কে জিতবে বিশ্বকাপঃ
বিশ্বকাপ কে জিতবে? কারা জিতবে না জিজ্ঞেস করে কে জিতবে প্রশ্নটাই মনে হয় বেশি যৌক্তিক। কারণ ইতিহাস বলে বিশ্বকাপ হাতে নিতে হলে নেতা হতে হয়!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিভার অভাব কোনদিনই ছিল না; ইন ফ্যাক্ট এখনো নেই। ওদের একটাই সমস্যা। ওরা কখনোই এক দেশ নয়। এজন্যে একটা ইউনিট হয়ে খেলার প্রেরণাটা এরা পায় না। আজকের টি-টুয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজ লীগগুলো দেখে পুরো ব্যাপারটা এক্সপোজড হয়েছে। সুনীল নারাইনের মতো মতো খেলোয়ারেরা টাকাকেই বেশি গূরুত্ব দেয়। কিন্তু খেলোয়ারদের মধ্যে জিনিসটা অনেক আগে থেকেই ছিল। ড্যারেন গঙ্গা তো একবার বলেই ফেলেছিলো যে, সে ত্রিনিদাদের হয়ে টেস্ট খেলতে চায়! -_- খোদ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা লারাকে এই বলে দোষ দেয় যে, সে কখনো দলটাকে এক সূত্রে গাঁথতে পারেনি।
ক্লাইভ লয়েডের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এই জায়গাটায়। ফ্র্যাংক ওরেলের হাত ধরে শুরু, তারপর লয়েডই পেরেছিলেন তারকায় ঠাসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেতা হতে। ভিভ রিচার্ডস একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, লয়েড না থাকলে তিনি কখনো তার নির্ভার খেলা খেলতে পারতেন না। খুনে বোলারদের হাতে বল দিয়ে লয়েড বলতেন, শেষ করে এসো! '৭৫ আর '৭৯ এর বিশ্বকাপ তো তার হাতেই গেলো। '৭৫ বিশ্বকাপ ফাইনালে তো সেঞ্চুরি করে পথ দেখিয়েছিলেন দলকে। আদর্শ নেতা একেই বলে।
'৮৩ বিশ্বকাপের কথা ধরি। আমার ধারণা কপিল দেব বিশ্বকাপ জেতাটা ডিসার্ভ করতেন বলেই ওই সময়ের পুঁচকে ভারত বিশ্বকাপটা জিতেছিলো। ক্রিকেট বিধাতার তা-ই ইচ্ছে ছিলো। জিম্বাবুয়ের সাথে ম্যাচে ভারতের মাত্র ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিলো! কপিল একাই খেললেন ১৭৫ রানের রূপকথা। দলের সামনে এভাবে উদাহরণ সৃষ্টি করে বললেন, "এবার তোমরা করে দেখাও!" ভারত জিতলো বিশ্বকাপ।
আজকের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিলো অ্যালেন বোর্ডারের হাত ধরে। ওদের অ্যাওয়ার্ড নাইটে বছরের সেরা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ডটার নাম "অ্যালেন বোর্ডার পদক"! যে মানুষটার হাত ধরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সূচনা সে মানুষটার হাতে বিশ্বকাপটা না গেলে খুব খারাপ হতো।
'৮৩ বিশ্বকাপ আর '৯২ বিশ্বকাপের কাহিনী একই। কপিল দেব জিতেছেন আর ইমরান খান জিতবেন না? সেটা কি হয়? '৯২ বিশ্বকাপে ইমরানের কাণ্ডটা তো ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে গেছে আজীবনের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার সাথে জীবন মরণ ম্যাচে টস করতে নামলেন ইমরান। পরনে পাকিস্তানের জার্সি ছেড়ে একটা বাঘের ছবিওয়ালা টি শার্ট পড়া। চ্যাপেল জিজ্ঞেস করলেন, "ইমরান এইটা কী?" ইমরান বললেন, "আমি আমার ছেলেদের বলেছি যে এখন আমরা কোণঠাসা বাঘ। এখন শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়!" জন্ম হলো "Cornered Tigers" এর! ওয়াসিম আকরামকে ইমরান বলেছিলেন, "নো বল নিয়ে ভাবার দরকার নেই। তুমি শুধু জোরে বল করো!" ওয়াসিম হলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। ভুলটা করেছিলেন শুধু বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল নিয়ে কথা বলে। তবে বিশ্বকাপটা ইমরান বাদে আর কারও হাতে মানাতো না।
