১.
ঈশ্বর একটি অদ্ভূত চরিত্র। অনন্তকাল যাবত সে স্যাডিস্ট মুডে ছিল। কারণও ছিল। তার পূর্ণ স্বত্বাকে বরাবরই জীব ২ ভাগে ভাগ করছিলো, পক্ষ বিপক্ষ, ভালো মন্দ, শুভ অশুভ অথচ নিজেকে রিডিফাইন করার যে প্রচেষ্টা ঈশ্বর চালাচ্ছিলো এটা তথাকথিত বুদ্ধিমত্তা ধরতে পারছিলো না। ঈশ্বর অবশ্য নিশ্চিত না। ঠিক ধরতে পারছিলো না নাকি পাত্তা দিচ্ছিলো না। বিকাশের পথে এরকম সময়ও ছিলো নিজেকে ভেঙেচুরে দেখতে ভালো লাগত। কিন্তু উৎপত্তিহীন এই ক্রম বিস্তৃতি ক্রমে বিষন্ন হয়ে গেলো। ঈশ্বর নিজেও মাঝে মধ্য দ্বন্দ্বে পড়ে যায় অনাদি এই বিস্তার আদৌ কি বাস্তব? নাকি ভ্রম?
এরকম একটা স্থবিরতায় কোত্থেকে পৃথিবীর কোন এক কোণা থেকে ঠিক অনাদি নামেরই একজন আবেদন করে বসল, যদি সম্ভব হত তাহলে বাবা মা'র বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিতাম। প্রাথমিকভাবে ঈশ্বর মানব সম্প্রদায়ের নির্বুদ্ধিতায় কিছুক্ষণ উপহাস করল, কারণ বাবা মা'র বিবাহ ব্যাতীত অনাদি জন্ম নিতো কোত্থেকে! তার মানে কি অনাদি নিজের সাম্ভাব্য অনস্তিত্বতা সম্পর্কে জ্ঞাত? নাকি সে অন্য কোথাও জন্ম নেবার আশা লুকিয়ে রাখে? ঈশ্বর আত্মভ্রমে বিচলিত ছিলো তাই এই আবেদনটা তার মনঃপূত হলো।
তাই সে অনাদির জীবনবৃত্তান্তের দিকে মনোযোগী হয়।
অনাদির জন্ম কবে? অনাদির সময়ের সূচনা কবে? শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বানু নিষিক্তকরণের সময় অন্ধকার গর্ভে? নাহ, ঈশ্বর বিস্মিত হয়ে দেখল, তার জন্ম কল্পনায়। কোনো এক সুখকর কল্পনায় তার মা তাকে প্রথমবার জন্ম দেয়, পরের বার তার জন্ম হয় কোনো স্মৃতি ভুলে থাকার ছলে। আবারও তার জন্ম হয় গন্তব্যহীনতার আশ্রয়ে। নাকি তার প্রথম কল্প জন্মই ছিল গন্তব্যহীনতার আশ্রয়? কল্পনার উৎপত্তির কোনো ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট সময় থাকে না, তাই অনাদির সময়ের সূচনা নিশ্চিত করা গেলো না। তার মানে অনাদি সত্যিই অনাদি? ঈশ্বর এবার একটু বিরক্ত হয়। সে এতক্ষণ নিজের অনাদি স্বত্বার দ্বিধায় আক্রান্ত ছিলো। এখন তালিকায় কি না একটা মানুষও যোগ হলো।
ঈশ্বরের বিস্তৃতিতে বিষণ্ণতা যোগ হচ্ছিলো মহাশূন্যের মত। এখন মরণশীল একটা বিষণ্ণ বাঁধা অস্থিরতা যোগ করলো। অনাদি হলেই অনন্ত। পার্থিব আকাশ অনাদি, কারণ সেটা ভ্রম। যে মানুষের জন্ম নির্দিষ্ট নয় এবং সে যদি তার সময়ের জন্মই না চায় তাহলে তা কি ঈশ্বর দিতে পারে? হয়ত হ্যাঁ, হয়ত না! তবে এটাও ঠিক সে বিস্তারে ঈশ্বরও ভাবছিলো যদি কিছুই না থাকত, তবে? তাই অনাদির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছোট একটা কৌতুক তৈরি করল ঈশ্বর। উত্তর সঠিক হলে অনাদির বাবা মা'র কখনও পরিচয় হবে না। ফলে অনাদিকেও পৃথিবীতে আসতে হবে না। উত্তর ভুল হলে অনাদির সময়ের শুরু ও শেষ হবে সাধারণ দশটা মানুষের মত স্থূল।
২.
