আমার জীবনের প্রথম বিমানে ভ্রমণ সেও আবার মাত্র আধ ঘন্টার জন্যে ঢাকা থেকে কলকাতা। আমার কলীগরা আমায় বলে- তুই আসলেই ফকিরনী কারণ আমি জানালার কাছে বসার জন্যে কান্নাকাটি করছিলাম বাইরের ভিউ এর জন্যে। আধঘন্টা কখন যে কেটে গেল নীচে বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখে আর তারপরেই কলকাতার বার্ডস আই ভিউ। কলকাতায় পৌঁছে প্রি-পেইড ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শিয়ালদাহ, ক্লোক রুমে লাগেজ জিম্মা রেখে নিউমার্কেট- টাকা ভাঙ্গাতে হবে; খুব কনফিউজড আমি- রোজা কি রাখব! এই কয় ঘন্টায় কলকাতার গরমে যা ঘামলাম তাতে মনে হয় আর কিছু না খেলেও পানি ছাড়া বাঁচা যাবে না। কলীগরা বারিস্তায় বসলে নিউমার্কেটের চারপাশে একটু চক্কর কাটলাম- রবিবার, সব বন্ধ; শুধু ফুটপাতের দোকানীরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ভাঁড়ের চা চেখে দেখার জন্যেই রোজা ভাঙ্গলাম; সফরকালীন সময়ে রোজা রাখা ফরজ না- রেজা ভাইয়ের ফতোয়া মেনে নিলাম।

আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ

উপর থেকে কলকাতা
ফোরামে ঘুরাঘুরির আইডিয়া আমার পছন্দ হয় নি- দলের একমাত্র আমিই কলকাতায় প্রথম, তাই কলকাতাকে গিলতে চাচ্ছিলাম অল্প সময়টুকুতে। ফেরার সময় একদিন থাকা হবে কলকাতায়, তখনই আমাকে গড়ের মাঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবিঠাকুরের বাড়ী ইত্যাদি দেখানোর মুচলেকা দিয়ে ওরা আমায় শান্ত করল। বিকেল সাড়ে চারটায় রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম দিল্লী যাওয়ার জন্যে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সার্ভিসে মুগ্ধ আমরা পরদিন সকাল এগারটায় পৌঁছলাম দিল্লী; আর তারপর যে কী পরিমাণ দৌড়-ঝাঁপ করে দিপসারে গেলাম- আনদিশার হোস্টেলে গোসল দিলাম- ওকে তুলে (আমার কাবাবে হাড্ডি হওয়ার অপবাদ ঘুচিয়ে) আবার স্টেশনে ফিরে আসলাম তা মনে করলে এখনো আতঙ্ক লাগে; বিকেল পাঁচটাতেই আবার শিবালিক এক্সপ্রেস ধরতে হবে কলকায় যাওয়ার জন্য।

মেট্রো স্টেশন, দিল্লী
আমরা শিবালিক এক্সপ্রেসে এখন ছয় জন- লেখার কষ্ট কমানোর জন্যে আদ্যক্ষর ব্যবহার করতে হবে- শি ভাই আর লি আপু, র ভাই আর অ আপু, আর আর আমি মি; রাত ন’টায় পৌঁছলাম কলকায়। প্ল্যান ছিল স্টেশনেই রাত কাটিয়ে দেওয়ার; ভোর পাঁচটায় সেই প্রতীক্ষিত টয় ট্রেনে ভ্রমণ। স্টেশনের রেস্টরুম খালি না থাকায় আর সকালের জার্নিটাকে এনজয়েবল করার প্রয়োজনে এই ট্যুরে আমরা প্রথম কোন হোটেলে উঠলাম চার-পাঁচ ঘন্টার বিশ্রামের জন্যে।
ভোরে যখন আমাদেরকে নির্ধারিত ট্রেনটি দেখানো হলো, অবাক হলাম- এক বগীর একটা কিউট ছোট্ট ট্রেন- চালকের পেছনে বসে আমরা; সত্যিই খেলনা আর চারপাশ ট্রান্সপারেন্ট, মাই মাথার উপর ছাঁদ পর্যন্ত। আমরা তো উত্তেজিত খুবই কারণ রেল মটরে তখন আমরা ছ’জন বাদে একটি পরিবার শুধু- বাবা, মা আর ছোট্ট একটা ছেলে। আগেই ইন্টারনেটে (Click This Link ) জেনেছিলাম এই জার্নি সম্পর্কে- অনেক টানেল, ব্রীজ আর পেপুঁ করে আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথে টয় ট্রেনে চলার কথা। ভোরের আলো ফুটল ধীরে ধীরে, একেকটা টানেল আসে আর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি ছবি তোলার জন্যে, টয়ট্রেনের দুলুনীতে ছবি কেঁপে যায়; অপেক্ষা করি পরবর্তী টানেলের। এক্কেবারে পেছন দিকে বসে উল্টোদিকে চেয়েছিলাম, আর তাই টানেল আসলেই অ চিতকার করত আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়তাম অপারেশন টানেলে। তবে মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল- পাহাড়ের গায়ে পাহাড়কে রেসপেক্ট না করে তৈরী করা বহুতল ভবন দেখে।
এবং অবশেষে শিমলা- jab we met এ দেখা শিমলাকে এখন দেখছি দু’চোখ ভরে। হোটেল রুম থেকে দেখা যায় শিমলা শহর আর গ্লেন। ব্রিটিশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শিমলায় এখন বলা যায় গ্রীষ্ম, বরফ ঢাকা শিমলা নয় দেখছি পুরোপুরি সবুজ এক শিমলা।

