somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালবৈশাখী ও ভয়ার্ত একাকিত্ব

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিলির বাসায় পৌছতে এখনো ৫ মিনিট সময় লাগবে। ঠান্ডা বাতাসের প্রচন্ডতায় দূরে কোথায় বৃষ্টি হচ্ছে এবং তা ধেয়ে আসছে তা বুঝাই যাচ্ছে । বাতাসের বিপরীতে ভালো ভাবে ওড়নাটা গায়ের সাথে পেচিয়ে এগুনোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু অল্প পথটুকু যেন শেষ হচ্ছে না। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে অনেক আগেই। উত্তর পশ্চিম আকাশটা যেন একেবারে ক্ষেপে আছে। যেকোন সময় রাগ ঝাড়বে ধরিত্রী উপরে।
ছোট বেলা থেকেই বৈশাখের প্রথম দিনটিতে কালবৈশাখী দিয়ে শুরু হয়ে আসছে দেখলেও কয়েক বছর ধরে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে । বৈশাখের ২য় দিবসেই বৈশাখের উপস্থিতি বুঝতে পারলো। সারাদিন ভালো কিন্তু সন্ধ্যা হলেই আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। অজানা আতঙ্ক তৈরী হয়ে জনমনে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়।
গলি মুখের দোকান দুটির ঝাপ ইতিমধ্যে অর্ধেক নামিয়ে ফেলা হয়েছে। সারাদিনের মতো চায়ের কেতলিটা আর আগুনে পুড়ছে না। যে দুএকজন যারা এতক্ষন বসে ছিলো তারাও বিল পরিশোধ করে বাড়ির পথ ধরছে। সন্ধ্যা হতেই আকাশটা ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে আর ভয়াল কালবৈশাখীর আগমনী বার্তায় সকলেই যেন সতর্ক। প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাভাস চারিদিকে। সামনের বাসার হামিদ চাচা অফিস থেকে রিকশায় এসে ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ভাড়া বুঝে পেয়েই রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললো নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছার জন্য । এরি মাঝে বাসায় প্রবেশ করলো মিলি।

বাসায় পৌছার ৩ মিনিটের মাথায় ঝড়ের প্রচন্ড বাতাস এসে হামলে পড়লো পুরো এলাকার উপরে। লম্বা শ্বাস ছাড়লো মিলি। বাসায় পৌছতে আর কয়েক মিনিট দেরি হলে রাস্তায় ঝড়ের দেখা মিলতো তখন ওর কি অবস্থা হতো চিন্তা করতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। আজ দুপুরের পরে বাসা থেকে খানিকটা দূরে ছোট খালার বাসায় গিয়েছিলো ঘুরতে। বিকাল হতেই আকাশটা অন্ধকার হতে শুরু করলে আগেই বের হয়ে এসেছে খালার বাসা থেকে। খালা ওকে এগিয়ে দিয়ে না গেলে অন্ধকার পথ আসতে ওর সত্যিই বেগ পেতে হতো এদিকে রাস্তায়ই প্রায় পেয়ে বসেছিলো ভয়াল কালবৈশাখী।

ইতিমধ্যে ঝড়ের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। প্রথমে বৃষ্টি তারপর শীলাবৃষ্টি সাথে প্রচন্ড বাতাস। পাশাপাশি দুটি ফ্লাটে নিজেরাই থাকে মিলিরা, দুটি ফ্লাটের অভ্যন্তরীন কোন দরজা এখনো করা হয়নি বলে বাহির দিয়ে অন্য ফ্লাটে যেতে হয়। বাসায় এখন সে ছাড়া ওর মা আর ছোট ভাই আছে। বাকীরা এখনো বাহিরে। বাতাসের প্রচন্ডতায় পাশের ফ্লাটের জানালাগুলো জোরে জোরে শব্দ করেছে। ছোট ভাইকে নিয়ে ওর মা ওপাশের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আটকে পড়েছে।

মিলি এখন একা ফ্লাটে, মা আর ছোট ভাই পাশের ফ্লাটে। বজ্রপাত ও বৃষ্টির তীব্রতায় একফ্লাট থেকে অন্যফ্লাটে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিকট শব্দে পাশের ট্রান্সমিটার বাষ্ট হতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। ঘুটঘুরে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। নিজের শরীরকেও দেখতে পাচ্ছিল না প্রথমে। প্রচন্ড বিদ্যুৎের চমকানী আর বিকট শব্দে বজ্রপাতে মনে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল বারবার।

দরজার কি হোল দিয়ে বাহিরে তাকাতেই চোখে পড়লো সিড়ি দিয়ে খোলা আকাশ। বুঝা যাচ্ছে সিড়ি ঘরের দুএকটি চাল উড়িয়ে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে দিয়েছে। সেখান দিয়েই শো শো বাতাস, বৃষ্টি নেমে আসছে। বাকী টিনগুলো বাতাসের তীব্রতা আর দেয়ালের ঘর্ষনে ভয়ঙ্কর শব্দ তৈরি করছে।
দরজার সামনে দাড়িতেই পায়ে ঠান্ডা পানির অস্তিত্ব অনুভব করলো সে। সিড়ি বেয়ে নেমে আসা পানি দরজার ফাঁক গলিয়ে ভেতরেও প্রবেশ করছে। এভাবে আসলে অল্প কিছুক্ষনেই ড্রইং রুমের অর্ধেক পানিতে ছেয়ে যাবে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না মিলি, পরক্ষনেই পানির প্রবেশ ঠেকানোর জন্য অন্ধকারে হাতড়িয়ে দরজার সামনে দুই প্রস্থ পুরনো কাপড় দিয়ে দিলো।

