প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে পথ হাটছি কোমল চাঁদকে মেঘে ঢেকে দেওয়া আবছায়ায়। গন্তব্য আছে আবার নেই। সেটা অজানা হলেও উদ্দ্যেশ্য তৃষ্ণা নিবারনের স্থান খুঁজে পাওয়া। এই মধ্যরাতে সেটা অসম্ভব মনে হলেও আমার অভিজ্ঞতার কাছে সম্ভাব্যতার গণিতের ফলাফল আমার দিকেই ঝুঁকে পড়ে বারবার। সেটা গণিতে ভালো হওয়ার দরুণ ও হতে পারে। আপাতত সেটা নিয়ে আমার চিন্তা না করলেও হবে। আমি চিন্তিত আমার সর্বগ্রাসি তৃষ্ণা নিয়ে। সেটা ততক্ষনই থামবে না যতক্ষন না তৃষিত হৃদয়কে শান্ত করা যায়। এই তরলে এত আকর্ষিকতা যে আছে সেটাও জানা ছিলো না আমার। মোহগ্রস্ততা বুঝি একেই বলে। বিশুদ্ধতম তরলটি আমার আশেপাশে থাকলেও আমি বুঝতে পারি, আমাকে পাগলের মত টেনে নিয়ে যায়। তার বিশুদ্ধ ঘ্রাণ আমাকে মোহগ্রস্ত করে তোলে, করে তোলে নেশাতুর। প্রবল তৃষ্ণার্ত আমি আরো তৃষিত হয়ে উঠি। আমার মোহগ্রস্ততা কখনো কখনো নিজের জন্য ক্ষতিকর হলেও তরলটি গ্রহন করার পরে শান্ত হয়ে উঠি, হয়তো মনের ক্ষুদ্র কোনে আকাঙ্খা বাড়ে তবে সেটা সাময়ীকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনা উপভোগ্যতার সময় অপচয়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত। এই মায়াময় মোহনীয় আকর্ষনের কাছে জিম্মি হয়ে আছি অনেক দিন ধরেই। সেই উন্মাদনা আমাকে তরলের কাছে নিয়ে যায় পথ চিনে চিনে, আমাকে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই কখন যে ঘুমন্ত শহরের জেগে থাকা একটুকরো আলোকজ্জল মায়াময় অংশে এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি। অবশ্য বুঝে উঠার চেষ্টাও করিনা। আমার একাগ্রতা শুধুমাত্র তৃষিত হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারন করার দিকেই।
- নিঃসঙ্গ!!
উদ্দামতা পাশ কাটিয়ে ক্লান্ত কিংবা বিরক্ত কিংবা হতে পারে অউপভোগ্যতার কাছে নতি স্বীকার করে আমার মত নিঃসঙ্গ, অন্ধকারাচ্ছন্ন পাশটাকে বেছে নেওয়া হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করলাম প্রশ্ন এবং বিস্ময়মাখা চোখ নিয়ে। সেখানে একসাথে কৌতুক এবং আকাঙ্খা কাজ করছিলো।
- হুম!
ক্লান্তজনিত একটা কন্ঠস্বর আমার কাছে প্রতিউত্তর হিসাবে ভেসে উঠলো। সেই ক্লান্তিটা শারিরিক ছিলো না, ছিলো মানসিক।
- চলো হাটি!! নিঃসঙ্গ রাস্তায় হাটতে খারাপ লাগবে না বোধ করি।
তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্য টোপটা আমাকে ফেলতেই হতো। সেটা সময়ক্ষেপন করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি অতিরিক্ত তৃষিত হৃদয়।
- হুম!! আচ্ছা, চলো!
ভাবনার স্থিরতা কমই ছিলো তার। সেটা এলাকাটার নিরাপত্তার সুনাম অর্জনের জন্য হতে পারে, অথবা হতে পারে নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়ানোর জন্যেও। তবে সেটা নিয়ে আমার ভাবনা কমই ছিলো। আমি আনন্দিত ছিলাম, তৃষ্ণা নিবারনের সময় খুব কাছে চলে আসার জন্য।
রাস্তায় নেমে আসি আমরা। চাঁদ হালকা উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে মেঘের বাঁধা পার হয়ে কিন্তু এখন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রাস্তার দুধারে লাগানো সুসজ্জিত বৃক্ষরাজির জন্য। আলো আঁধারিতে আঁধার বেছে নেওয়াটায় আমার জন্য যুক্তিসঙ্গত ছিলো। তাই আমার কাছ থেকে বৃক্ষগুলোর অবস্থান খুব বেশি দূরে ছিলো না। হাটছি আমরা পাশাপাশি, রাত্রির নিরবতা এবং আমাদের নিরবতা মিলেমিশে তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পান উপযোগী পরিবেশ তৈরী করেছে। এমন পরিবেশে নিজেকে মোহগ্রস্ততার কাছ থেকে দূরে রাখাটা কঠিন। তাই নিরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করলাম,
- মন খারাপ কেনো?