টয় ট্রেনে শুধু আমরা আমরাই

মিশন টানেল ১

মিশন টানেল ২

মিশন টানেল ৩

মিশন টানেল ৪

কলকা টু শিমলা- টয় ট্রেন থেকে ১

কলকা টু শিমলা- টয় ট্রেন থেকে ২

কলকা টু শিমলা- টয় ট্রেন থেকে ৩

শিমলায়
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়লাম শিমলা এক্সপ্লোর করতে- প্রথমেই কুফ্রি, মাইক্রো থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয় উপরে ফাগু ভ্যালীতে। জানতাম, শীতকালে এই ভ্যালীতে স্কিইং হয় বরফে- এই বরষায় কেন সেখানে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। কাঁদাময় রাস্তায় ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় অ আর আ এর চিতকারে অন্যদের কানে তালা লাগার যোগাড়। কিন্তু এত্ত কাঠখোড় পেরিয়ে উপরে গিয়ে আমরা হতাশ। সারি সারি ঘোড়া আর সেগুলোর গায়ের গন্ধ ছাড়া তেমন কিছু মিলল না। মেঘে ঢাকা থাকায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না চারপাশে, নইলে হয় তো উপর থেকে সুন্দর ভিউ পাওয়া যেত নীচের পাহাড়ী শহরের। যে মন্দিরগুলো দেখানোর নাম করে উপরে নিয়ে আসে তারা, সেগুলো সাম্প্রতিক কালে করা দুর্বল স্থাপত্য রুচির পরিচায়ক। নিজেরা স্থপতি হওয়ায় হয় তো আমাদের প্রত্যাশা বেশী। যেখানে ভারতের অনেক জায়াগার মন্দির অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন, সেখানে এরকম নব্য কিছু মন্দিরকে পুঁজি করে ওদের লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের রূপী নিয়ে ঘোড়ায় চড়ানো ব্যাপারটা খুব বাজে লেগেছে। অন্যেরা অনেক বিরক্ত হলেও আমি আর র ভাই ওদেরকে বোঝাচ্ছিলাম যে, এই ট্যুরের পর ঘোড়ায় চড়াটা আমাদের কাছে একটা মজার স্মৃতি হিসেবে থাকবে আর হাসতে হাসতে আমাদের পেট ফেটে যাবে তখন এই ভেবে যে ভয়ে সেদিন কী চেঁচামেচিটাই না করা হয়েছিল!! নামার সময় সেই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় খানিকটা ভয় পেলেও একদম গম্ভীর থেকে আমি আমার ভাব বজায় রেখেছিলাম।

ফাগু ভ্যালী

নালদেহরা, শিমলা
ফাগু ভ্যালী (আমার সংগীরা একে এর পর যে নামে ডাকা শুরু করল, তা আমি মুখে আনতে পারছি না; নিতান্তই ভদ্র বলে) ভ্রমণের শিমলাবাসীরা আশেপাশের যে কয়টা জায়গার কথা বলছিল (ইন্দিরা গান্ধী হলিডে হোমস, মিনি জু) দেখার কোন আগ্রহই পাই নি। মনে হয় নালদেহরাও যেতাম না যদি না মাইক্রোটা ভাড়া করা না হত।যাওয়ার সময় ভয় পাচ্ছিলাম- হয় তো সেখানে গিয়েও দেখব- ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে- ২৫০ রূপী আর ৩৮০ রূপী ভাড়ার স্লিপ নিয়ে। নালদেহরা গলফ কোর্সের কাছে যখন নামি তখন প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। এখানেও ঘোড়া, তবে আশার কথা ঘোড়ায় চড়াটা বাধ্যতামূলক না। ভিতরে ঢুকে বেশ খানিকটা ঘুরে আসলাম পায়ে হেঁটে। সন্ধ্যায় জঙ্গলের পাইন গাছ আর মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় অপূর্ব লাগছিল চারপাশ। কুফ্রী আর নালদেহরার মাঝামাঝি জায়গায় দেখলাম ইংরেজদের এক প্যালেস- এখন ওবেরয়দের হোটেল।
আগামীকাল শুধু শিমলা শহর দেখব- ঘুরে ঘুরে রিলাক্সড হয়ে সময় নিয়ে এই পণ নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু ফ্রেশ হয়েই বেরুলাম রাতের শিমলাকে আবিষ্কার করতে। শিমলার মল রোডেই ছিল আমাদের হোটেল; তাই একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে। মলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম, মুগ্ধ হলাম রিজ আর চার্চ এর লাইটিং দেখে। এই প্রথম মনে হলো এতখানি কষ্ট করে শিমলায় আসা সার্থক হলো। রাতের শিমলা মন কেড়ে নিল আমাদের।

