গল্পটা কোথা হতে শুরু করা যায় এই নিয়ে একটা ধন্দ মনে কাজ করে। প্রথমত গল্পটা শুরু করা যেতে পারে অর্ণবের গান দিয়ে। অর্ণবের গান আসলে প্রথম উপাদান নয়। এটা হতে পারে সর্বশেষ পথ। তারপরও আমরা শেষ দিক দিয়েই না হয় শুরু করলাম। তাই আমাদের গল্প শুরু হয়ে গেলো।
গত কয়েকদিন ধরে মনের ভেতর বাহিরে ‘আমায় ধরে রাখো, আমায় বেঁধে রাখো’ গানটি বাজতে ছিলো। ফলশ্র“তিতে এই স্বপ্নের অবতারণা। স্বপ্নটিকে তাই আমরা অবচেতন মনের একটা অবস্থাই ধরে নিতে পারি। ধরে নিতে পারি অবচেতনে এই ভাবনাটাই কাজ করছে তীব্রভাবে। এই ভাবনা আরো গভীর থেকে গভীরতর হয় যখন চারপাশের বন্ধুরা বিয়ে করে একে একে সন্তান-সন্ততির জনক-জননী হতে শুরু করলো, তখন তারও হয়তো বিয়ে করে সংসার কর্ম করার বা জনক হওয়ার আকাঙ্খা তৈরি হতে শুরু করে। যদিও সে জানে বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করা তার পক্ষে রীতিমত অসম্ভব। সে অর্থে ‘বিয়ে’ করা যায় কেবল একটা যৌন জীবনের নিশ্চয়তার জন্য। তাই বিয়ের ভাবনা তার মাথায় জেঁকে বসতে পারে। বস্তুত এই ভাবনা তার বাস্তবে রূপ দেয়া এই মুহূর্তে হয়তো স্বপ্নেরও অবান্তরের মতো। অথবা অবান্তরই হয়তো। কিন্তু কল্পনাতো আসলে বাস্তবেরই এক মোহময় পৃথিবী। এই কথা তার অজানা নয়। সে খুব ভালো করেই জানে মানুষ যা স্বপ্নে দেখে তার অনেকটাই তার বাস্তব উপাদান থেকে নিয়ে কল্পনায় শুধু সে একটা রঙ মাখায় মাত্র। আর সেও সেই একই গল্পের অবতারণা করেছে, আর কিছু নয়। তার স্বপ্নটাও তার ভাবনারই একটা প্রতিফলিত রূপ হিসেবে দেখা দেয়। যখন স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তখন তার মনে হতে থাকে আর কিছুক্ষণ দেখতে পারলেই তো হতো। ফলাফলটা হাতে-নাতে জেনে যাওয়া যেতো। কিন্তু ফলাফলটা অধরাই থেকে গেলো তার। এই স্বপ্নের কোনও ফলাফল সে শেষ পর্যন্ত পাবেনা বলেই ধরে নিচ্ছি। তারপরও আমরা ধারণা করতে পারি এই স্বপ্নের বিস্তারিত বৃত্তান্ত নিয়ে কোনও স্বপ্ন বিশারদের কাছে হাজির হলেও এই সমস্যার সমাধান আসতে পারে। কিন্তু স্বপ্ন বিশারদদের সে বিশ্বাস করে না। তার মনে হয় স্বপ্ন বিশারদরা মানুষের স্বপ্ন নিয়ে খেলা করে। যারা স্বপ্ন নিয়ে খেলা করে তারা আর যাই হোক মানুষ হিসেবে সৎ অবশ্যই নয়। এই রকম নানান ধন্দের ভেতর আর তার স্বপ্নের গন্তব্য নিয়ে সে বিচলিত হয়। কিন্তু আস্থা হারায় না, মনে করে এর অবশ্যই একটা সুদূর প্রসারী কারণ রয়েছে। যার দরুণ আজ হোক কাল হোক বিয়ে তো করতেই হবে। সেজন্য প্রস্তুতিও নেয়া প্রয়োজন। ফলে একটি চাকরির জন্য সে হন্যে হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবতে থাকে, একটা চাকরি এবার যোগার না করলেই নয়। সামনেই তো সুদিন। একটা চাকরি মানে কিছুদিনের অভিজ্ঞতা, কয়দিন পর নতুন চাকরি। আর এভাবে বেশকিছু অভিজ্ঞতার ঝাপি ভারি করে বড় কোনও কিছু করতে না পারলে বিয়ে করা জুটবে না। অন্তত স্বপ্নের বিয়েতো নয়ই। অথচ স্বপ্নের মানুষইতো তার নেই! ভেবেই হাসতে হাসতে খুন। গাছে কাঁঠাল গোফে তেল দেয়ার মতো স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেলো তাহলে। স্বপ্নই তো বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন আছে বলেইতো সেও বেঁচে আছে।
দুইদিন এই স্বপ্ন নিয়ে কোনও ভাবনা সে ভাবেনি। যতটা ভেবেছে সে একটা চাকরি নিয়ে। আসলে তাকে চাকরি দিবে কে? কেন দিবে? এই ভাবনাগুলোই গত দুইদিন বেশি মাথায় এসেছে। এখন কেবল একটা চাকরির চিন্তাই মাথায় ঘুরঘুর করছে তার। তবে এই স্বপ্নকে সে অতিক্রম করতে পারছেনা তারপরও। সারাদিন শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নেংটা কালের বন্ধু রাশেদ ফোন করলো।
এই রাশেদ তার মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেয়। নেয় আর জ্বালা বাড়ায়। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে না করতেই রাশেদ বিয়ে করেফেলেছিলো। অথচ তখন তার কোনও রোজগার নেই। রোজগারের পথও নেই। আসলে দীর্ঘদিনের প্রেম, দুইজন দুই মেরুতে বসবাস করলে যদি এই প্রেম আর কোনও গন্তব্য না পায় তবে তো বিপদ হয়ে যাবে। এ¤িœতেই মেয়েটার প্রতি রাশেদ কিছুটা দূর্বলও ছিলো। এই দূর্বলতাই রাশেদের বিয়ের ব্যাপারে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। যখন মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে যেদিন সবাই যার যার বাড়ি ফেরার জন্য বাক্স পেটরা গোছাচ্ছিলো তখন রাশেদ গো ধরে, তোরা বাড়ি যাবি যা কিন্তু আমি একলা বাড়ি যাবো না।
- একলা বাড়ি যাবি না মানে?
