I MADE MISTAKES IN DRAMA. I THOUGHT DRAMA WAS WHEN ACTORS CRIED. BUT DRAMA IS WHEN THE AUDIENCE CRIES.
Frank Capra
মনের মানুষ না মিললে মিলন হয় না, বোবার সামনে গান গাইলে সুখ হয় না, অন্ধের সামনে ছবি আঁকলে আনন্দ হয় না। পুরো ভিজ্যুয়াল মিডিয়াটাই তো দর্শক নির্ভর। বই না কিনলে প্রকাশকের ক্ষতি আর লেখক তো আবিষ্কারই করা যায় না। এটা ভ্যান গঘ কিংবা র্যাঁবোর দূর্ভাগ্য নয় যে তাদেরকে তাদের সময়ের দর্শক গ্রহণ করেনি, এটা বরং দর্শকের দূর্ভাগ্য। একজন ওস্তাদ আল্লারাখাকে চিনতে হলে, মূল্যায়ন করতে হলে তেমন সমঝদারও তো লাগে। নইলে অভাগা দেশে শিল্পী জন্মায় না।
একটা সময় একটা মাত্র টিভি চ্যানেল ছিলো আমাদের। তারও আগে টিভি বাক্সটাতেই একটা চ্যানেল ছাড়া কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো না। স্বদেশের রাষ্ট্রীয় টিভি বিটিভি দেখে আমরা যারা অভ্যস্থ ছিলাম তাদের সামনে এখন নানা দেশী চ্যানেল রিমোট কন্ট্রোল নামের ভয়াবহ অস্ত্রের বাটনে ঠাঁই নিয়েছে। ফলে প্রতিযোগিতাটা একদিতে যেমন বৈশ্বিক তেমনি কিছুটা অসমও। স্টার প্লাস, জি জলসা, ডয়েচে ভেলের মতো বাজেট বা কারিগরি আমাদের নেই, কিন্তু দর্শক তো ছাড় দেবে না। দর্শক রুচি বেড়ে গেছে, চাহিদা বেড়ে গেছে, যোগানও আছে, কিন্তু মান রাখা বোধ হয় কঠিনই হয়ে পড়ছে। অপসংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আমরা যতোই কলাম আর টক শো চালিয়ে যাই না কেন, আমাদের দর্শক বিনোদন, জ্ঞান, তথ্যের জন্য ক্রমশ হাত বাড়াচ্ছে বাইরের পানে। অবারিত আকাশ খোলা থাকলে কেউ মাথার উপর ছাদ নিয়ে বসে থাকে না। এটা কঠিন সত্য, বিশ্বখ্যাত কে হবে কোটপতি যখন বাংলাদেশে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে আনা হয় তখনও দর্শক সেটা গ্রহণ করে না। কারণ সে অনুষ্ঠান দেখতে বসে দর্শক অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আসাদুজ্জামান নুরের তুলনাই শুধু করে না, আগাগোড়া ফ্র্যাঞ্চাইস মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের প্রভাব প্রতিপত্তিটাও খেয়াল করে।
কথাগুলো ইদানিং এলোপাথারি মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, মঞ্চে নাটক দেখতে গেলে, হলে ছবি দেখতে গেলে, গ্যালারিতে প্রদর্শনী দেখতে গেলে কিবাং শোবার ঘরে টিভি দেখতে গেলেও। নিজের কয়েক দশকের জীবন থেকেই লক্ষ্য করে দর্শকের গুণগত ও মাত্রাগত বদলটাও কেমন বিস্ময়করভাবে ঘটে গেছে। একটা জাতির সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম ছবিটা তো সিনেমাতে দেখা যায়। সিনেমা একই সঙ্গে আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি, দুটোকেই বাংলায় শিল্প বলে, কিন্তু এই দুয়ের মিল সহজসাধ্য নয়। বেদনার সাথে লক্ষ্য করি, কাজী জহির কিংবা মিতার ছবি বাবা মা’র সঙ্গে হলে গিয়ে দেখেছি। একটা কোক আর চিপসের সাথে ঠা-া ঘরে সেই ছবি দেখাটা তো একটা উৎসবই ছিলো। আমার বাবা মা বুড়ো হয়ে গেছে, এখন হলে যায় না, হয়তো যেতে চায়, কিন্তু যাওয়ার কারণ পায় না। কারণ অন্য বাবা-মারা তো ছেলেমেয়ে নিয়ে ছবি দেখতে যায় না। টিজি বা টার্গেট গ্রুপ কি বদলে গেছে? সিনেমা হল গত কয়েক বছরে কতোগুলো বন্ধ হলো তার হিসাবটা কিন্তু মারাত্মক। এফডিসিতে ৩৫ মিমি’র কাজও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রূপালী পর্দার ডাকসাইটে প্রযোজক পরিচালকদের অনেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছে। ব্যক্তিগত আলোচনা থেকে জানতে পারি, ‘না, পাবলিক আর বাংলা ছবি দেখে না।’ কেন দেখে না? এটা ভাববার সময় বোধহয় এসেছে। মুমূর্ষ সিনেমাকে বাঁচাতে নতুন ধারার যারা আসছেন লক্ষ্যণীয় তারা কিন্তু পুরনো দর্শকদের জন্য কিছু বানাচ্ছেন না, তারা তাদের মতো করেই দর্শক বানিয়ে নিচ্ছেন। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী বিকল্প মাধ্যমে ছবি মুক্তির কথা ভাবতে হয়। গত কয়েক দশকে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা শিল্প ও বাণিজ্যের সুমেরুকণ করেছে। কিন্তু এই উদাহরণ তো নেহাতই একটা ব্যতিক্রম। বাণিজ্যিক সিনেমা, টিভি চ্যানেলের পৃষ্ঠপোশকায় তৈরি সিনেমা কিংবা বিকল্প ধারার সিনেমা – কোনটাই তো চার দশকের স্বাধীন রাষ্ট্রে নিজস্ব মাইল ফলক তৈরি করতে পারেনি। হয়তো ভুল হতে পারে, তবু মনে হয়, মন-মনন তৈরি না করে বাজারে পণ্য ছেড়ে দিলে তা কি বিক্রি হয়? পাবলিক খায় না, এই ছবি চলে না, ওই ছবি চলে না, এই সব ঢালাও মন্তব্য না-করে আমরা কি নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি না, ভাল ছবি, আমাদের ছবি যে মানুষ দেখবে সে মানুষের মন কি আমরা কাড়তে পেরেছি? মনে মনে মিল না হলে কি মানুষে মানুষে মিলন হয়? দর্শক এক প্রান্তে নির্মাতা আরেক প্রান্তে Ñ যোগাযোগের এই গভীর সমস্যা নিয়ে কতটুকু ভেবেছি আমরা? একটা মোবাইল ফোন শুধু আর কথা বলার যন্ত্র নয়, বিনোদন, তথ্য, জ্ঞানের ভা-ার হয়ে উঠেছে, স্যাটেলাইট-ইন্টারনেট বিশ্বকে আঙ্গুলের ডগায় এনে দিয়েছি। প্রতিদিন আমাদের আপগ্রেডেশন হচ্ছে তার প্রভাব কি সিনেমা নাটকে পড়ছে?
মঞ্চের পাতানো বিপ্লব কিংবা ওড়না দিয়ে লোক আঙ্গিকের আধুনিক কসরত কি দর্শকদের টানছে? কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, দেওয়ান গাজীর কিসসা, এখনও ক্রীতদাস, বিচ্ছু, সাত ঘাটের কানাকড়ি’র মতো নাটক এখন কেন হয় না? আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীনের প্রয়াণ কি কিছুটা ভাটা এনে দিয়েছে। সেলিম আল দীনের ধ্রুপদী টেক্সট, গদ্য-পদ্য’র দূরন্ত ভাষা সম্মিলন, লোকজ ও আধুনিকতার নয়া বুনোট আমরা থিয়েটারে আর পাচ্ছি না। আব্দুল্লাহ আল মামুন বরাবরই সমকালকে তার ক্যানভাসে এনেছেন। এখন দুঃসময়ে বাংলার বন্যা, তোমরাই নাটকে তারুণ্যের অবক্ষয়, অরক্ষিত মতিঝিল নাটকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি তার বহু নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী অবক্ষয় উঠে এসেছে নির্মমভাবে। সাঈদ আহমেদ বিশ্বমানের নাটকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লিখেছেন কালবেলা, মাইলপোস্ট, তৃষ্ণায় কিংবা শেষ নবাবের মতো নাটক। নতুন ও সৃষ্টিশীল নাট্যকারদের অনুপস্থিতি কি মঞ্চে নতুন দর্শক সৃষ্টিতে বাধা হচ্ছে কি না সেটা ভেবে দেখার বিষয়। মামুনুর রশীদ কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের নাটক এখনও দর্শক আকৃষ্ট করছে। অন্যদিকে জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান, এস এম সোলায়মানের মতো পরিচালকদের অনুপস্থিতিও হতে পারে ভাল ও নতুন ধারার নাট্য নির্মাণে বাধা।