'৯৬ এ আসি। শ্রীলংকার জন্য রানাতুঙ্গা কি সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই। '৯২ এ মুরালিকে যখন অস্ট্রেলিয়ায় নো বল ডাকা হয়েছিলো তখনই অস্ট্রেলীয়দের সামনে পুঁচকে শ্রীলংকাকে নিয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজের অ্যাটিটিউডটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। জয়াসুরিয়া লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন। তাকে ওপেনার বানিয়ে বলে দিলেন, "পরের দশ ম্যাচে শূণ্য রানে আউট হলেও তুমি দল থেকে বাদ পড়বে না! তুমি শুধু ওদের বোলিংকে এলোমেলো করে দিয়ে এসো।" চিন্তা করে দেখেন, একজন খেলোয়ার অধিনায়কের মুখে এই কথা শুনলে কতটা নির্ভার খেলতে পারে! জন্ম নিলো ইতিহাস সৃষ্টিকারী জয়া-কালু জুটি! শ্রীলংকার সব স্বপ্নের সারথী ওই অর্জুনা আর অরবিন্দ। '৯৬ এর বিশ্বকাপ ফাইনালের জয়ের মুহূর্তে তাদের আলিঙ্গনই হয়তো ক্রিকেট বিধাতার চাওয়া ছিল। এর চেয়ে পারফেক্ট ছবি দিয়ে তো বিশ্বকাপ শেষ হতে পারতো না।
বোর্ডার-টেলর যুগে অস্ট্রেলিয়া ভালো হচ্ছিলো। কিন্তু স্টিভ ওয়াহর সময়েই অপরাজেয় বিশ্ব রেকর্ড গড়তে শুরু করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। নেতা হিসেবে আদর্শ। অসাধারণ টিম কম্বিনেশন পেয়েছিলেন সত্যি। কিন্তু টানা হেরে একেবারে জীবন-মরণের ম্যাচে সাউথ আফ্রিকার সাথে ম্যাচে সেঞ্চুরি করে দলকে সেমি ফাইনালে তুলেছিলেন তো স্টিভ একাই!! পুরো দলকে উজ্জীবীত করতে ক্যাপ্টেনের এমন নকের উপরে আর কী লাগে? সাথে গিবসের ক্যাচ ধরার মুহূর্তে বলা ওই মিথ, "তুমি তো বিশ্বকাপটাই হাত থেকে ফেলে দিলে!" খাদের কিনারায় থাকা অস্ট্রেলিয়াকে তাতিয়ে দিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ একাই। '৯৯ বিশ্বকাপটা তিনি না জিতলে কে জিততো বলেন?
'০৩-'০৭ বিশ্বকাপ নিয়ে আসলে কিছু বলার নেই। :/ ওই অস্ট্রেলিয়াকে কেউ হারাবে এই মানসিকতাও কারও ছিল না। পুরো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো দুইবারই। আমার ধারণা তখন পন্টিং ক্যাপ্টেন থাকলেও যা হতো, গিলি ক্যাপ্টেন থাকলেও একই হতো। তবে ক্যাপ্টেন পন্টিং পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন তো অবশ্যই। '০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্যাপ্টেন্স নকটা তো তার কাছ থেকেই এসেছিলো।
'১১ বিশ্বকাপে আসি। টেস্টে যেমনই হোক না কেন ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে মাহেন্দ্র সিং ধোনির কোন বিকল্প একেবারেই নেই। '০৭ বিশ্বকাপের পরে বিপর্যস্ত ভারতকে প্রথমে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতালেন। দলকে একতাবদ্ধ রেখেছেন সবসময়। ঠান্ডা মাথার ধোনি সাফল্য পেয়েছেন সব বড় আসরে। স্টিভ ওয়াহ পর্যন্ত তার সেরা ওয়ানডে একাদশের ক্যাপ্টেন ধোনিকেই রাখতে চান। '১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্যাটিং এ নিজেকে উপরে উঠিয়ে এনেই ৯১ রানের অধিনায়কের ইনিংস খেলেই বিশ্বসেরা হয়েছিলেন। ধোনির মতো নেতার বিকল্প ভারত এখনো পায়নি।
এতক্ষণ শুধু সাফল্যের গল্প বললাম। উল্টোটাও কি নেই? আছে অবশ্যই। অধিনায়ক ধরলে প্রথম যে ডিসার্ভিং ক্যাপ্টেন বিশ্বকাপ ধরতে পারেননি তিনি নিউ জিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো! তবে সেবার বিশ্বকাপে হাত ছুঁয়েছিলেন ইমরান খান। কাকে ফেলে কাকে রাখবেন? বিধাতাকে তো একজনের দিকে তাকাতেই হতো! '৯৬ এও মার্ক টেলরের প্রাপ্য ছিল বিশ্বকাপটা। অ্যালেন বোর্ডার যে পিলার বানিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ইট গেঁথেছিলেন মার্ক টেলর। অনেকগুলো নতুনের জন্মও দিয়েছিলেন তিনি। কলংকটা শুধু বিশ্বকাপ জিততে না পারায়। '৯৯ এ হানসি ক্রোনিয়েকে তো পড়তে হলো সাউথ আফ্রিকান চোকের ট্র্যাজেডিতে। