পুরো আকাশটাই নীলে ঠাসা। কালো মেঘের আঁচড় পড়েনি কোনো অংশেই! নীল আকাশ দেখার মাঝে আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করে। এমন কিছু ভালোলাগা আছে যার বিশেষ কোনো কারণ নেই। কারণহীন ভালোলাগা অনুভূতি বড় বেশী আবেগী। মানুষটাই যেহেতু আবেগপ্রবণ তাই এমন অনুভূতির তীব্রতাকে স্বাগত জানাই স্বতঃর্স্ফূতভাবে।
একটু পেছনে ফেরা যাক। দশ-বিশ বাড়ির অনেকগুলো শিশু যখন একসাথে মানুষ হচ্ছিলাম সেই সময়ের কথা। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানো, সবুজ মেঠোপথ চোখ বুজে দৌঁড়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা ছিলো দারুণ এক নেশার মত। একেক ঋতুতে একেক রকম খেলার আয়োজন থাকতো আমাদের। আমার মনে পড়ে, ভাপা পিঠা খাওয়ার পর আমি একদৌড়ে পাশের মাঠে চলে যেতাম। সেখানে ঘাসের ডগায় হাত বুলিয়ে যেতাম, কিছুক্ষণ পর দেখতাম শিশিরে হাত ধোয়া হয়ে গেছে! এর মাঝে ব্যতিক্রম এক বিনোদন কাজ করতো যা শুধু আমিই করতাম।
আমি যখন ফাইভে পড়ি তখন কোনো এক শীতের গভীর রাতে আমার দু'বছরের ছোট বোনটা প্রস্তাব দিলো সকালের নাস্তাটা হবে ভাপা পিঠা। দু'জন মিলে সেই পিঠা তৈরী করে আব্বা-আম্মা আর ভাইয়াকে চমকে দেবো। তখন আমি রাত জেগে পাঁচমিশালী গান শুনতাম রেডিওতে। ঐ রেডিওটা ছিলো আমার নানুর দেয়া বিশেষ উপহার। রাত যত গভীর হতো সেরা গান শোনার সুযোগ হতো তত বেশী। আমরা দু'বোন একসাথে ঘুমাতাম। পাশাপাশি দু'বালিশের মাঝখানটায় ঐ যন্ত্রটা ইচ্ছে করেই রাখতাম যদিও ভলিউম কমিয়ে শুনতাম। তাতেও বোনটা বিরক্ত হতো আমার উপর। ও নীরবে ঘুমাতে পছন্দ করতো। কিন্তু সেদিন রাতে ও বিরক্ত না হয়ে আনন্দের সাথে প্রস্তাবটা দিলো। আমার সদুত্তর পেয়ে সে আহ্লাদে গদগদ হলো। আমি বরাবরই ওসব কাজে উদাসীন ছিলাম। রান্নাঘর আমাকে খুব কম আকর্ষণ করতো। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া যেতামনা।
ভোর সাড়ে চারটার দিকে শুরু হলো চুপিচুপি পিঠা তৈরীর উৎসব। শোবার ঘরের ঠিক পাশেই ছিলো রান্নাঘর। পিঠার সরঞ্জাম যেমনঃ গুড়, চালের আটা, নারকেল সবই আগে থেকেই ছিলো। আমাদের কাজ ছিলো চুলা ধরানো এবং সবকিছু ঠিকঠাক প্রয়োগ করে চুলায় চাপানো। একটা পিঠা হতে সময় লাগে কিছুুটা। এই ফাঁকে আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে কোলের কাছে রাখা ছোট্ট যন্ত্রটাতে কান পাতলাম। 'গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি, আমায় চমকে দাও, চমকে দাও......' গানের মাঝপথে আচমকা হাতের স্পর্শে ভলিউম বেড়ে গেলো। সেই সাথে বেড়ে গেলো ছোট বোনটার খিটিমিটি। শোনা গেলো আব্বার কঠিন স্বর- 'কিরে, এত ভোরে তোরা কি করিস ওখানে?!' সকল চমক একটি গানের সুরেই ভেসে গেলো।
আমার শৈশবে আব্বা-আম্মাকে নিয়ে আমাদের চমৎকার সময় কাটতো শুক্রবার। সবার ছুটি, পরম ভালোলাগার এক মুহূর্ত। একসাথে আড্ডা দেয়া, চুলার ধারে বসে সকালের নাস্তা খাওয়ার মজাই ছিলো অন্যরকম। পড়াশুনা নিয়ে কোনো চাপাচাপি ছিলোনা। ইচ্ছে হলে পড়তাম ইচ্ছে না হলে ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আদিগন্ত সবুজে। কোনো নিষেধাজ্ঞার বালাই ছিলোনা। জোড়া পুকুরে কতবার বাইন মাছ ভেবে মেটে সাপ ধরেছি তার হিসেব নেই। কোনো ভয় কাজ করতোনা তখন। পুকুরধারে হিজল ফুল কুড়ানো, উঠোনকোণে শিউলি ফুলের শুভ্রতা সবই আমাকে প্রবলভাবে স্পর্শ করতো। বাতাসে নেচে ওঠা সবুজ ধানক্ষেতের অপূর্ব দৃশ্য দেখে প্রায়ই আমি তন্ময় হয়ে যেতাম। কচি কোমল মনের ভেতর কী নৃত্যই না খেলে যেতো তখন।
