চাক ছেড়ে হঠাৎ উড়াল দিলো বাতাস যে দিকে বয়
উঁচু মগডালে পড়ে আছে শুভ্র মোমের রূপালী ঘর,
নির্লিপ্ত চতুর বসন্তের বহু দিন পর বৃষ্টি এলো
মৌচাক থেকে চুয়িয়ে পড়ছে মধু নয়,
ফোঁটা ফোঁটা সপ্তবর্ণ জলের প্রিজম
শেষ মধু চুষে উড়ে গেলো মিথিলার সোনালী মৌমাছি,
তারা ফুল পরাগের ঘ্রান নিয়ে বসে আছে
আমার জন্মান্ধ চোখের কিনারে,
অথবা তুমিও চোখ বুজে বসো
প্রকৃত অন্ধের ছদ্দবেশে
চোখের ভিতর মধু ধরো,
ওরা এসে বসুক চোখের মোম ঘরে।
আমার না বলা কথা রক্তে মিশে গেছে
কথা বললেই বক্তপাত ঘটে যায়;
আর যারা ঘুমের ভিতর কথা বলে,
অথবা সমুদ্র ভ্রমনের স্বপ্নে পোষাকের সুতোয় লবণ
আর বালি নিয়ে আবার তলিয়ে যায়
নিজের ভিতর নিজে,
তারাতো এই আহত রাত্রির বাতাসেও মোম জ্বেলে দেয়,
শোক-গীতি গায়,
ঘরে ফেরে, কম কথা বলে,
মোজা খুলে পা’য়ে জমা সময়ের গন্ধ বুঝে নেয়।
রাতের বিপন্ন সিড়ি বেয়ে এই অশূন্য আকাশ আরও উপরে উঠে গেছে ,
প্রেম তারও অধিক দূরে যায়
আরও আরও নক্ষত্রের মত দূরে দূরে তুমি আমি বসে আছি পাশাপাশি যেনো।
জাগিয়ো না,
ঘুমের ভিতর মৃত সব মমি ইঁদুরের চার পায়ে ভেঙে দিচ্ছে পিরামিড
বলে দিচ্ছে ইতিহাসে না লেখা হারানো কথা;
জাগিয়ো না,
মৃত্যুর শীতল সাদা ঘোড়া তাকেই উড়িয়ে নেবে;
এই স্বপ্নের বিস্তীর্ণ চিরহরিৎ মখমল ঘাসের নিরব বনে
এক ছোট্ট হ্রদের জলজ তলে আকাশ ঘুমিয়ে আছে,
যে নিদ্র-ভঙ্গ করবে প্রবল-প্রতাপে এই অনন্তের
সাদা ঘোড়া তাকেই উড়িয়ে নেবে।
কথা বললেই রক্তপাত ঘটে যায় গোপনে গোপনে
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে যায় তরল উচ্চারণ
ঘুমের ভিতর মগজের উথাল ইচ্ছার রক্ত নদীর গভীরে
বাঁচিয়ে রেখেছো স্বপ্ন হাঙরের দাঁত;
স্বপ্ন দেখি,
স্বপ্ন দেখি আমার মাথার উপর এসে পড়ছে
পোড়া উল্কার পাথর,
আর পারদ জমছে মাথার শিরায়;
একদিন করোটির হাড় পোষাকের মত খুলে নিলে যৌন-বোধে--
মগজের পরিবর্তে মাথায় ধারণ করে আছি
আয়না বসানো গোল বল,
যা কিছু সত্য তমোহর এসে পড়ে
এই বদলে যাওয়া স্নায়ুর ঘন ফলকে
প্রতিফলন সূত্রে ফিরে যায়,
অনুভব করি আলো এসেছিলো,আলো;
স্বপ্ন দেখি,
স্বপ্নে দেখি
এক বাইসন ডুবে যাচ্ছে মিসিসিরির চোরাবালুতে,
ওর নিঃশ্বাসের শীতল হাওয়ায় জমে যাচ্ছে বাতাসের সরুরেখা,
কে যেনো রাত্রির বিষন্নতা ছিড়ে
গ্রহন লাগা চাঁদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে
চকমকি পাথরের ফলা বসানো সুতীক্ষ্ণ তীর
তবে কার কথা লিখে রাখে ইতিহাসে,
কার!
