আজ থেকে সাতাশ বছর আগে মাহফুজাকে নিয়ে একটি কাব্য লিখেছিলাম; নাম দিয়েছিলাম ‘মাহফুজামঙ্গল’। এ যাবৎ গ্রন্থটির আটটি সংস্করণ হয়েছে; আজ অব্দি কাব্যপাঠক মাহফুজা-পাঠের আনন্দ হারিয়ে ফেলেননি- এটি আনন্দের খবর। এই দীর্ঘ তিন দশকে অনেক কবিতা লিখেছি, অনেক প্রবন্ধ লিখেছি; কিন্তু পাঠকের মাহফুজা-বন্দনার খামতি হয়নি। তবে একটি প্রশ্ন সর্বদা আমাকে শুনতে হয়েছে, কে এই মাহফুজা? এটি যদিও কাব্যপাঠকের সাধারণ কৌতূহল, তবু এতদিনে পাঠক ঠিকই বুঝতে পারলেন, কে এই সোনাজয়ী মাহফুজা! কবির যে একটি বেশি ইন্দ্রিয় থাকে তা তো সবাই জানেন; সে প্রমাণ তো এবারও হয়ে গেল, মাহফুজার জন্মের আগেই কবি জানতেন, যে জাতি সাঁতার জানে না; সেই জাতিকে সাঁতার শেখানোর জন্য একজন মাহফুজার আবির্ভাব হবে। যেভাবে রাম-জন্মের আগেই বাল্মীকি রামায়ন লিখেছিলেন। নজরুল বলেছিলেন, অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ। এখানে নজরুলের অবস্থান ছিল ব্যাপিটস দ্য জনের মতো তারও কতদিন পর একজন এসে মাহফুজার সংবাদ জানালেন; আর সেই মাহফুজা সাঁতারে সোনা জয় করে সত্য প্রমাণিত করলেন, মাহফুজা সত্যিই ভবতারিণী। কিন্তু জাতি কি তা থেকে শিক্ষা নিতে পারল? নাকি মাহফুজা যখন সাঁতারে সোনা জয় করছেন তখন কবি তার নাম নিয়ে ডুবতে বসেছেন। কে তাকে রক্ষা করবে? গতকালও এক বন্ধুকবি মোবাইলে জানালেন, মাহফুজামঙ্গল লেখার জন্য তোমার ব্লাসফেমি হতে পারে। রাখে আল্লাহ মারে কে, এতদিনই যখন বেঁচে আছি। কিন্তু পরিহাস হলো এই- তিন দশক আগে যে গ্রন্থটি লেখার জন্য অনেকে আমাকে মৌলবাদি বলতে পর্যন্ত ছাড়েননি, সেই জাতির কি এমন হলো যে একই কাব্য লেখার জন্য উল্টো ফলের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেবল মাহফুজার সোনা নয়; মাহফুজ-কে নিয়েও কম হচ্ছে না। পত্রিকার পাতা খুললেই এখন তাঁর নাম। গোল্লায় যাক, তা নিয়ে আমার কি; নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তবে মাহফুজামঙ্গল লেখার জন্য অনেকেই আমাকে মাহফুজ বলে ডাকেন, নামের বলি হতে কতক্ষণ। এরই জবাবে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম-
ওরা যখন আমার নাম ধরে ডাকে
আমি কেবলই শুনতে পাই মাহফুজা
আমার তো আলাদা কোনো নাম নেই
লুকিয়ে আছে তোমার নিরানব্বই নামের ভেতর
আমি কি করে করতে পারি সে নামের শরিক
তুমিই তো ডাকতে থাকো মাহফুজ! মাহফুজ!!
এই কবিতাই যে আমার কাল হবে কে জানত! কবিরা অন্যের ভবিষ্যৎ জানলেও যে সব সময় সে নিজের ভবিষ্যৎ জানতে পারবে এমন নয়। না হলে কোন কুক্ষনে আমি এই কবিতা লিখি! আজ দবির-খবিরের আইনজীবী গাজী শামছুর রহমান মারা গেছেন, প্রায় সাতাশ বছর আগে তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এই কবি আইনের দৃষ্টিতে হয়তো কিছুটা ছাড়িয়ে গেছেন, কিন্তু কাব্যের দৃষ্টিতে অনেক বেশি সফল হয়েছেন; বাংলাকাব্যে বর্তমান সংকট এই কবির হাতে একদিন কেটে যাবে। এই গ্রন্থের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; যেখানে দেশের অনেক নামী-দামি সাহিত্য-সমালোকগণ মাহফুজার নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কিন্তু এই মাহফুজ-কে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। কবির সোনার ধান হয়তো নৌকা তুলে নেবে, কিন্তু কবিকে নেবেন বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে গ্রন্থ বাতিলের পরিবর্তে গ্রন্থকারকেই প্যাদানি দেয়া হচ্ছে। এটি কোনো নতুন নয়, যে মানসুর হাল্লাজের আল্লাদারি নিয়ে আজ কারো সন্দেহ নেই, সেই মানসুর হাল্লাজকে যারা হত্যা করেছিলেন, তারাও আজকের মতো মুসলমান ও আইনের ধ্বজাধারি। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দার্শনিক আবু রুশদকে কর্ডোভা মসজিদে ঢুকতে না দিয়ে মুসুল্লিরা তার ওপরে থুথু ছেটাতেন। ইবনে সিনা, আল কিন্দিসহ সকল মুসলিম বিজ্ঞানীকে নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে; খৃষ্টান বিজ্ঞানীদেরও কম সইতে হয়নি। এমনকি ইমাম আবু হানিফাসহ ইসলামি চিন্তাবিদদের যথেষ্ট মুসলমান নয় বলে হত্যা করা হয়েছে। বিজয়ীর ইতিহাস ক্ষণকালীন, নির্যাতনের ইতিহাস চিরকালীন। আমরা যে সব মহাপুরুষের গল্প করি, তা মূলত তাদের নির্যাতন সহ্যের ইতিহাস ভিন্ন কিছু নয়। আমরা রোম সাম্রাজ্য ভুলে গেছি, কিন্তু খৃষ্টের ক্রুশবিদ্ধ চেহারা ভুলি নাই। বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত চেহারা আমাদের আরও আপন করেছে। মানুষ কেউই একদিন এ ধরাধামে থাকবে না; কিন্তু জ্ঞান, স্বাধীন চিন্তা, সত্যের জন্য লড়াই চিরকাল থাকবে। মাহফুজরা নির্যাতিত হবে, মাহফুজারা সোনা জয় করবে- এই জ্ঞান ও সত্যকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। সত্যের পথ কঠিন, ঈশ্বর থাকেন সেই কঠিন পথে, একজন জ্ঞানী একজন সত্যের সাধক সেই কঠিনেরে ভালোবাসতে পিছপা হন না; হলে ঈশ্বরের রাজ্যের গতি থেমে যাবে। ঈশ্বরের সত্য ঈশ্বর-ব্যবসায়ীদের কাছে বন্দি হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৯