- নীলুরে সাথে নিয়া যামু।
- এইটার কোনও মানে হয়?
- মানে হয় না? প্রয়োজন বোধে বিয়ে করে বউ বানিয়ে তারপর নিয়ে যাবো। তবু একলা যাবো না।
কি আর করা যাবে তখন। বাকী আরও যারা বাড়ি যাওয়ার জন্য বাক্স পেটরা গুছিয়েছিলো তাদের ডেকে এনে, কাজী’র বাড়ি গিয়ে একজনকে উকিল বাবা করে আর দুইজনকে সাক্ষী করে এক কেজি কমদামী মিষ্টি খেয়ে বিয়ের কবুল বললো রাশেদ আর নীলু। ক্যাম্পাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে এখন সংসার জীবনের শুরু।
সেই রাশেদের ফোন পেয়ে তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত আবার মনে পড়ে গেলো। বন্ধুকে গড়গড় করে বলেদিলো গত দুইদিন আগে দেখা স্বপ্নের সকল কথা। বন্ধুতো শুনে মহাখুশি। বলে- দোস্ত, তোমার এহন তো বিয়া করা ছাড়া উপায় নাই। আমরাতো সবাই এডভান্স ছিলাম বইলা এই স্বাদ আরো আগেই নিয়া নিলাম। কেবল তুমিই এহন বাকী রইলা। এটুকু বলেই ক্ষান্ত দেয়নি তার বন্ধু। বরঙ আর এক হাত এগিয়ে এসে মোক্ষম জায়গায় খোঁচা দিয়ে বসে। আর কয়দিন চলবো এইভাবে? কিন্তু কোনও কিছু বলার নাই তার। কারন সে জানে, স্বপ্নের ঘটনা বাস্তবে ঘটেনা। তাকে কোনও মেয়ে বিয়ে করতে রাজিই হবেনা। কারন একাধারে বেশ কিছু। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরের মতো আমরা দেখি কি কি কারণে তাকে কোনও মেয়ে বিয়ে করবে না। এক. সে এখনও পুরোদস্তর ক্যাম্পাস ছাড়েনি। আজ এই ছোট ভাই এর রূমে তো কাল ঐ ছোট ভাই এর রুমে। দুই. পরিবারেরও তেমন কোনও অর্থনৈতিক অবস্থা নেই যে চাকরি না করলেও চলবে। তিন. তদুপরি এখনো কোনও প্রকার সে কোনও রোজগার করে না। চার. এখনো কোনও কিছুর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে সেই কাজ সফলভাবে সমাপ্ত করার উদাহরণ নেই তার। পাঁচ. এখন পর্যন্ত যে কোনও দায়িত্বই নিয়ে সফল হতে পারেনি সে সংসারের দায়িত্ব যে নিতে পারবেনা তা চারপাশের সকল মানুষেরই জানা। এমন পুরুষের সাথে সংসার করার অর্থে কোনও মেয়েই রাজি হবেনা। সুতরাং তার সাথে বিয়ের পিড়িতে একসাথে কাউকে বসাতে হলে বড় কিছু করে দেখাতে হবে। তাহলে স্বপ্নের কি হবে?
আপাতত আবার স্বপ্নের কথা বাদ। এবার আবার আমাদের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বড় কিছু করা। কি বড় কিছু, কোন দিকে বড় কিছু বা কিভাবে বড় কিছু এই বিষয়ে চাঁপা পড়ে যায় আমাদের গল্পের নায়কের স্বপ্নের কথা। সেই সাথে স্বপ্নে পাওয়া রাজকন্যার আবছা মুখশ্রীর কথাও। যেই মুখশ্রী তার সামনে আনন্দ আর এক ঝলক স্বস্তির দেখা দিতে পারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় কিছু...
