দুবাই মেরিনা
দুবাই থেকে ফিরে ৩
দুবাই থেকে ফিরে ২
দুবাই থেকে ফিরে ১
২৭ তারিখ রাতে দুবাই এ আমি প্রথমবারের মতো দেখলাম থ্রী ডি ম্যুভি- ট্রন লেগাসী! রাত দুটোতে ম্যুভি দেখে বেরিয়ে এক্সপ্লোর করলাম রাতের দুবাই, কেমন যেন এই কদিনেই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলাম সাংঘাতিকভাবে; এখানে একা একা চলাফেরার স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, নিয়মতান্ত্রিকতা, স্থাপত্য আর সর্বোপরি শহরের প্রতি এখানকার মানুষের এটিচ্যুড- অনেক অনে-ক কিছু শেখার আছে আমাদের এই শহরের কাছ থেকে!
পরদিন শুক্রবার দুবাই এ আমার শেষ দিন- ফুজাইরা যাওয়ার কথা থাকলেও বাদ দিলাম ওই প্ল্যান; দুবাইতেই বেশ কিছু জায়গা দেখা বাকী রয়ে গেছে ওগুলোই দেখব সারাদিন রিলাক্সড হয়ে ঘুরে ফিরে একা একা! রাতে রাসেল ভাইকে ফোন দিলাম, দুবাই এসে এলাকার ভাইয়ের সাথে দেখা না করে চলে যাবো তা কেমন করে হয়। রাসেল ভাই সকালে আসলেন দেখা করতে এবং এতোদিন কেন উনি আমাকে সময় দিতে পারেন নি তার জন্যে স্যরি বলে বলে শেষ হয়ে ২৮ তারিখ সারাদিন আমাকে দুবাই দেখাবেন বলে ঘোষণা দিয়ে দিলেন! আমি যতোই উনাকে নানান কথা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করি উনি ততোই তার সময় না দেওয়ার জন্যে অনুতপ্ত হন। বুঝলাম, পড়েছি মোগলের হাতে; কিন্তু সকালের খানা খেতে যখন উনি আমাকে জোর করেই ট্যাক্সিতে চড়িয়ে কে এফ সি তে নিয়ে গেলেন আর বললেন সারাদিন ট্যাক্সিতেই চড়াবেন (উনার গাড়ী ওয়ার্কশপে বলে বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন)তখন আ্মি একেবারেই নেই, আমার শেষ দিনটা একা আনমনে ঘোরার পরিকল্পনার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল দেখে নিশ্চুপই হয়ে গেলাম!
মেরিনা বীচে
তবে ট্যাক্সিতে শেখ যায়েদ রোড ধরে যেতে যেতে অন্য রকম ভিউ পেলাম দুপাশের; ছবি তুলি বলে আমি সব সময়ই বসি গাড়ীর সামনে! দু পাশে উঁচু উঁচু ভবনের সমুদ্র কেটে কেটে সামনে যেতে ভালো লাগছিল; গন্তব্য দুবাই মেরিনা! সমুদ্রর মাঝে ঢুকে যাওয়া দুবাই মেরিনায় হেঁটে বেড়ালাম এ মাথা থেকে ও মাথা- গ্র্যান্ড আর আনরেস্ট্রিক্টেড প্রবেশ পথের সব ভবন পথচারীকে নিজের মাঝে ডেকে নিবে বলেই যেন মাথা উঁচু করে দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে! মেরিনা বীচ আর মেরিনা মলে ঘোরাঘুরি শেষে চলে এলাম পাম আইল্যান্ডে! এর আগে রাতের পাম জুমেইরাহ দেখেছি, আজ ঝকঝকে দিনের আলোয় আটলান্টিস থেকে পাম গাছটার ঠিক মাঝ বরাবর মেট্রোতে চড়ে এলাম নাখীল পর্যন্ত, আর দুপাশে দেখলাম তার পাতায় গড়ে উঠা ইমারত আর ফাঁক দিয়ে দিয়ে সমুদ্রের পানির বয়ে যাওয়া! পাম জুমেইরাহর কনস্ট্রাকশন শেষ হয় নি এখনো রিসেশানের কারণে বন্ধ আছে! কিন্তু সেই অসমাপ্ত পাম গাছটিই অনেক সৌন্দর্য আর অনেক গল্পের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! নাখীল থেকে ট্যাক্সিতে চলে এলাম এমিরেটস মল এর স্কিওয়ার্ল্ডে, কৃত্রিমভাবে তৈরী একটুকরো বরফের দেশ দেখে বড় আনন্দ পেলাম!
দুবাই মেরিনা
মেরিনা মল
দুবাই মেরিনা আর মূল ল্যান্ডের মাঝের সমুদ্রের অংশ
পাম জুমেইরাহ থেকে বুর্জ আল আরব
আটলান্টিস
আটলান্টিস হোটেলের ভিতরে
স্কিওয়ার্ল্ড @এমিরেটস মল
এইবার আর ট্যাক্সি না, রাসেল ভাইকে নিয়ে জোর করেই আর টি এ এর কার্ড করিয়ে এমিরেটস মল থেকে চড়লাম মেট্রোতে আর মজার ব্যাপার হলো উনি দুবাইয়ে থেকেও এর আগে কখনো মেট্রোতে চড়েন নি! দিন শেষে দেখা গেল আসলে আমিই উনাকে দুবাই ঘুরালাম কারণ যত জায়গায় আমি উনাকে নিয়ে গেলাম তার কোনটাতেই আগে উনি যান নি, কেবল নাম শুনেছেন! মেট্রোতে এসে দেইরা সিটি সেন্টারে নেমে আমরা গেলাম দুপুরের খানা খেতে দিল্লী দরবারে!