গাড়ির হর্ণের উৎকট শব্দে সকাল সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙল অনাদির। মা এর আগেও কয়েকবার নাস্তা করার জন্য ডেকে হতাশ হয়ে অফ গেছে। ছুটির দিনগুলোয় কোনো কিছুর জন্যই যেন তাড়া থাকে না। তাই সে অলসতা উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশ ফিরে ঘুমাবার আয়োজন করতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল সে বিছানায় না, বাসে। সে বেশ অবাক হয়, কারণ আগামী পরশু মানে সোমবার দিন তাদের গ্রামে যাবার কথা। পাশের সিটে তাকাতে দেখল অপরিচিত মহিলা তার দিকে পরিচিত মুখ করে তাকিয়ে। উঠলা বাবা এতক্ষণে! কন্ঠ শুনে তো তার মায়ের মতই লাগলো।
-আজকে আমরা গ্রামে যাইতেসি যে? আমাদের না সোমবার যাবার কথা?
-আজকেই তো সোমবার।
-আজকে তো শনিবার, সে বিরক্ত হয়ে বলে।
অবশেষে পত্রিকায় তারিখ দেখে সে নিশ্চিত হয় আজকে সোমবার। খুব সম্ভবত এটা একটা অপ্রাসাঙ্গিক স্বপ্ন, ভেবে সে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করে। যেন পরের বার ঘুম ভাঙলে দেখে সে বাসায়, যেখানে ঘুমিয়ে ছিলো।
না। সারা রাস্তা তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই ভ্রমণ করলো। এবং দীর্ঘ যাত্রা শেষে সে বাস্তবেই অপরিচিত একটা সভ্যতা বিবর্জিত এলাকায় সন্ধ্যা নাগাদ পৌছালো। এবং বলা হলো এটাই তাদের গ্রাম।
তার যতদূর মনে পড়ে তার দাদু জীবিত ছিলো না, কিন্তু কোত্থেকে সেই দাদুই তাদেরকে অভর্থ্যনা জানিয়ে অন্ধকার বাড়িতে নিয়ে এলো। এবং পৌছাবার পর থেকে একবারও তার মাকে দেখলো না।
-দাদু বাবা মা কোথায়? সে জানতে চায়।
-তারা তো আসে নাই, বলে বৃদ্ধ হাসে।
-তাহলে আমার সাথে কে আসলো?
-আমি কী করে বলি দাদুভাই!
-তাহলে আমি এখানে কেন আসলাম?
-আমাকে দেখতে। তুমি নাকি আমার কাছ থেকে কীসব জানতে চাও!
আমি জানতে চাই! কী জানতে চাই! ভেবে সে আতঙ্কিত হয়। কারণ বিদ্যুৎহীন হারিকেনের আলোয় সে ঠান্ডা মৃত্যুর শিহরণ অনুভব করে।
-তুমি ভাত খাইতে খাইতে মনে করো কী জানতে আসছ আমার কাছে। আমি একটু বিশ্রাম করি।
বৃদ্ধ হারিকেন নিয়ে চলে গেল। এখন এই অন্ধকারে আমি খাবো ক্যামন করে! তাও সে অনুমানের উপর খাওয়া চালিয়ে গেলো।
পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধ ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে কন্ঠে বলে, মোহিনী, অনাদি দাদুকে মোমবাতি দিয়ে আয়।
প্রায় সাথে সাথেই মোমবাতি হাতে যথার্থ মোহিনীর উদ্ভব ঘটে। এরকম সুন্দরী মেয়ে সে কম দেখে। তাও গ্রামে দাদুর বাসায় এই মেয়ের কি কাজ থাকতে পারে!
