ভিয়া আলবের্তো মানচিনির এই বাস স্টপেজটার বিকেল গুলো বেশ দীর্ঘ। ১২৮ নাম্বার বাসে চড়ে মালিয়ানা হয়ে নীল বাসটা যখন শহর ছাড়িয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে মেয়েটির কাছে চেনা শহরটাও অচেনা লাগে।সাই সাই শব্দটা ওর কল্পনাপ্রসূত। একই বাসে করে অনেকবার ও ১২৮ নাম্বারের লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত গিয়েছে। প্রতিটা স্টপেজে খোলা জানালায় মাথা বাড়িয়ে এলাকার নাম পড়ে মনে রাখার বৃথা চেস্টা করেছে।প্রতিবার ই নাম গুলো নতুন অবয়বে ধরা দেয়। প্রতিবার ই ওর মনে হয়েছে শেষ স্টপেজে নেমে অন্য এলাকায় যাবার নতুন বাসে উঠবে।আবার আরেক স্টপেজে গিয়ে থামবে। আগে ও টিকিট কেটে উঠলেও এখন বাসে উঠে টিকিট আর পাঞ্চ করে না। অনেকদিন ও অপেক্ষায় ছিল চেকার এসে দেখতে চাইবে টিকিট কিন্তু বরাবরই ও হতাশ হয়েছে। কেন যেন বাসে ওর পাশের সিটের যাত্রী ও কখনো ওর সাথে কথা বলেনি। ও অপেক্ষা করেছে। মেয়েটি যখন সন্ধ্যের আগে আগে বাস থেকে নেমে পড়ে বাসায় ফিরতে হবে বলে তখন ওকে দেখলে মনে হতে পারে খুব বুঝি তাড়া আছে। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে পা টেনে যখন ও পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটে, খেয়াল করলে বোঝা যায় সেখানে সীমাহীন ক্লান্তি যেন মুখ গুঁজে আছে।
কেউ ওর ঘরে ফেরার জন্যে অপেক্ষা করে নেই এ ভাবনাটাই ওকে কাবু করার জন্য যথেষ্ট। তবুও ঘরে ফিরতে হয়। এই তো সেদিন ও বাস স্টপেজে বসে কাদঁছিল, কোত্থেকে এক বুড়ো এসে ওকে জিজ্ঞেস করে ও কাঁদছে কেন। ও সেদেশীয় ভাষায় বুড়োকে জানায় ও ভাষা জানে না তাই ওকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
বুড়ো অবাক হয়ে বললো মিথ্যে বলিস কেন? ভাষা না জানলে এটা বললি কীভাবে!
শয়তান এর মতো চাহনি বলেই মেয়েটির আর ইচ্ছে করে না লোকটার কথার উত্তর দিতে। সেদিন ওর কপাল এতই খারাপ ওর সাবলেটে থাকা মহিলাটার সাথে বাস স্টপেজেই দেখা। দেখেই হই হই করে উঠলো, এই তুমি কাদঁছ কেন? কি হয়েছে বলো!
লিলিয়ান কে দেখে রাগে ওর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। এই বদমায়েশ বুড়ি মহিলা প্রায় এক মাস আগে ওর কাছ থেকে দুইশো ইউরো লোন নিয়ে ভুলে যাওয়ার ভাব করছে আর আইসক্রিম, চকলেট অফার করে ফাঁকে ফাঁকে শোনায় দুই ইউরো দিয়ে আইসক্রিম কিনলাম, পাঁচ ইউরো দিয়ে এই মালা কিনলাম তোমার জন্য। ও কি আর বুঝতে পারে না কেন এই বুড়ি ঘুরে ফিরে এটা সেটা খাইয়ে, গিফট করে দুইশো টাকা কাটাতে চায়! তাই ইচ্ছে করেই লিলিয়ানের কথা উত্তর দেয় না। এদিকে বুড়োটারও সামনে থেকে সরবার নাম নেই। বুড়োটা লিলিয়ানকে জিজ্ঞেস করে তুই এই সিনোরিটাকে চিনিস? সেই কখন থেকে কাঁদছে!