উত্তোরত্তর মান বৃদ্ধি হওয়াই তো স্বাভাবিকতা। সেই বিবেচনায় জামিল আহমেদের মতো পরিচালক মঞ্চে আর বিষাদ সিন্ধু কিংবা চাকা’র মতো কাজ নিয়ে কেন আসেন না সে প্রশ্ন মনে জাগে। গাইড হাউস বা মহিলা সমিতির তুলনায় শিল্পকলার মঞ্চ অনেক আধুনিক। তবু মহিলা সমিতির সিঁড়িতে যে দর্শক ছিলো শিল্পকলা একাডেমির লবিতে আসা দর্শকের তুলনায় তার আত্মনিমগ্নতা বোধহয় বেশিই ছিলো। বেইলি রোডের মঞ্চদ্বয়ের ছাদ খসে পড়ছিলো, পর্যাপ্ত বাতাস ছিলো না, ছিলো না আরাম করে বসার সিট, তবু সেখানেই মঞ্চস্থ হয়েছে কালজয়ী সব নাটকগুলো। ঘামতে ঘামতে নাটক দেখা ও করার মানসিকতা দর্শক ও নাট্যকর্মীর ছিলো। নাটক নিয়ে পঠন ও অনুশীলন সে দর্শকের ছিলো। দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি-ও নিয়মিত মঞ্চ নাটক দেখাতো। এখন এতো চ্যানেলের ভিড়ে মঞ্চ নাটকের স্থান অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে।
টিভি নাটকের ক্ষেত্রেও ভাঙনের শব্দ শুনি, সংশপ্তক কিংবা কোথাও কেউ নেই-এর মতো নাটক আমরা পাই না। এ কি কেবল টেক্সটের সংকট। নাকি ভিন্ন সংস্কৃতির দোহাই দিয়েই আমরা পার পেয়ে যাবো। যদি কিছু মনে না করেন, প্রচ্ছদ-এর মতো অনুষ্ঠান কি দর্শককে আবার আমাদের নিজেদের চ্যানেলে ফিরিয়ে আনবে না। ফজলে লোহানী নেই, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ থেকেও টিভিতে অনুপস্থিত। মুস্তাফা মনোয়ারকেও আমরা তেমন করে ব্যবহার করতে পারছি না। যে দেশের প্রতিভা জীবিত থাকাকালে তার মূল্যায়ণ হয় সে দেশের দর্শকরা সত্যিই হতভাগা।
এতো চ্যানেল, এতো নাটক, তবু কেন ভারতীয় সিরিয়ালে আমাদের দর্শকরা মগ্ন হয়ে আছে! এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে যে, স্পন্সর আর বিজ্ঞাপণের দৌরাত্মে আমাদের দেশের দর্শক ভিন্ন দেশের চ্যানেলে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে কি না! একটি দেীয় কর্পোরেট কোম্পানি সম্প্রতি ভারতে চ্যানেলে অনুষ্ঠান স্পন্সর করছে, নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপণও চালাচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে আমাদের বাজার সম্প্রসারিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দর্শক যদি ক্রমশ বিদেশি চ্যানেল আর অনুষ্ঠানে আসক্ত হয়ে ওঠে দেশি কোম্পানিরাও কি স্বদেশে স্পন্সর করবে?
মোদ্দা কথাটা ভেবে দেখার যে, চিরকাল আমরা দর্শকের উপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছি। দর্শক এটা খায় না, ওটা খায় না বলে অজুহাত তৈরি করছি। কেউ শখ করে কিছু খায় না, খাওয়াতে শেখাতে হয়। ফেরদৌসি রহমানের এসো গান শিখি অনুষ্ঠানও বাবা-মা-ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে দেখেছে, লায়লা হাসানের নাচের অনুষ্ঠানও দর্শক দেখেছে। ভেবে দেখার বিষয়, আমরা দর্শক তৈরি করতে পারছি না, বরং তৈরি দর্শক হারাতে বসেছি। টেলিভিশন চ্যানেলের মাথাদের এখন মাথা ঘামানো উচিত অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সৃষ্টিশীলতায় তারা কী করবেন? দেশের ছোটখাটো বিজ্ঞাপণী সংস্থাতেও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর থাকেন। কিন্তু কোন টেলিভিশন চ্যানেলে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের মতো কোন পদবীই নেই। অনুষ্ঠান প্রধাণ হিসাবে যারা আছেন তাদের ব্যক্তিগত মান ও শৈলী নিয়ে কথা না বলেই এটুকু তো বলা যায় একটা ক্রিয়েটিভ টিম কি টিভি চ্যানেলগুলোতে থাকতে পারে না? এই টিম সারা বছর গবেষণা করে কি এক ডজন নতুন অনুষ্ঠান কিংবা নাটকের ধারণা তৈরি করতে পারবে না?
একটা কথা মনে রাখা জরুরি, ভক্ত না থাকলে প্রভূর যেমন মূল্য নেই, তেমনি দর্শক না থাকলে কোন কিছু প্রচার করে লাভ নেই। এই দর্শক তৈরি করা, দর্শকের মানসিকতা তৈরি করা আমাদেরই কাজ। মনে মনে মিল না হলে মেলে না মনের মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১৫