সবকিছুর মাঝেই অপার আনন্দেই বড় হতে থাকলাম। পরিবার একটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে সুন্দর গড়নের ক্ষেত্রে। এই ভূমিকা আমাকে কিছুটা হলেও ছুঁয়ে যেতে পেরেছে। এইটুকুন বয়সে আমি বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরা, দেবী চৌধুরানী, কপালকুন্ডলা রীতিমত মুখস্থ করে ফেলেছিলাম দাদুর মুখে শুনে শুনে। আমার দাদু ছিলেন অসম্ভব পড়ুয়া একজন মানুষ। তার পড়ার ভঙ্গিমা ছিলো অসাধারণ। প্রতিটি চরিত্র উনি অভিনয় করে করে পড়ে যেতেন। যে কারণে চরিত্রের ভেতরে ডুব দেয়া ছিলো অতি সহজ একটা বিষয়। যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার আনন্দ বেদনা দুটোই আছে। তবে, বেদনার পাল্লাটা আমি কখনো হিসেব করতে চাইনা। আনন্দটাই সেখানে ছিলো মুখ্য। যা পরিমাপ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
লেখালেখির অভ্যেস সেই ছোট থেকেই। ছন্দটা টানতো চুম্বকের মত। রক্তের মাঝে ছন্দ বহমান। যা কিছু লিখতাম সবকিছুর মাঝেই ছন্দ এসে ভিড় জমাতো। এতে আমার কোনো কৃতিত্বই নেই। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমি একে ভালোবেসে ফেলেছি। তাই হয়তো আমার থেকে ছন্দগুলো সরতেই চায়না। সময়ের ভেলায় ভেসে ভেসে আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। এখন লেখার জগতে কত কিছুর আবির্ভাব! কলম ধরিনা আজ বহুদিন! কি-বোর্ডে এই দশ আঙ্গুলের ব্যবহার চলছে প্রায় চৌদ্দ বছর। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমাকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে লেখার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে রাখতে। আমি সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বিরামহীনভাবে।
লক্ষ্য করে দেখলাম, এ জগতটা আমার ভীষণ পরিচিত। ঠিক যেনো আমার পরিবারের মতই অনেকটা। এখানে কথার খুনসুটি হয়, ভালোলাগায় মুগ্ধতার জাল বোনা হয়, স্বপ্নের মাঝে বিচরণও করা হয় অদ্ভুত নেশায়। সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে তথ্যবহুল লেখাও মন দিয়ে পড়ার সুযোগ হয়। ভাবনার আদান-প্রদান করা যায় নিমিষেই। মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসে কত কি চমৎকার ঘটনাবলী! পরিমার্জিত এবং পরিশীলিত ভাষার ব্যবহার আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে। খুব ইচ্ছে করে আমার এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ খুব সাবলিলভাবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখালেখির উঠোনে চলাফেরা করবে। তাদের মাঝে কোনো কারণেই যেনো অস্বস্তির কোনো বিষয় দানা বেধে না ওঠে। স্বস্তির সাথে তারা যেনো তাদের সকল ভাবনাগুলো শেয়ার করতে পারে। এমন একটা মহৎ ইচ্ছে বার বার জেগে উঠছে মনের কোণে।
আমি সবসময়ই একটা কথা বলি- সবুজে বাঁচি। সেই যে ধানক্ষেতের অবাধ নৃত্য দেখেছিলাম ছোট্ট বেলায়, সেই সময়টাকে আমি এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই। কারণ, আমি সেই সময়টাকে খুব করে চাই। ভালোলাগা অনুভূতিগুলোকে হাতের কাছে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে চাই। এ নির্মল আনন্দ সবাই পায়না কিম্বা পাওয়ার চেষ্টাই হয়তোবা করেনা। আমার চারপাশে অসংখ্য খারাপলাগা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সহ্য করা কঠিন। সবুজে ছিলাম এখন পুরো দেশটাকেই আমার মরুভূমি মনে হয়। তারপরও কিছু মানুষ সেই মরুভূমির বুকে সবুজ চাষাবাদের চেষ্টা করে। যাবতীয় সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে, আলোকিত পথের দিকে। আমরা একটু চেষ্টা করলেই সেই পথের দেখা পেতে পারি। সেই পথ খুব একটা দূরের কিছু নয়। শেষমেশ চারটি লাইন দিয়ে যবনিকা টানি-
নীলের ভিড়ে আটকে থাকুক
চমকানো সব দিন,
সবুজ ক্যানভাস রঙে ভাসুক
বাজুক সুখের বীন।