ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। গভীর রাত, শুনশান নিরবতা। ঘুমিয়ে পড়া শহর দেখতে ভালোই লাগছে। কেমন যেনো মায়া ছড়ানো, যা দিনের আলোয় উবে যায়। রাত জাগা পাখি একটা উড়ে গেলো, অজানা কোনো ঠিকানায়। গভীর রাত নিকষ অন্ধকার হওয়ার কথা থাকলেও, সেটা হয়না। হালকা আলো থেকে যায়। রাত্রিতে বুঝা যায় রাতের সৌন্দর্য। আগে একসময় দেখতামনা এই মায়াময়তা, সৌন্দর্যের প্রকাশ। এখন দেখি কিংবা দেখতে হয়। অভ্যাসের নদীরা পথ খুঁজে নেয়, খুঁজে দিতে হয়না।
অভ্যাসটা শুরু হয়েছিলো কিশোর বয়স থেকে। দুঃস্বপ্নের প্রচন্ড তাড়া খেয়ে উঠে বসতাম গভীর রাতে। শীতের রাতেও ঘামতাম অবলীলায়। কখনো কোনো পশু আমাকে তাড়া করে ফিরতো। কখনোবা আমি পড়তে থাকতাম সুউচ্চ কোনো স্থান থেকে। যে পড়ার আদি কিংবা অন্ত নেই। থাকতো শুধু শূন্যতা। কখনোবা দেখতাম এলোমেলো ছবি যার কোনো মাথামুন্ডু নেই, মিলাতে গেলে আরো বিশৃঙ্খ্যল হয়ে যেতো ছবিগুলো। রুপ নিতো ভয়ঙ্কর কোনো বস্তুর। হয়তো নিজেই পরিবর্তিত হতাম অন্যকিছুতে কিংবা পরিবর্তিত বস্তুর তাড়নায় ঘুরে ফিরতাম। এক একটা রাত ছিলো দুঃসহ। যার দরুন রাত পরিনিত হয়েছিলো ঘুমের সমাধিক্ষেত্রে। অসহ্য যন্ত্রনায় কাটতো এক একটা রাত। নিঃসঙ্গ রাত। একাকীত্বের রাত।
রাত্রীর উপভোগ্যতা টের পেয়েছিলাম কিছুদিন পরেই। যান্ত্রিক যুগের কৃত্তিম বলয়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে। খুঁজে পেয়েছিলাম আমার মত অসংখ্য যন্ত্রনায় দগ্ধ মানুষকে। যাদের সংস্পর্শে আমার রাতো আলোকিত হয়ে উঠছিলো, হয়ে উঠছিলো বর্ণিল। একসাথে আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম রাতের দুঃস্বপ্নকে যা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হয়ে উঠেছিলো নির্জীব। তার নির্জীবিতা আমাদের কাছে ছিলো উল্লাসের বিষয়, আমাদের উপভোগ্যের বিষয়, তামাশার বিষয়। তাকে কাঁটাছেড়া করতাম জীববিজ্ঞানের ল্যাবের ব্যঙ এর মত করেই, সে বেঁচে থাকুক কিংবা মরে যাক সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ ছিলো কমই। ভালো লাগতে শুরু করেছিলো রাতের চাঁদ, হিমেল হাওয়ার পরশ। অন্ধকারে জেগে থাকা স্ট্রীট ল্যাম্পের মায়া ছড়ানো আলো। তেমনি কোনো এক রাতে আমার সাক্ষাত হয়েছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে মায়া ছড়ানো মানুষটির সাথে, কোনো এক য়ান্ত্রিক সভ্যতার ঘরে। তার হাসি, খুশি, ক্রোধ, কিংবা হেয়ালী সব কিছুই মায়াময় মনে হতো। কথা হতো আমাদের কবিতার ছন্দ মিলানোতে, কথা হতো জীবন যুদ্ধের কঠিন সময় নিয়ে, কথা হতো গল্পের উপসংহার নিয়ে। হয়তো মিলে যেতো আমাদের অধিকাংশই। কিংবা মিলিয়ে নিতাম জয় পরাজয়ের মাধ্যমে। যেখানে পরাজয়ের স্বাদই ছিলো বেশি আনন্দের। তার মন খারাপটুকু নিয়ে নিয়ে হাসি ফিরেয়ে দেওয়াই সচেষ্ট ছিলাম, ছিলাম স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন গুলো আকাশ ছোঁয়া হলেও বাস্তবতায় নিয়ে আসায় সচেষ্ট ছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম হাসিমুখের, স্বপ্ন দেখতাম হাটছি দুজনায় কোনো উত্তাল সাগরের পাশ দিয়ে একে অন্যের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে। সূর্যটা উঠছে কিংবা ডুবছে সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই, আমরা হাটছি পানির সমান্তরালে সামনের দিকে পিছনে ফেলে দুঃস্বপ্ন, দুঃসময়কে।
ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। রাত্রি উপভোগ করছি। হিমেল পরশ শরীর জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন পুরনে কয়েক ধাপ বাকি। তারপর একটি হাত আমার হাতের মুঠোর ভিতর থাকবে, যখন সুউচ্চ স্থান থেকে পড়বো সে আঁকড়ে ধরে রাখবে। কখনোবা ঘর্মাক্ত আমার ঘাম মুছিয়ে দিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি দিবে। পরিবর্তিত যন্তুর সামনে সে দাত কেলিয়ে হাসবে কিংবা আমরা দুজনেই হাসি দিয়ে ভড়কে দেবো তাকে। আমরা হবো দুঃস্বপ্নের দুঃসময়।
উৎসর্গঃ প্রিয় দুইজন মানুষ, কবি, লেখককে। তাদের ভবিষ্যত শুভকামনায়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ রাত ১১:৪১