- জানিনা! তবে মাঝে মাঝে এম্নিতেই মন খারাপ হয়ে যায়, কোলাহল হয়ে উঠে চরম বিরক্তিকর বস্তু।
- আমারো!
স্বগতোক্তি করে বলি আমি।
- মনে হয় আশ্রয় নেই কোনো এক আঁধারে! যেখানে আমাকে কেউ খুঁজে পাবেনা।
বলতে থাকে সে।
- আমিও আঁধার ভালোবাসি! আঁধারে আলো খুঁজে ফিরি। খুঁজে ফিরি তৃষ্ণা নিবারনের পানীয়।
আস্তে আস্তে কোমল স্বরে বলি। যেখানে প্রথম উচ্চারিত শব্দের উপরেই যেনো জোর থাকে একটু বেশি। তারপর স্বগতোক্তির মত হারিয়ে যায় শেষের কথামালা।
তবে নিজের বলার চেয়ে আমি তার কথামালা ড্রাগের মত শোষণ করি নেশাতুর দৃষ্টি নিয়ে। তীব্র চাহনী তার কথার ভঙ্গিমা খেয়ালে ব্যস্ত হয়ে উঠে। সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার কোমল সুন্দর গলা দিয়ে বেয়ে উঠা রক্ত পরিবহনে ব্যস্ত শিরা উপশিরায় ঘুরে বেড়ায়। যে রক্ত, পথে চলতে চলতে তার বলা আনন্দের কথায় তার মুখমন্ডলে রক্তিম আনন্দের ছায়া হয়ে ধরা দেয়, বিষাদে মলিন নীল হয়ে উঠে, ঘৃণায় হয়তো কারো জন্য কালো হয়ে উঠে, হয়ে উঠে ভীতিকর গল্পের জন্য ফ্যাকাশে। আমি তৃষ্ণা নিবারনের পূর্বে তাকে পরিলক্ষিত করে আরো তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি। যেমন ক্ষুধার্তরা খাবার টেবিলে লোভজাগানিয়া খাবারের পাশে অপেক্ষা করে আরো বেশি ক্ষুদার্ত আর লোভী হয়ে উঠে তেমনি। আমি অপেক্ষায় থাকি তার কোমলতার জন্য, আমার জন্য সহানুভূতির জন্য। সেই সহানুভূতিটাও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট আমার দ্বারা, তার বলা বিভিন্ন জীবনের গল্পের উপযোগীতায় সৃষ্ট যোগ্য সঙ্গী হিসাবে তার কথা মেনে নিয়ে এবং তাকে বুঝতে পারার নিখুত অভিনয় করে। এতে তার নির্ভরতা বাড়তে থাকে, যেখানে আমিই তার ছিলাম এখন সেই হয়ে উঠে আমার। হয়ে উঠে সবচেয়ে ঘনিষ্ট স্বজন। আমার বাহুতে করেই তাকে পৌঁছে দেই তার ঘরের দরজায়। বিদায় পূর্বে ঘনিষ্ট আলিঙ্গন, চোখে চোখে তৃষ্ণা ভাগাভাগি করে উষ্ণ ঠোটে আশ্রয় নিয়ে পৌঁছে যায় ঘাড়ে স্ফিত হয়ে উঠা রক্ত সরবরাহকারী শিরা-উপশিরায়। আমার সারারাত ধরে রাখা প্রবল তৃষ্ণা মেটাই,আত্মতৃপ্তিসহকারে। তার যন্ত্রণা, তৃষ্ণা মেটানো পানীয়টাকে আরো বেশি উপভোগ্য করে তোলে। শুষে নেই সমস্ত শক্তি দিয়ে, পুনরজ্জীবিত করি নিজের জীবনিকে। সঞ্চয় করে নেই সমস্ত দিনের পানীয় কারন আমি আঁধারে ভালোবাসি। আঁধারেই আলো খুঁজে ফিরি। আঁধারের মাঝেই আমার প্রাণশক্তি, নিঃসঙ্গতার মাঝেই আমার বেঁচে থাকা। তাকে রঙ্গীন করে তোলা রক্তকে চুষে নিয়ে ফ্যাকাসে, বিধ্বস্ত, মিয়ম্রান অবস্থায় আলো আঁধারিতে রেখে সটকে পড়ি। কারন চন্দ্র বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই, যখন তখন তীব্র আলোকমালা নিয়ে প্রতাপশালী সূর্য হাজির হতে পারে। আমি আলো ভয় পাই, আলোয় নিজের অস্তিত্ব বিনাশ হতে পারে। সবাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় প্রতিনিয়ত, সেখানে নিজেকে ব্যতিক্রমি হিসাবে প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ হয়।