-আপ্নের কোনো দরকার পড়লে আমারে ডাক দিয়েন। দাদুর ঘরের পাশেই আমার ঘর। বলে সে ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি দিয়ে চলে যায়।
যাবার পথের দিকে তাকিয়ে অনাদি ভাবে কন্ঠটা একটু আঞ্চলিক।
কিন্তু সে দাদুর কাছে কী জানতে এসেছে এটাও তার জানা নেই। বসার ঘরের খাটে শুয়ে সে এপাশ ওপাশ করে। এটা কি কোনো স্বপ্ন? তা-ই হবে।
অনেকদিন ধরেই সে জানতে চাইছিলো, জীবনের পরে কী হবে। আদৌ কিছু হবে কি না। এটাই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করা যায়। তার অভিমত জানা ভালো ব্যাপার হবে।
নাকি বৃদ্ধ ঘুমিয়ে গেলে মোহিনীর ঘরে যাওয়াটা ভালো হবে?
সম্ভবত সেটাই মানানসই। রাত বাড়লে সে ঘর ছেড়ে বের হয়।
পাশাপাশি দুটো দরজা। প্রশ্ন তৈরি। দুজনের জন্যই।
হঠাত একটা দরজা খুলে যায়। ঘর থেকে যেন অন্ধকার ঠিকরে বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধকে এখন ক্রুদ্ধ, অপরিচিত লাগছে।
-তুমি কী প্রশ্ন করতে আসছো তুমি জানো না? এখন বানায়ে বানায়ে প্রশ্ন করতে আসছো? বলে তার গলা চেপে ধরতে গেলে হাতজোড়া স্পর্শের বাইরে হাতড়ে মরে। অনাদিও তাকে ধাক্কা মারতে গিয়ে টের পায় লোকটার স্বচ্ছ শরীর। পেছন থেকে মোহিনী ডাকতে থাকে, আপ্নে আমার ঘরে আসেন? বৃদ্ধর ছায়ার সাথে ধাক্কা খেয়ে সে তলিয়ে যেতে থাকে। এবং তখন তার মনে পড়ে একটা মুদ্রার তৃতীয় পিঠ কী এটা সে জানতে চেয়েছিলো।
৩.
এলার্মের একঘেয়ে শব্দে ঘুম ভাঙতেই হাত পায়ের ব্যাথায় অনাদি উহ করে উঠল। যাক তাহলে ওটা স্বপ্ন ছিলো। নাস্তার টেবিলে সুন্দর ডিমভাজা আর সবজিভাজি দেখে সে খুশি হয়। আনন্দ প্রলম্বিত করতে সে পরে ভালো খাবার খেতে সিদ্ধান্ত নেয়। ঈশ্বর মানুষের নির্বুদ্ধিতায় আবার হাসে। কারণ পত্রিকা উল্টালেই অনাদি দেখতে পাবে রবিবার সকাল আজ।
অনাদি ডিমভাজা খেতে গিয়ে ততক্ষণে দেখে ওটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিজের খেয়ালকে প্রশ্রয় দেয়ায় সে নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে।
সামনে দিয়ে মা হেঁটে যেতে সে লক্ষ্য করে তার মুখটা ভারী। হয়ত মন খারাপ, হয়ত অসুস্থ। তবে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে স্বপ্নের অথবা গতকালকের অথবা আগামীকালের বাসের মহিলাটাই তার মা। অবশ্য এখন ততটা অপরিচিতও লাগছে না।
তার হতবুদ্ধিতা কাটাতে সে নেটে বসলো।
এখানে তার কিছু বন্ধু আছে। যাদের সাথে কথা বললে কিছু সময়ের জন্যও রূঢ় বাস্তবতাকে পাশ কাটানো যায়।
প্রায়ই তার মনে হয়, পাশ কাটানোই কি সবচে' ভালো পন্থা? নাকি বদলে দেয়া? যদি কোনো কিছুই বদলানোর মত না থাকে?
