একই গতিতে কোনরকম ঝাকুনি ছাড়া আর বাক না ঘুরে গাড়ী চলতেই থাকল। দুইধারের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলছি। পামট্রির বাগান পাহাড়ের ঢালে ঢালে। মনে হল যেন বাংলাদেশীদের এখানেই কাজ করতে দেখলাম। আমার কাছে পুরো ট্যুরে এই বাস জার্নীর সময়টাই সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এখনও আমি আমার বন্ধুদের এই বাস জার্নীর কথাই বলছি। আপনাদের বলি এই বাস জার্নী প্লেন জার্নীর চেয়ে ভাল। সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেষনে আমাদের পাসপোর্টে সিল মেরে দেখিয়ে দিল যে আমরা সেখানে কাজ করতে পারব না। বিরষ মনে মেনে নিলাম যে আমরা কোন কাজ করে তাদের ডলারে ভাগ বসাব না। বরং কিছু ডলার খরচ করে তাদের কাজ জুটিয়ে যাব। এখানে তাড়াহুড়ায় একটা ভুল আমরা করেছিলাম। তা হল সিল চেক করি নাই। দেখা গেল লীমার পাসপোর্টে এন্ট্রি সিল ভুলে পড়ে নাই। এই কারনে সিঙ্গাপুর থেকে এক্সিটের সময় কিছুটা ঝামেলা হয়েছিল। তাই সকল সময়ে সিল চেক করে নেয়া ভাল। ইমিগ্রেষনের পর কাস্টমস চেকিং। আমার ছেলের সৌজন্যে কাস্টমসের লোকজন কিছু চেক না করেই ছেড়ে দিল। আমরা টাইম মত বাসে আসতে পেরে হাপ ছেড়ে বাচলাম। সাথে ১২/১৫ জনের ইরাকি একটি পরিবার ছিল। তাদের কারো চেকিং শেষ হয়েছে কারও হয় নি। তাদের জন্য বাস আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করল। তারপর শুরু হল আমাদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশ। তার আগে অবশ্য একটি বিরাট নদী/সমুদ্র পার হয়ে এসেছি যার নাম আমি জানি না। বর্ডার পার হয়েই আমি হোচট খেলাম জুরং বার্ডস পার্ককে বর্ডারের এত কাছে দেখে।
বিস্ট্রোতে বাস থামলে আমরা নেমে একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসলাম ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার অধিবাসীতে ভরা সেরাঙ্গুন এলাকায়। ১২০ সিং ডলারের একটি হোটেলে উঠেও পড়লাম। আবার ঘুম। সন্ধ্যার পর এই এলাকা বিচরন করে, ম্যাকডোনাল্ডে খেয়ে আর মোস্তফা সেন্টারে কিছু কেনাকাটা করেই কাটালাম। বাচ্চা আর বউকে রুমে রেখে আমি আবার একটু একা বের হলাম। একা কোথায় গিয়েছি আর কি করেছি তা যেমন বউকে বলিনি তেমনি এখানেও আর বললাম না।