কিন্তু বড় কিছুর দেখা আর সে পায় না। এইভাবে দিন যায় সপ্তাহ যায়; সে ভূলে যায় তার বড় কিছু করার কথা। যা দিয়ে হয়তো ফিরে পাবে সেই আধো আলোতে অতি চেনা অথচ চেনা নয় সেই প্রিয়মুখ। একদিন সে সত্যি সত্যি ভুলে যায় তার স্বপ্নের কথা। ভুলে যায় সে একটি মুখ খোঁজছিলো যা কিনা তার প্রশান্তির ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হবে। ভুলে যায় তার বড় কিছু করার কথা। ভুলে যায় একটি চাকরির খুব দরকার সে কথা। ভুলে যায় একটি নতুন জীবনের স্বপ্নের কথা।
কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? অথচ তার তো থামা আর চলার কোনও কিছুরই লক্ষণ ছিলো না। সে শুধু চাইতো চলুক না...
কিন্তু একদিন আর চলে না। তার মা আর ছোট বোন এসে তাকে ক্যাম্পাস থেকে রীতিমত অপহরণ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় তার সেই পুরনো প্রেম অপ্রেমের ভূবনে। যেখানে সে কাটিয়েছে জীবনের একটি রঙিন অংশ। তার ঘরে নিয়ে যখন তাকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন হঠাৎ আবিষ্কার করে তার সেই স্কুলের গিটার এখনো দেয়ালের হুকে ঝুলে আছে। এই প্রেমকে যে ব্রতি করতে চেয়েছিলো সে, আজ তা হারিয়েছে জীবনের অতল গহ্বরে। সারা বিকেল ঘরে বসে কাটিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হয়ে ঘুরে আসে তার স্কুল আর কলেজের স্মৃতিতাড়িত শৈশব।
ইদানিং কিসের যেনো শূণ্যতা অনুভব করছিলো সে। বুঝতে পারছিলো না। আর এই মায়া আর মোহের ঘোর তার পরিবার অনুভব করে। সন্ধ্যার পর যখন বাড়ি ফিরে তখন মা-বাবাকে তাকে দেখে চুপ করে যেতে দেখে। পরে খবর পায় তার জন্য বিয়ের পাত্রি দেখা হচ্ছে। বিয়ে বোধহয় এবার হয়েই যাবে। দেখতে দেখতে তার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলো। কিন্তু বেকে বসলো সে। বললো- এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই। আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার বিয়ে তার অমতেই চূড়ান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তার প্রতিবাদ ধোপে টিকলো না। এক প্রকার নজরবন্দী করে রাখা হলো তাকে। এইভাবেই বিয়ের দিনটাও চলে এলো। কিন্তু এখনো মন সায় দিচ্ছে না তার। কিন্তু কোনও উপায়ও বের না হওয়ায় সে বিয়ের পিড়িতে বসলো। বিয়ের দিন রাতে বাসর ঘরে প্রবেশ করতে গিয়েও সে করলো না। হঠাৎ মন বেঁকে বসলো। ভাবলো একটা মেয়ের সর্বনাশ তো এমনিতেই করলাম। আরো কেন? ভেতরে যাওয়ার আকাঙ্খাটা তাই মরে গেলো। বাইরে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণের ভেতরই আবার ঘরে প্রবেশ করলো। টেবিলে চিঠিটা একটা পানির গ্লাস দিয়ে চাপা দিয়ে বের হয়ে গেলো। তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী হা করে শুধু দেখলো, কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।
কিছুক্ষণ পরই খবর বেরোল বাপ্পীকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাপ্পী কোথায় কেউ বলতে পারছে না। ছোটবোন আবিষ্কার করলো টেবিলে রাখা চিঠি টা। যাতে লিখা ছিলো-
আমি বলেছিলাম আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করার মতো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই। তোমরা আমার কথা শুনলে না। বলেছিলাম কিছুদিন অপেক্ষা করতে। তাও পারলে না। তাই আমি চলে যাচ্ছি। হয়তো আবার কোনওদিন ফিরবো। তবে সংসারের দায়-দায়িত্ব নিতে বললে কখনোই নয়। আমি সংসার বুঝি না। তাই আমাকে শুধু শুধু সাংসারিক বানানোর চেষ্টা করলে তোমরা ভুল করবে। যদি তোমাদের মনে হয় আমার এমনিতেই সংসারে ফিরে আসাটা প্রয়োজন। তবে অপেক্ষা কর, আমি অবশ্যই ফিরবো। ভালো থেকো।
ইতি
বাপ্পী
আমরা এই পর্যন্ত তার স্বপ্ন আর বাস্তবের গল্পটা জানতাম। পরে এক সময় শুনেছিলাম বাপ্পী সংসারে ফিরে গিয়েছে। একটা ভালো চাকরিও জুটিয়েছে। সংসারই করছে ঠিক সাংসারিক মানুষের মতো।
আর সেই স্বপ্নটার কথা এখন হয়তো ভুলেই গিয়েছে। কারণ স্বপ্নটাই তো শেষঅব্দি বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো তার জীবনে।