অসভ্য লিলিয়ান কী অবলিলায় বলে ওঠে, চিনি তো! এ পাগল! নির্ঘাত ওর খিদে লেগেছে তাই কাদঁছে ! দুইটা টাকা থাকলে দে। ওকে কিছু কিনে খাওয়াই!
বুড়োটার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গট গট করে জুতোয় শব্দ তুলে ওকে অবাক করে দিয়ে লিলিয়ান বারে ঢোকে। নিশ্চয়ই সিগারেট কিনবে। ওর গা থেকে পাল্লা দিয়ে সিগারেট আর পারফিউমের ঘোলাটে ধরণের গন্ধ বের হয় সবসময়।
আজকে ওর ভালো লাগছে না কিছু। অবশ্য এভাবে বললে এই 'ভালো না লাগাটা' খুব গতানুগতিক লাগে শুনতে। ব্যাপারটা ঠিক ভালো না লাগবার নয়। অনেকটা অনুভবহীনতার অসুখ বলা যেতে পারে। এরকম অনেক অনেক দিন নির্ঘুম কাটালে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে হাহাকার তোলপাড় করে ওঠে সেই অনুভবহীনতার বিষয়টা অমন। ওই মানুষটার কেমন লাগে যে জানে কিছুদিন পর সে পৃথিবীর কোনো জায়গা দখল করে থাকবে না, আলো বাতাসের আর প্রয়োজন হবে না! কেমন লাগে তার! জানা সম্ভব নয় তার মনের অবস্থা কেমন। পর্তুয়েনসের কাছে যে হাসপাতালটা আজ সেখানে ও গিয়েছিলো। ও যত না সময় কাটিয়েছে শায়লা আপার রোগাক্রান্ত মায়ের সামনে তার চেয়ে বেশি সময় ও দাঁড়িয়েছিলো তার কেবিন ঘেঁষা বারান্দায়। সেখান থেকে অস্ফুটে খালাম্মার ভেসে আসা শারীরিক যন্ত্রণার গোঙানিতে পুরো কামড়া জুড়ে আলোড়ন তুলে যাচ্ছিলো। ভেড়ানো দরজার ফাঁক গলে সেসব শব্দ ও নিজেও টের পাচ্ছিলো। শায়লা আপার ভাই-বোনদের টুকরো টুকরো কথায় বোঝা যায় ক্যান্সারের মতো জটিল কিছু হয়েছে। ইশসশিরে! আম্মায় কেমন সবুজ বমি করছে দেখছ ভাইয়া! শায়লা আপার বড় ভাই মামুনের চাপা ধমক শোনা যায়, তোরা চুপ করবি! কিছুক্ষণ পর মামুন ভাই বারান্দায় ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। ওকে বা নিজেকে শোনাতেই বলে -
কেন যে আম্মার অসুখটা নিয়ে সবাই বিশেষ করে আমার ছোট বোনটা শো অফ করে! আমাদের যেন মাথা ব্যথা নেই। বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার পর থেকে যতসব উল্টাপাল্টা কমেন্ট শুরু করছে।ইচ্ছা করছে থাপ্পড় মেরে আবার দেশে পাঠাইয়া দেই!
ও তাদের পরিবারের বাইরের মানুষ। তাই চুপ করে থাকে। ফিনফিনে শীতল বাতাসে বুঝি অন্য রকম গন্ধ আছে। বাবার গন্ধের মতো একটা গন্ধ এই বারান্দায় কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে। ওর বাবার শেষ চারটা দিনও হাসপাতালেই কেটেছে। হাসপাতালের গন্ধ মানেই ওর কাছে এখন মৃত্যুর গন্ধ, বুকে বসে যাওয়া ঘড় ঘড় কফের শব্দের সাথে বালতি ভরা রক্ত বমি আর লিভার ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া পেটের অবয়ব নিয়ে ওর সামনে ওর বাবা এসে দাঁড়ায়। বুকের মাঝখানটায় হাত বুলিয়ে ওর বাবা যেভাবে বলতো - এইখানে ব্যথা করে রে আম্মা ! শায়লা আপার মাকেও ও আজ বলতে শুনেছে একই কথা - মামুন রে আমার কলিজার এইখানে বিষ করে !