রাতে চার্চের সামনে
পরদিন সকালে সবাইকে ঘুমে রেখে আমি বেরুলাম ভোরের শিমলা দেখতে। বিধান সভার বিশাল ভবনকে বায়ে রেখে নামতে থাকলাম নীচের দিকে আর মুগধ হয়ে দেখছিলাম শিমলার রূপ। সকালে নাশতার পর ফিরে গেলাম সেই রাতের জায়গায়- দিনের আলোয় নতুন করে আবিষ্কার করলাম মল আর রিজকে। ইন্দিরা গান্ধী যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এক বুড়া চাচা সেখানে হিমাচল প্রদেশীয় পোষাক পরাচ্ছিলেন সবাইকে- স্মৃতি করে রাখার জন্য। আ এর শখ হলো খুব- কি জানি কেন আমারও লোভ হলো। আমার কলীগরা খুব অবাক আমার ইচ্ছা প্রকাশে- পুরোদুস্তোর শার্ট জিন্সের উপর ওই অলঙ্কারসমৃদ্ধ পোষাক পরতে চাওয়ায় বুড়া চাচাও অবাক। লি আপু তো বলেই ফেলল- একমাত্র এই পোষাকেই নাকি আমার ছবি দেখিয়ে আমায় বিয়ে দেয়া যাবে, প্রমাণ করা যাবে আমি মেয়ে। নানান ভুংগীমায় (ঝুড়ি নিয়ে পেছনে, কলসী কাঁখে)

বেশ খাড়া এই রাস্তায় চলার পথে এক ইংরেজের বাগান বাড়ীতে ঢুকেছিলাম, বেশ সুন্দর গ্রীন হাউস করেছিলেন ভদ্রলোক, কিন্তু বর্তমান ভাড়াটিয়াদের কাছে বড় অযত্নে আছে সেই বাগানবাড়ী। যাওয়ার পথে এক সর্দারজী আমাদের সংগী হলেন (অফটপিকঃ শিমলায় সর্দারজীদের দেখে আমি আর আ এক্কেবারে কাইত



শিমলা ১

ট্রাডিশনাল হিমাচল প্রদেশীয় পোষাক

দ্য রিজ

মল ও চার্চ

ইন্দীরা গান্ধী দাঁড়িয়ে

জাখো মন্দির যাওয়ার পথে
জাখো মন্দির থেকে নেমে রাত দশটা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করলাম মল আর রিজের আশেপাশের জায়গাগুলোতেই। ছাইল প্যালেসে যাওয়ার ইচ্ছে হয় নি; সব ভবনের তো একই ক্যারেক্টার এখানে। কিন্তু খুব উপভোগ করছিলাম মেঘে ঢাকা সাঁঝবেলার শিমলা- যখন হঠাত করেই নীচের পাহাড়গুলোতে সব আলো এক সাথে জ্বলে উঠে। মেঘে ঢাকা ঝাঁপসা চার্চ আবার একটু পরেই সবকিছু পরিষ্কার- এ যেন এক লুকোচুরি খেলা। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলে রিজে বসে ফটোসেশন করলাম শেষবারের মতো, শিমলাকে টাটা বাই বলে দিলাম কারণ পরদিন সকালেই যাত্রা করব মানালির উদ্দেশ্যে।

শিমলা ২

শিমলা ৩

রাতের হাত কেঁপে যাওয়া শিমলা

শেষ রাতের চার্চ

ঐশ্বরিক আলো (অ আপুর মতে)

লাল আলোয় শিমলায়
সবুজ আলোয় শিমলা

টা টা বাই বাই শিমলা
পুরো ট্যুরের একটি চিত্র পেতে ক্লিক করুন......
টয় ট্রেনের দুলুনীতে চারপাশটা দেখতে ক্লিক করুন।
ঘোড়ায় চড়ার ভিডিও টা শেয়ার করার ইচ্ছে হলো...