এরও পরে ঢাকায় এলাম, কলেজে ভর্তি হয়ে প্রাইভেট হোস্টেল হলো আমার ঠিকানা। NWD তে ফোন করার সুবিধে ছিল না আশেপাশের কোন দোকান থেকে, মোবাইল ছিল সোনার হরিণ- হাতে গোণা হোমড়া চোমড়াদের হাতে প্রমাণ সাইজের মোবাইল শোভা পেত। গল্প জমা হতো কত কত, সপ্তাহান্তে বাসায় গেলে সেই গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতাম বাবা-মেয়ে... বাজান আগ্রহ নিয়ে বলতেন- ‘ মা রে, তোমার হোস্টেলের গল্প বল, শুনি!’...
বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর পর চরম হতাশা পেয়ে বসে আমাকে... ক’টা বছর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করি, হতাশা-কে লুকোতে গিয়ে আর বাজানের সাথে সব গল্প করি না... নিজের স্বপ্ন আমার উপর চাপানোর চেষ্টা করেন নি বাজান কখনো, পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছিলেন বলেই হয় তো দুজনের স্বপ্ন একত্রীভূত করে সামনে চলার পথ তৈরী হচ্ছিল... বাজান বলতেন- ‘তোমার থিসিসের গল্প বলো,...স্বপ্নের গল্প বলো’...
স্বপ্নের গল্প বলতে গিয়ে স্বপ্ন খোঁজা শুরু হয় আমার আর স্বপ্ন খুঁজতে গিয়েই হতাশাকে পিছনে ফেলে আমি তখন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক... ক্লাশ আর নিজের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো-হাওয়ায় নিজেকে খুঁজি, এর বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় বসে স্বপ্ন বুনি... দিন-মাস-বছর শেষে একদিন হঠাত করেই এর ভবনের বারান্দায় আমি দুর্নীতি আর অনিয়মের গন্ধ আবিষ্কার করি, স্বপ্ন দেখতে গিয়ে পড়ে যাই অস্তিত্বের সংকটে... শুরু হয় লড়াই... বাজান ফোন করে বলেন- "মা রে, আন্দোলন করো কিন্তু খুব বেশী আন্দোলিত হইওনা..." আমি শুনে হাসি- এ আবার কেমনতরো কথা, দূরদর্শী বাজানের কথার সুর সেই সময় ধরতে পারি নি, খড়কুটো ধরে তখন বাঁচতে চাইছি... আন্দোলিত হয়ে আমরা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে মৌনতায় প্রতিবাদের ভাষা খুঁজি.. শিশুকাল থেকে বাজান যে শিক্ষা দিয়ে এসেছে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করার, লড়ে যাওয়ার… তারই জের ধরে নিজের ক্যারিয়ার, উপরে ওঠা সব ভুলে গিয়ে আমাদের অনড় অবস্থান প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানকে সকল অশুভ থেকে রক্ষা করার, অমিত তেজ ধরি ভিতরে... আন্দোলিত না হতে বলেছেন ঠিকই কিন্তু দিনশেষে বাজানই ফোন করতেন সবার আগে- বলতেন, "বুয়েটের গল্প বলো, মা"...মাঝে মাঝে বলতাম- "নতুন কোন গল্প তো নেই...", আমার ছেলেমানুষ বাজান'টা বলতেন- "পুরনো গল্প-ই বলো আবার, শুনি..." বাজানের সাথে গল্প গল্প করে নিজের অবস্থানটা-ই যেন আরো স্পষ্ট করে নিতাম, নিজেকে হারিয়ে গিয়েও দিনশেষে ফের খুঁজে পেতাম...
গুচ্ছ প্রস্তাবে আশ্বস্ত হয়ে যখন নেতারা এক্সিট পয়েন্ট ধরে বের হয়ে এলেন, বুয়েট শান্ত হয়ে গেল শুধু আন্দোলিত হওয়া আমার মনের আন্দোলন থামাতে পারলাম না, মনে আর শরীরে তা গভীর ক্ষতের তৈরী করল...বাজানের বুকে মাথা রেখে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করি... অশান্ত আমি তবুও আবারো বুয়েটের গল্প বলেছি বাজান-কে...অর্জনটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি.....
আর তারও পরে এলো ফেব্রুয়ারি।৫ তারিখ। মুখ গম্ভীর দুপুর। কাদের মোল্লার মতো যুদ্ধাপরাধী যখন যাবজ্জীবন কারাদন্ড পেয়ে বিজয় চিহ্ন দেখায় দু আঙ্গুল উঁচিয়ে মেনে নিতে পারি না... একজন দুজন থেকে লাখ দুই মানুষ যখন প্রজন্ম চত্তরে বসে শ্লোগান দেয় "ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই..." আমি তখন বনভোজনে গিয়ে পিলো-পাসিং খেলতে পারি না... আমি সেই দু'লাখ মানুষের ভীড়ের একজন হয়ে গর্ববোধ করি...
একদিনের কথা। কতই বা বয়স আমার! ভাইয়া আর বাজানের মধ্যে চলছে রাজনীতি নিয়ে সংলাপ, হঠাত এক সময় বাজান কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন- "জামাত তো কোন রাজনৈতিক দল-ই না, ওদের তো নীতি-ই নেই", মুক্তিযুদ্ধের গল্প তখনো অজানা...ছোটবেলা থেকে দাড়ি পাঞ্জাবী আর টুপিতে দেখা বাজান-কে যখন একটা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সম্পর্কে এমন কথা বলতে শুনি, অবাকই হতে হয়- চোখ খুলে দেন বাজান-ই, পরিচয় করিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধে নিজে গাড়ী ড্রাইভ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা শহীদ জননী-র সাথে, মুক্তিযুদ্ধের নায়ক তাজউদ্দীন আহমেদ এর সাথে...
যুদ্ধাপরাধী-র ফাঁসির দাবীতে যখন উত্তাল শাহবাগ, খুব কনক্রীট একটা লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া এই আন্দোলনে শরিক হই প্রতিদিনই, আন্দোলনে জড়িয়েও আন্দোলিত না হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি- কিন্তু বাজানের রক্ত আমার গায়ে, চাইলেও নিজের মনকে শাসন করা যায় না... মন স্বপ্ন দেখতে চায়, প্রত্যাশা পূরণ হবে না জেনেও আশা করতে চায়- তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে চায় সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা যাতে দেশপ্রেম আর সৎ উদ্দেশ্যের স্বাক্ষর থাকবে স্পষ্ট...... আর ঝুড়িভর্তি গল্প নিয়ে দিনশেষে প্রতীক্ষা করি সেই ফোনকলের... কখন ফোন করবে বাজান আর আগ্রহ নিয়ে বলবেন,
"মা, শাহবাগের গল্প বলো... "
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:০৫