কলিজার অবস্থান যেখানেই হোক ওর নিজের কলিজাও কেন যেন একটু একটু ব্যথা করতে থাকে। শায়লা আপার কাছ থেকে ওর আর বিদায় নিয়ে বের হতে ইচ্ছে করে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পর্তুয়েনস থেকে বাসে উঠে পড়ে। ১২৮ নাম্বার বাস, গন্তব্য ভিয়া রিবোতি। ওখানে বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা হেঁটে হেঁটে ওকে বাসায় ফিরতে হয়। ফেরার ওই জায়গাটায় বাঁ দিকে টার্ন করলে ব্রীজ পড়ে। আজো সেখানটায় ও দাঁড়ায়। সময়টা থম ধরা দুপুর। নিচে চিকণ লেকের মতো কিছু একটা এঁকেবেঁকে হয়তো বহুদূর গিয়ে সাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। লেকের ওই পানিতে কোনো কম্পন নেই, স্রোত নেই। মাছের চোখের মতো নির্জীব এরকম একটা উপমা মনে আসাতে ও ফিক করে হেসে ফেলে। এরকম প্রায়ই লেখকদের লেখায় মাছের চোখের বা সাপের চোখের মতো নির্জীব, শীতল ত্বকের কথা পড়েছে। হয়তো মাছেরা পলক ফেলে না বা স্থির তাদের চোখের মনি কিংবা না জানা আরো কোনো কারণ হবে। কিন্তু এখন সত্যিই সময়টা সেরকম স্থির, কান পাতলে স্থির সময়ের সাথে আরো কিছু অচেনা শব্দমালা ভেসে আসবে ক্ষীণ হয়ে। লেকের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে ছোট্ট মতো একটা পার্ক। এখনো বাচ্চাকাচ্চাদের আনন্দমুখর পদচারণা শুরু হয়নি। পার্কটাকেও কেমন নির্জীব লাগছে আর আবছা কেমন আঁশটে গন্ধ পাঁক খেয়ে লেকের পানির সাথে মিলেমিশে ব্রীজের হাওয়াকে ভারি করে তুলছে।
একেকবার ওর ইচ্ছে করে ব্রীজ থেকে সাঁতারুদের মতো ডাইভ দিতে। কিন্তু সেটা করা খুব পরিশ্রম আর বিপদজনক বলে ও ওর হৃদপিণ্ডটাকে দাঁড় করিয়ে প্রাণহীন দেহটা ব্রীজ থেকে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। ইথার থেকে কেউ হয়তো বলে উঠে ‘ মরণকে খুব ভয়, তাই না?’ উড়তে উড়তে দেখে ব্রীজটাও শূন্যে ভাসছে হয়তো একসময় ওর সাথে সাথেই লেকের পানিতে ঝাঁপ দেবে। ফেলে আসা হৃদপিণ্ডটার কথা ভেবে ওর আফসোস হয়। উড়তে উড়তে ওর মনে হয় বেশিরভাগ মানুষের মাঝেই কি আত্মহত্যা করতে চাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে থাকে সঙ্গোপনে! খুব ছোট ছোট অভিমান বা কারণ নিয়ে ওর আত্মহত্যা করার ইচ্ছে নেই আপাতত। তবে মাথা থেকে এই বাজে চিন্তাটাও ও সরাতে পারছে না। তাই ওর বেশ জোড়ালো কারণ খুঁজে বের করা দরকার অন্তত নিজেকে মেরে ফেলার মাঝে ওর পরিচিত বা অপরিচিত মানুষগুলো যাতে তুচ্ছ কারণ খুঁজে না পায়।