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডিসার্ভিং ছিলেন বোধহয় সৌরভ গাঙ্গুলী! বিদেশের মাটিতে ভারতকে জিততে শিখিয়েছিলেন সৌরভ। মনে আছে ২০০০ সালে সৌরভ যখন ভারতের দায়িত্ব নেন তখন দলটার পর্যদুস্ত অবস্থা। মাত্রই আজহারউদ্দীন আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন ম্যাচ পাতানোর দায়ে। তখন পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে ১৫৮ টেস্ট খেলে ভারতের জয় মাত্র ১৫টিতে। এই ভারতকে জিততে শেখালেন সৌরভ। '০২ এ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে খালি গায়ে জার্সি ঘোরানোর দৃশ্য তো ক্রিকেটের চিরকালীন ফ্রেমের এক ছবি। হরভজন, যুবরাজ, জহির, নেহরাদের মতো তরুণদের দিনের পর দিন ব্যাক আপ দিয়ে ২০০৩ বিশ্বকাপে নিয়ে গেলেন। কেউই কল্পনা করেনি যে ওই ভারত ফাইনালে যেতে পারে। এই সৌরভ একটা বিশ্বকাপ মনে হয় ধোনির চেয়েও বেশি ডিসার্ভ করতোই। পারেননি পন্টিং এর অতিমানবীয়তার কাছে। ব্যর্থদের মধ্যে আর মনে পড়ছে স্টিভেন ফ্লেমিং আর গ্রায়েম স্মিথের নাম।
সব খেলার মধ্যে ক্রিকেট ক্যাপ্টেনদের কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। ফুটবল, হকিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটা সম্মানের জায়গা। কিন্তু ক্রিকেট এই জায়গায় অনন্য। পিচ দেখে টস জয় করে ব্যাটিং/বোলিং নেয়া থেকে শুরু করে, ফিল্ডিং সাজানো, ক্ষণে ক্ষণে বোলিং পরিবর্তন, ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা মাঠের মধ্যেই এতো কাজ ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ছাড়া আর কারও থাকে না। সাথে পুরো দলকে উজ্জীবিত করবার ব্যাপারটা তো আছেই। ক্রিকেটের অধিনায়কের মতো এতো ঝক্কি-ঝামেলা কাউকে পোহাতে হয় না।
এবারের বিশ্বকাপটা কে জিতবে বলে শুরু করেছিলাম লেখাটা। যেহেতু এবার '০৩, '০৭ এর মতো সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া নেই সেহেতু এবারের ক্যাপ্টেনগুলোর দিকে তাকানোই যায়।
ক্লার্ক, মরগান, হোল্ডার, ম্যাককালাম, ডি ভিলিয়ার্স, ধোনি, মিসবাহ, ম্যাথুজ, মাশরাফি, চিগাম্বুরা।
নামগুলো দেখেই আমি ক্লার্ক, ম্যাককালাম, ভিলিয়ার্স, ধোনি, মিসবাহ, মাশরাফিকে আলাদা করতে পারি।
এর মধ্যে ধোনিকে বাদ দেই। একবার জিতসে। এবার ভারতের অবস্থাও এতো ভালো না।
মাশরাফিকে এনেছি কারণ "পাগলা" অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ দলের নেতা। বর্তমান বাংলাদেশিদের মধ্যে ওই কাপটা ডিসার্ভ করে। বাস্তবতা না থাকলেও নিজের আবেগ আর স্বপ্নও এখানে কাজ করেছে!
এবারে বাকি চারটা নাম দেখেন। ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তানকে অনেকদিন ধরেই এক করে রেখেছে মিসবাহ একা। ম্যাচ পাতানো থেকে শুরু করে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বসহ নানা ঝড়-ঝাপটায় মিসবাহের ঠান্ডা মাথা আর ব্যক্তিত্ত্ব অনেক বড় ব্যাপার। এমনকি পাকি ট্র্যাডিশন ছেড়ে ইউনিস, আফ্রিদি বিনা দ্বিধায় মিসবাহকে নেতা মানে। অস্ট্রেলিয়ান সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরসূরী মাইকেল ক্লার্ক। নেতা হিসেবে হয়তো তাকেই বেশি মানায়। সাউথ আফ্রিকা দল হিসেবে ভালো হলেও ডি ভিলিয়ার্স সে অর্থে এখনো নেতা হননি। অবশ্য বলা যায় না। সাউথ আফ্রিকার দলটা বেশি ভালো। (সেফ থাকি) নিউ জিল্যান্ড দলও ভালো আবার ফিলিপ হিউজের মৃত্যুর পরে ম্যাককালামের নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটীয় স্পিরিট যেভাবে প্রকাশ করেছিলো তাতে ব্রেন্ডন যে অনেক উচ্চ পর্যায়ের নেতা সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে!
নেতার হিসেবে আমার শেষ তিন বাজি ক্লার্ক, মিসবাহ আর ব্রেন্ডন। আর মাশরাফি তো আছেই।
আমার কথা আমি বললাম। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে।