গল্প ১ঃ
দেবতা বসে ছিলেন উচ্চাসনে। পা ধরে পূজারী অঝরে কেঁদে চলছিলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই দেবতার। সে পূজারীর ভোগে সন্তুষ্ট নয়। বরং আরো বেশি কিছুর প্রত্যাশায়। স্তুপকৃত ভোগের দিকে তাকিয়ে অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের মাধ্যমে জানালেন পূজারীদের তিনি এত অল্প ভোগ দিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। কারন এটা নিয়ম নাই। এখন দেবতার সংখ্যা অনেক বেশি, তাছাড়া দেবতাদের জীবন চালানোর জ্বালানী বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ব্যয়। অন্য কোনো আশ্রমে নিয়ে যেতে পারেন সেখানে যদি কম ভোগে পারেন তবে বাঁচিয়ে আনুন মাংসপিন্ডটিকে।
পূজারীরা দেবতাকে আকুলভাবে ডেকে ডেকেও মুখ ফিরাতে পারছিলেন না নিষ্পাপ পবিত্র একটি মুখের দিকে। দেবতার আগে চোখ চলে যাচ্ছিলো ভোগের দিকে তারপর সেই অনুযায়ী পরিমিত হাসি হাসছিলেন।
দেবতা আজ বিক্রিত, তার কাছে নিষ্পাপ কিংবা পাপের কোনো মূল্য নাই। তার কাছে আবেগের কোনো আশ্রয় নাই। তার প্রয়োজনীয়তা ভোগেই সীমাবদ্ধ। সে যাদের কারনে দেবতা তাদেরকে ভোগ দ্বারা পরিমাপ করে, স্তুপের উচ্চতানুযায়ি পূজারীও তার কাছে দেবতা হতে সময় নেয় না।
গল্প ২ঃ
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে কিংবা কুয়াশা, বোঝার উপায় নেই। আজ দুদিন ধরে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ছে। তবুও গ্রামটির একমাত্র ছোট্ট হাসপাতালটির জানালার ধারে বসে আছি আমি, দেখছি আমার অতি প্রিয় ছোট্ট একটি মুখ। ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই, কারন আমি একজন অচ্ছুৎ। কেউ ভালোবাসতেও যেনো ভয় পায়। সেই ভালোবাসাহীন জগতে একমাত্র প্রিয় বন্ধুটিও আজ মলিন মুখে শুয়ে আছে ভরসাহীন চোখে হাসপাতালের জীর্ণ বিছানাটিতে অন্যান্য ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলোর সাথে। ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত বাবা মায়েরা আকুল চোখে প্রতিক্ষা করছে শহরের প্রতিনীধিদের পানে যারা আনতে গেছে ছোট্ট মুখে হাসি ফুটানোর, ছোট্ট পায়ের ব্যস্ততা দানকারী একমাত্র প্রতিষেধক আনতে। টুপ শব্দ করে শিশির পড়লেও পড়িমড়ি করে ছুটছে বাবা-মায়েরা গ্রামটির প্রধান ফটকে, একই সাথে আশা এবং হতাশা সাথে নিয়ে ।
আজ তৃতীয় দিন উচ্চবিলাসী, স্বপ্নবাদি প্রতিনীধিদল পৌঁছায়নি। ছোট্ট মুখগুলোর কষ্টের নীল বাড়ছে বই কমছে না, বাবা-মায়ের চোখে মুখে উৎকন্ঠার যায়গায় আস্তে আস্তে যেনো হতাশা দখল করে নিচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে আমি প্রতিনিয়ত জানালা দিয়ে ছোট্ট প্রিয় মুখের রঙ পরিবর্তন দেখে যেনো দায়িত্ব শেষ করছি। আসলেই কি তাই?? আমার আর কিছুই কি করার নেই?? শুধুই কি চেয়ে চেয়ে দেখা একমাত্র বন্ধুটির অবর্ননীয় কষ্ট! হ্যা, এই চিন্তাটায় আমাকে পরিবর্তন করে দিয়েছিলো সেদিন। আমি পরিবর্তিত আমি, যে ভয় পায় না কাউকেই, কারো অনুমতির তার প্রয়োজন নেই। সে যাবে, যাবে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে শহরের পানে। যদি সম্ভব হয় নিজের জীবন দিয়ে হলেও প্রিয় মুখটিতে হাসি ফুটাতেই হবে তাকে।
কর্পদকহীন আমি ছুটছিলাম বিজন পথে। তীব্র শীত এবং কুয়াশাকে উপেক্ষা করে। প্রচন্ড ঝড় ও আমাকে থামাতে পারবেনা আমি জানি, কারন আমার হাতে ছিলো অতি মূল্যবান অল্প কিছু সময়। এর মাঝে আমার কাজ শেষ করতে না পারলে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলবো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে।
স্বপ্নবিলাসী প্রতিনীধিদলকে বিপর্যস্ত এবং খেই হারিয়ে ফেলা অবস্থায় পেয়েছিলাম পথেই। যাদের দরকার ছিলো একজন নেতা যেকিনা সঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে। এই বিতাড়িত আমাকেই তারা মেনে নিয়েছিলো তাদের দিশারী হিসাবে, পর্যদুস্ত হয়ে হয়ে। আমি তাদেরকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা পৌঁছুতে পারবো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এবং নির্দিষ্ট স্থানেই।
আমি আশা করিনি, আমি কল্পনাও করিনি কখনো, এমনভাবে তারা আমাকে ভালোবাসবে। একজনের ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে আজ আমি গ্রামের সকলের ভালোবাসার পাত্রে পরিগনিত হয়েছি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আসতে পেরে, হাসি ফিরিয়ে দিতে পেরে ছোট্ট প্রিয় মুখগুলোর মুখে। ছোট্ট পা গুলো আজ ব্যস্ত একে অন্যের পিছনে ছুটতে। একটুখানি ভালোবাসা একটুখানি বিশ্বাস বদলে দিতে পারে অনেক কিছু যা আমি নিজেকে দিয়ে বুঝেছি। বুঝেছি আত্মত্যাগের মাধ্যমে।
গল্পের গল্পঃ
উপরের গল্প দুটি সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা। গল্প দুটি ভিন্ন। গল্পের নায়কেরাও। প্রথম ঘটনাটি অহরহ ঘটে, প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা খুললে চোখে পড়ে। কিংবা আপনি যদি কোনো সেবা কেন্দ্রে যান তবে বুঝতে পারবেন, বিশেষ করে হাসপাতালে। সেখানে আপনি কে বা কি তার কোনো মূল্য নাই আছে আপনি তাদেরকে কতটুকু ভোগ দিতে পারবেন তার। এর নায়ক কে সেটা আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়।
দ্বিতীয় ঘটনার নায়ক একটি কুকুর। হ্যা, একটি কুকুর যার নাম বাল্টো । এই কুকুরটি ১৯২৫ সালে প্রচন্ড তুষারপাত উপেক্ষা করে ডিপথেরিয়ার প্রতিষেধক আনতে পাড়ি দিয়েছিলো ৬০০ মাইল পথ। বাঁচিয়েছিলো অসংখ্য শিশুর প্রাণ। কোনো খ্যাতি কিংবা লোভের জন্য নয় শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য। মনিবের প্রতি আনুগত্যের জন্য।