যদিও বাংলাদেশে বা প্রবাসে পরিচিত মানুষগুলোর মাঝে কাছের মানুষ খুব কম, হাতে গোনা যায় এমন। এর মাঝে মৌমিতা একজন। ওর কাছে রোজই ও শোনে কি করে বেঁচে থাকতে হয়, জীবনের গল্প কতটা গতিশীল হতে পারে। সেসব শুনতে শুনতে টার মাঝেই ও টের পায় ওর নিজের ভূমি কতটাই শুষ্ক তার বিপরীতে! তবুও ও মন দিয়ে শোনে ওর গতিশীলতার গল্প। কিন্তু ইদানিং ও দেখছে মৌমিতা কেমন ধীরে ধীরে ওর সতেজতা হারাচ্ছে, সবুজ সুগন্ধী হারাচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। সেসব শুনতে শুনতে ওর মাঝে ক্লান্তি আসে। আশার কথা শোনাবার মতো কেউ কি নেই! এই তো কদিন আগেই পত্রিকার এক নিউজে ও পড়েছে এপিনেফ্রিন ও ডিমেভিলট্র্যাপটিমির একটি মিশ্রণ প্রয়োগ করে প্রায় ২০ মিনিট কোনো মানুষকে ক্লিনিক্যালি মৃত অবস্থায় রেখে আবার জীবদ্দশায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এরকম কোনো পরীক্ষা নিশ্চয়ই অনেক খরচের ব্যাপার! তবুও উড়তে উড়তে এরকম অদ্ভুত ভাবনারা ওকে নিয়ে খেলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ওর বেঁচে থাকার জন্য যেসব স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার তার কিছুই মনে হয় ওর মাঝে অবশিষ্ট নেই। ড্রিম, দ্য ইন্সপিরাশন টু লিড লাইফ! ওটা না থাকলেও বা দৃশ্যত ও স্বপ্ন খুঁজে না পেলেও ঘুম বা তন্দ্রায় ও নানাবিধ স্বপ্ন দেখে যায় রোজ; ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়। স্বপ্নগুলো খুব দীর্ঘ এবং কোনো কোনো সময় খুব ভীতিকরও হয়। দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙে গেলেও আবার অনেক চেষ্টায় যখন চোখের পাতা এক করতে পারে যেখান থেকে স্বপ্নের শেষ হয়েছিলো ঠিক ওখান থেকেই আবার শুরু হয় স্বপ্নের। ব্যাপারটা মনে করেই ওর ভয় লাগতে থাকে। ধীরে ধীরে শূন্য থেকে ও নেমে আসে। ক্লান্ত পা জোড়া নিয়ে বিনয় মজুমদারকে আওড়াতে আওড়াতে এক বুক সন্ধ্যে নিয়ে ও বাড়ি ফিরতে থাকে –
চাঁদ নেই, জ্যোৎস্নার অমলিন জ্বালা নেই, তবু
কী এক বিপন্ন আলো লেগে আছে এ-মাঠের আঁধারের মুখে।
মনে হয় অকস্মাৎ ডুবে যেতে পারে মাঠ সমুদ্রের জলে।
হৃদয় বিস্মিত এক বিমর্ষ অসুখে।
চাঁদ নেই দেখি দূরে নক্ষত্রেরা জ্বলে।
যে নক্ষত্র নীল হয়ে আছে দেখি তাকে।
কখনো সে পৃথিবীতে আসবে না, জানি, তবু
আসতে কি পারে না সে মাঠের নিকটে?
মাঝে মাঝে নক্ষত্র তো চাঁদ হয়ে পৃথিবীর কাছে এসে থাকে।
মেয়েটির মুঠোয় ধরা জল মুহূর্তেই রং বদলাতে থাকে। আঙুলের ফাঁক গলে ফোঁটা ফোঁটা সে রং গড়িয়ে পড়ে। শেষ ফোঁটাটা গড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে সুতীব্রতায় সেটি বরফখন্ডে পরিণত হয়। এর রং সাদা কিংবা মেয়েটি ভেবে নেয় অশ্রুকণা। অশ্রুর রং সাদা বলে। আঙুলের এক তুড়িতে মেয়েটি যখন শেষ সাদা রং টিও ভিয়া রিবোতির বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল, কণা গুলো তুষার হয়ে ঝড়তে শুরু করে। দেখতে দেখতে নিচের রাস্তা, আশেপাশের বাড়িগুলো আপাদমস্তক তুষারাবৃত হয়ে যায়। স্ট্রীট ল্যাম্প গুলো জানিয়ে দিয়ে যায় রাত্রি নেমেছে এলবেট্রস আর ক্যামেলিয়ার পাঁপড়ি জুড়ে!
সমাপ্ত