না-ঘুমানো বিরক্ত মানুষ ডুবে যায়
ডুবতে ডুবতে পারদ নদীর অতল থেকে বাঁচতেই চায়,
অনন্ত প্লাবনে সাঁতারে হারানো হাত
আর ভাঙ বিক্ষত পা নিয়ে
হিমাঙ্ক শীতল কোন অচিন শহরে
গুড়ো হাড়ের যন্ত্রনা নিয়ে সেই লিখতে বসে ইতিহাস;
কার কথা লিখে চলে।
ভেবে চিন্তে মুছে ফেলি পদ-ছাপ, দেহ-ছায়া
এভাবেই এক ছায়াদেবীর পিছু পিছু হারিয়ে গেলাম সবুজ বনের ঘাসে, ঐ ঝর্ণার তীরে পাথর যেভাবে বেড়ে ওঠে মাটির আড়ালে, বুকের ভিতর দিনদিন বেড়ে ওঠা জৈব পাথরের হাড় নিয়ে আমি আর কত দূরেই বা যেতে পারতাম -- পোষাকের উপর আমার নিজের ত্বক পরে নিচ্ছি; ফলে যতবার পোষাক বদল হয় ততবার এই চামড়াকে একবার ছিড়ে রক্ত-আঁঠায় শরীরের পর গেঁথে নিতে হয় একাএকা। সমস্ত দেহেই ধারণ করেছি মন-- আজ কোথায় আগুন, ব্যথা রেখে যাবে। বাসনার ডানা শূন্যতার অধিক নির্জন রসাতলে দেহের সঞ্চয়, মাত্র এই ব্যর্থ হাড় ইঁদুরের মত উঠে এলো সোনালী ঘাসের মাঠে; এরপর পেশী গলছে ত্বকের গভীরে; এক কালো চামড়ার বল হয়ে ত্বকের উপর জন্ম দিচ্ছি লোম, গড়িয়ে চলছি গভীর থেকে গভীর বনপথ-- তাড়া করছে সবুজ ঘাস-ফড়িঙের ধারালো পা আর বন কুকুরের নাক। নলখাগড়ার বনের ভিতর ভেসে আছি গোপনে পালিয়ে।
ঝর্ণার কাছেই ছিলো সাদা ময়ূরের উপত্যকা, আজ তারা পালকের রঙ ধুয়ে নিচ্ছে-- কেকারব ভিজে যাচ্ছে অন্ধকার বৃষ্টি রাতে -- আমিও দেখছি এই বনের যাদু খেলা; ভাঙা মৃৎপাত্রের ’পর সেই ভাঙনের সুর ধুলোর মত মলিন পড়ে আছে। মূলত ঐ সুর আজ লাল রঙের তরঙ্গ চুষে নেয় মাটির অতলে। প্রত্ন-ফসিলের আত্না হয়ে তারা পাতালেই লাভার নদীর তীর ঘেসে ভেসে যেতে দেখেছিলো সেই ডুবে যাওয়া বাইসন।
এই কি তবে না বলা প্রাক-ইতিহাস। স্বপ্ন বারবার পাপে ভরে ওঠে, আসলে প্রতিটি অলস জীবন সত্যমিথ্যাহীন, নির্বাপিত, পাপশূন্য। পাথর-ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে ভোরের বাতাসে।
কোন আশা আজ আর আমাদের বাঁচিয়ে রাখে না।
এক রাত থেকে আরেক নিস্তব্ধ আধো-অন্ধকার ভোরে
বাতাস উড়িয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে নক্ষত্র-পশুর চোখ
তবে দুরত্বই শেষ পরিমাপ,
কেননা সূর্যের নিচে নিভে যায় আলো-বর্ষ দীর্ঘ নক্ষত্রের পথ,
যদিও তাদের ছিলো দৃশ্যহীন বিভ্রান্ত ইথার সাঁতারের জ্ঞান
ছিলো অধিক সচ্ছল কোন যাত্রাপথের গতি
পারদ নদীর ’পর এতো এতো যুক্তিহীন নিরেট গোধূলি রক্ত!
আমি মৃত্য প্রচারক ছাড়া আর কি বা হতে পারি
দেহের অধিক কোন শূন্যতা লাফিয়ে নামছে ঝাঁকে ঝাঁকে।।