তিশ্নু নামে অপরিচিত একজন তাকে বার্তা পাঠিয়েছে।
গতকাল=আজ=আগামিকাল
এসব হেঁয়ালি তার অসহ্য লাগছে এখন।
পাশের ঘর থেকে বাসের টিকেট কেনা নিয়ে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
-আমি কি যাইতে চাইসি নাকি? তোমার ছেলেই না তার দাদুর সাথে দেখা করতে চায়।
-দেখা করার কাজ নাই। গ্রামের পরিবেশ ভালো না।
-হ্যা, আমি আমার বোনের বাড়িতে উঠব তাকে নামায়ে দিয়ে।
আশ্চর্য! ঘটনা মিলতেছে। মাকে এজন্যই পড়ে দেখা যাচ্ছিলো না।সে নেট ছেড়ে বাস্তবে ফিরে আসে।
নেটে বন্ধুরা প্রাত্যাহিক জীবনের প্যাঁচাল করতে থাকলেও তার মন পড়ে থাকলো তার চিরপরিচিত জীবনের অপরিচিত সংকটে। হয়ত পাশের ঘরে গেলে দেখা যাবে বাবার মুখও অপরিচিত। তাই সে ভয়ে ভয়ে বাসা ছেড়ে বাইরে বের হয়।
রাস্তায় পরিচিত ভিক্ষুককে দেখে তার মনে পড়ে, তার এক বন্ধু বলত অবস্থান অদল বদলের কথা। এবং এটাই সত্য অন্তত এই মুহূর্তে আজকে দিনে ভিক্ষুকটাও তার চেয়ে বেশি সুখে আছে।
সারাদিন সে ইতস্তত ঘুরে রাতে বাড়ি ফিরল। না, কেউ তার জন্য অপেক্ষায় নেই। সবাই যার যার মত ব্যস্ত। এমন কি নেটেও তার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। কোথাও কেউ তার অপেক্ষায় নেই ভেবে তার সামান্য মন খারাপ হল। এমন সময় পাশের ঘরে উচু স্বরে ঝামেলার শব্দ আসলে, সে এড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
ক্যানো এত জটিলতাকে ডেকে আনা! কিছু না থাকলেই কী ভালো হত না! নাকি জটিলতার কারণেই বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা?
৪.
ঘুম ভাঙতে অবশেষে শনিবার সকাল আসলো। এবং চিরায়ত ডাকাডাকি।
পরিচিত খাবারের টেবিল। মা তার অবহেলিত অসুস্থতা নিয়েও খাবার তৈরি করে, অপেক্ষা করে টেবিলে। অনন্ত এই ধীর ভালো লাগার প্রবাহ কখনও কখনও খুব ভারী ঠেকে অনাদির। একজন মানুষের খারাপ থাকাই যখন অন্যরা স্বাভাবিক ধরে নেয়, তখন আসলে কিছুই স্বাভাবিক থাকে না।
তাই সে আবারো ভাবে বাবা মা'র যদি কোনোদিন দেখা না হত!
তারপর নিজের হাতের দিকে চোখ পড়তে সে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে।
অন্ধকার থেকেই যদি আলোর উৎপত্তি, আর অন্ধকারেই যদি ক্ষয় তাহলে অন্ধকারে আত্মসমর্পনে এত দ্বিধা কেন!
সম্ভবত হ্যা, না এর মুদ্রার তৃতীয় পিঠে থাকে দ্বিধা! নাকি নিঃস্পৃহতা?
ঈশ্বর তখনও কৌতুকটার উত্তর অপেক্ষায় ছিলো।
উত্তরটা যদিও প্রাসাঙ্গিক ছিল না তবে তার পছন্দ হলো।
ভুল আর সঠিকের হিসেব ঠিক করা ছিলো আগেই। কিন্তু অপ্রাসাঙ্গিক পছন্দের ফলাফলে কী দেয়া যায়! এটাও একটা জটিলতা। উত্তর পছন্দ হওয়ায় তার জিতে যাবারই কথা। কিন্তু বাস্তবকে ঘুরিয়ে দিলেও তার জন্ম হবে। কল্পনায়। একজন অপারগ মানুষের গন্তব্যহীনতার আশ্রয়ে। এই সাম্ভাব্য জটিলতায় মগ্ন হবার আনন্দ ঈশ্বর প্রলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ আগেই বলেছি। ঈশ্বর একটি অদ্ভূত চরিত্র।