আবারো প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমক বিকট শব্দে বজ্রপাত। চোখ ঝলসে কান ধরে এলো, নড়তেও ভুলে গেলো যেন মিলি। ধপ করে বসে পড়লো পাশের সোফায়। মিনিট খানেক নড়াচড়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ওর। একাকি বাসায় আতঙ্কে আলো জ্বালানোর কথাও মনে ছিলো না তার। বজ্রপাতের আলোতে যতটুকু ভরশা। একের পর এক বজ্রপাতে আরো ভীতির সৃষ্টি হচ্ছিল মিলির মনে।

ঘরে উত্তর দিক দিয়ে বাতাস প্রবেশ করছিলো। রান্না ঘরের জানালাটি লাগানো হয়নি। সেখান দিয়েই বাতাসের সাথে বৃষ্টি প্রবেশ করে রান্নাঘরটি ভিজিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। দ্রুত জানালা বন্ধ করে আলো জ্বালানোর কথা চিন্তা করতেই ম্যাচ খুজে বৃ্ষ্টির পানিতে ভেজে ম্যাচ পাওয়া গেলো যা দিয়ে আগুন জ্বালানো সম্ভব না। এখনো অন্ধকারেই ছেয়ে আছে পুরো ঘর। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে চারিদিক আলোকিত হচ্ছে কিন্তু সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাতের সাথে আবারো অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে গোটা এলাকা।

মোবাইলের আলোর কথা মনে হতেই নিজের রুমে ছুটে গেলো মিলি। রুমের কোথায়ও রেখেছে ফোনটি কিন্তু প্রয়োজনের সময় খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। শো শো শব্দে বয়ে চলছে বাতাস আর গাছের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ার মটমট শব্দ শুনা যাচ্ছে বাহিরে। আবারো প্রচন্ড বজ্রপাত। কান চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়লো মিলি। ভয় আতঙ্ক ছেয়ে গেছে ওর পুরো দেহ মন। বসা থেকে উঠতে হবে তাই যেন ভুলে গেলো সে। বিছানা হাতড়িয়ে এবার পেয়ে গেলো তার ফোনটি ।
ফোনটি পেয়ে একে একে ফোন দিলো ওর বাবা , ভাই, ছোট খালা আর নিলয়কে কিন্তু কারো ফোনেই ঢুকাতে পারলো না। মিলির বাবা, ভাই কেউ বাসায় ফিরেনি কে কোথায় আছে জানার জন্যই ফোন দিচ্ছিল বারবার কিন্তু সব নেটওয়ার্ক ফেইলড। এ ভয়ার্ত সময় অন্তত নিলয়কে পেলেও চলতো। ও সাহস জোগাতে পারতো, ভয়ার্ত একাকিত্বটা কিছুটা হলেও ঘুচতো কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। ঝড়ের কবলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।

ওদিকে ব্যালকনিতে শুকাতে দেয়া কাপড়গুলো ভিজে যাচ্ছে কিন্তু ব্যালকনির দরজা খুলে কাপড়গুলো আনার সাহস দেখালো না মিলি। জানালার গ্লাস দিয়ে বাহিরের হেলে পড়া গাছ পালা দেখা যাচ্ছে।

মা আর ছোট ভাই আসলো কিনা দেখার জন্য মোবাইলের ক্ষীন আলোতে আবারো ছুটে গেলো দরজায় । না.......... এখনো তারা বের হয়নি, বের হওয়া সম্ভবও না। কিন্তু দরজার কী হোল দিয়ে সিড়ি ঘরের আকাশটা দেখা যাচ্ছে। বারবার আকাশের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো এলাকা , সিড়িঘরের আরো একটি টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। পাশের বাড়ীর ছনিয়াদের ছনের ঘড়টি আছে না সন্দেহ।

ঝড়ের তীব্রতায় আরো বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো। চারিদিক শুধু শো শো শব্দ, বিজলী চমক পরক্ষনেই আকাশের গর্জন , গাছ পালা পতনের শব্দ চলতেই থাকলো।
অনেক সময় পর ধীরে ধীরে বাতাসের তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। মুষল ধরে বৃষ্টির হচ্ছে এখনো। এরি মাঝে দরজায় কষাঘাতের শব্দ পেলো মিলি। বুঝলো, মা বেড়িয়ে এসেছে ওপাশ থেকে। দরজা খুলে দিতেই দেখলো অল্প কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকেই সিড়িঘর দিয়ে বৃষ্টি এসে মাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। ছোট ভাইটি এখনো ওপাশে।
মনে একটু সাহসের সঞ্চার হলো এবার। দীর্ঘসময় একাকি ভয় আতঙ্কে কাটিয়ে এবার যেন বাঁচলো। মুহুর্মুহ প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত, আকাশের ঝলসানি , শো শো শব্দে বাতাস, টিন, গাছপালার শব্দে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো তাকে।

ভাবতে লাগলো ....... যদি বাসায় ফিরতে আর কিছুটা সময় লাগতো তাহলে সে রাস্তায় একাকি কি করতো?
এ ঝড়ের বিপরীতে রিকসা ওয়ালা কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পেরেছিলো?
আসার পথে পাশের বস্তিগুলো যে নড়বড়ে অবস্থা দেখে এসেছে সেগুলো কি এ প্রচন্ড ঝড়ে টিকে আছে?
রাস্তায় দেখা ছোট্ট মেয়েটি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিলো?
ছাদের কোণায় বাসায় বাধা চড়ুই পরিবারটি ফিরতে পেড়েছে নীড়ে?

এভাবে ভাবনার সাগরে কিছুটা সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো মিলি।
মায়ের ডাকে আবার সে সম্ভিত ফিরে পেলো.................. আসছি মা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:৫৮
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×