খানা-দানার পর রাসেল ভাই যা করলেন তাতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম; মেরিনা মল বা এমিরেটস মলে জোর করে উনাকে নিরস্ত করলেও এবার আর পারলাম না। একগাদা গিফট কিনে দুহাত বোঝাই করে উনি আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেলেন!
দিনের শুরুতে যতোটা মেজাজ খারাপ লাগছিল, শেষে ঠিক ততোটাই মন ভালো হয়ে গেল, মনে হলো আমার কপালটা সত্যি অনেক ভালো নইলে রাসেল ভাইয়ার মতো কারো সাথে পরিচয় হয়!এ বোধ হয় বিদেশের মাটির গুণ, দেশে জীবনে যাকে দেখি নি, কথা বলি নি বিদেশ বিঁভূয়ে কত দ্রুত সে কত আপন হয়ে যায়!বিদায় নেওয়ার আগে রাসেল ভাই ঠিক বড় ভাইয়ের মতো করে নানান উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি বলতে ভুললেন না যে, এই রকম উরা ধুরা জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও ভালো কাজ নয়! এই বয়সে বিবাহ না করা খুবই ভুল কথা! দেশে শুনে তো গা সহা হয়ে গেছে, সুদূর দুবাইয়ে গিয়েও এ ধরনের কথা শুনে তো আমি হেসেই খুন!
নিজে কিনতে পারি না তো কী হয়েছে ছবি তো তুলতে পারি!
সাঁঝবেলা শুরু হলো রাতের দুবাই ঘোরা, আজ শেষ রাত! কিছুতেই ঘুমানো চলবে না, গতরাতেও না ঘুমিয়ে চষে বেড়িয়েছি, ঢাকায় তো আর কখনো সারা রাত চাইলেই রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বেড়ানো যাবে না! হিমুই পারে না আর আমি কোন ছাড়!বাসে আর মেট্রোতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর কারণে শেষ দিন দেখলাম বেশ অনেক টাকা রয়ে গেছে হাতে, আর এতোদিনে আমি ১ দিরহামকে ১ টাকা ভাবতে শুরু করে দিয়েছি!বেশ তাড়াহুড়া করেই অনেক শপিং সেরে ফেললাম!মলগুলোতে এতোদিন ঘুরে তো কেবল স্থাপতিক গুণ-দোষ দেখেছি, গিফট তো কেনা হয় নি কারো জন্যে কিছু!
আমি আর রফিক ভাই টো টো করে ঘুরে বেড়ালাম শহরের এ মাথা, ও মাথা! আমাদের মিশান ছিল- যে খানাগুলো আমি এতোদিন খাই নি কিপ্টেমী করে বা অন্য কোন কারণে সেই সকল খানা চেখে দেখা! আমি তো ভাইয়াকে বললাম স্টারবাক্স এর কফি তাকে খাওয়াবোই খাওয়াবো, যদিও ম্যাকডোনাল্ডস এ আমি একাই খেয়েছি।শেষ রাতে বাকী ছিল কেবল হাতেমের শর্মা! ওটা কিনে প্যাক করে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম আমরা জেটির পাড়ে, তারপর পা দুলিয়ে বসে খেলাম প্রাণভরে!বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল আজ রাতটাই দুবাইয়ে আমার শেষ রাত!
দুবাই এয়ারপোর্ট
পরদিন এয়ারপোর্টে ভাইয়া যখন আমার মাথায় হাত রেখে আদর করছিলেন (আমি বাবা আর মামা বাদে সাধারণত কাউকেই আমার মাথায় হাত রাখতে দিই না!) আর বলছিলেন- দেশে ফিরে কি আমায় ভুলে যাবে, ভাইয়া? আমি কিছু বলি নি, বিদায় বেলায় কখনোই আমি আবেগাপ্লুত হই না, অন্যদের অশ্রুসজল চোখ আমাকে খুবই অস্বস্তিতে ফেলে তাই যথাসম্ভব সি অফ সীন আমি এভয়েড করি! শুধু এটুকু বলতে পারি- আমি ভুলে গিয়েছিলাম কোন কনফারেন্সে এটেন্ড করতে আমার দুবাই আসা, মনে হচ্ছিল এই দেশে চাকুরী করা ভাইয়ের কাছে ছুটিতে বেড়াতে এসেছিলাম, ছুটি ফুরিয়ে গেছে; বোনকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে এসেছে ভাই! বোনটা নিতান্তই হতচ্ছাড়া, তাই তার চোখে পানি নেই কিন্তু মনে মনে সে ভাবছে কত বড় কপাল করে জন্মালে এমন ভাই পাওয়া যায়!
অঃটঃ এইবার সত্যি সত্যি এই লেখাটা শেষ হইসে! এই উপলক্ষ্যে মিলাদ দেওয়া হইব!