সবুজ ঘাসগুলোতে শিশির কণা মুক্তোর মত আটকে থাকার দিন শুরু হলো। ঘন কুয়াশা তখনও দলবেঁধে ধরার বুকে আছড়ে পড়েনি। খাল-বিলে বর্ষার স্মৃতি যেনো কিছুটা আটকে আছে। শরতও শেষ হয়েছে অনেকটা ঝড়ের মত। হুটহাট এসে হৃদয়কে তোলপাড় করে চলে গেছে দূরের তেপান্তরে। আনাগোনা চলছে শিশির দিনের। আদিগন্ত মাঠে জমে থাকা জলে, খেলে যাচ্ছে ডানকনা মাছ। একঝাঁক শুভ্র বক একপায়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ক্লান্তিহীন। পানকৌড়ি খুঁজে বেড়ায় স্বচ্ছ জলধারা। আর আমি খুঁজি আমার সেই ছোট্ট ডিঙ্গি। যার গলুইয়ে বসে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরার নেশায় আমি হয়ে যেতাম পাগলপারা।
প্রকৃতির বুকে যখন ঝিরিঝিরি বাতাস বইতো তখন এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যেতো শরীরে। বর্ষা শেষে মাছ ধরার ছিপগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখতাম রান্নাঘরের এককোণে। বাড়ির ঠিক পাশেই আমাদের বড় এবং মেঝো চাচার পুকুর ছিলো পাশাপাশি। ভরা বর্ষার মৌসুমে দুটো পুকুরই তাবৎ খালবিলের সাথে এক হয়ে যেতো। আর মাছেরা হয়ে যেতো অনেকটা আমার মত! বন্দী ছোট্ট পুকুর থেকে তারা বেরিয়ে পড়তো চেনা গন্ডি থেকে অচেনা বড়সড় গন্ডিতে। শীতের আগেভাগেই পুকুরগুলো জেগে উঠতো আগের মত। শ্যাওলা পড়া ঘাট চোখে পড়তো অনেকটা সময় পর। সেই ঘাটে বসে মাছ ধরার নেশা পেয়ে বসতো আমাকে। শুধু আমি নই, আমার সাথে বাড়ির ছোট-বড় অনেকেই যোগ দিতো সেই দুর্দান্ত নেশায়। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার মজাই আলাদা। নানান বয়সী মানুষদের সাথে নানানরকম ভাবনার উঠোনে গড়াগড়ি করার সুযোগ! কত্তগুলো শিশু আমরা একসাথে!! আহা! কী সময় ছিলো আমাদের!
'সবার বড়শি ধলাকালা
আমার বড়শি সবরি কলা
টপ কইরা গিলা ফালা
আমার নাম আনুম
মাছ ধইরা টানুম।'
উপরোক্ত কথামালা একযোগে সুর করে গাইতাম। এই গানে নাকি মাছেরা ভিড় করে এবং বড়শির টোপ গেলার চেষ্টায় থাকে। ক্রমানুসারে বড় চাচা, মেঝো চাচা থেকে শুরু করে সাত বছরের এই আমিও বাদ যাইনি। উক্ত ছন্দের পশরায় বড়শিতে মাছ ধরার সমূহ সম্ভাবনা আছে বিধায় সবাই ছিলো যারপরনাই চিন্তিত এবং আশাবাদী। সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম সুতোয় বাঁধা ভাসমান পাটকাঠির দিকে। একটু একটু করে যখন কাঠিটা নড়তো তখন কী যে উল্লাস কাজ করতো তা বলার নয়। আর যদি ডুবে যেতো কাঠিটা, তখন খুশিতে সবাই আত্মহারা। কারণ, মাছ আটকে যাওয়ার সাথে কাঠির ডুবে যাওয়ার একটা চমৎকার সম্পর্ক আছে বৈকি!
আমার এক দাদা ছিলেন যিনি তার প্রতিটা কথায় ছন্দের যাদু টেনে আনতেন। গ্রামে তার নাম ছিলো ছন্দের যাদুকর! ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অসাধারণ ছন্দমালায় জুড়ে দেয়ার দক্ষতায় পটু ছিলেন তিনি। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি পরিবেশে নারকেল গাছের নিচে পাটি পেতে আমরা সেই ছন্দকথা শুনতাম। তিনি শুরু করতেন- 'যাও কন্যা ঘর। আমার নাম বৈলবিদ্যাধর।' এটা ছিলো একটা বিশেষ গল্পের শুরু। নিজে থেকেই নানান শব্দের কারিগরিতে তিনি গেঁথে যেতেন একের পর এক কাব্য। গাছের ফাঁক গলে যখন পরিপূর্ণ চাঁদ সেই কিঞ্চিত আঁধারি পরিবেশটাকে মায়াবী আলোয় ভরিয়ে দিতো তখন শিশুমনটা কেমন আনচান করে উঠতো। কত কি ভেবে যেতো সেই আলুথালু মন! গল্পের প্রতিটি লাইন চোখের সামনে স্পষ্ট হতে থাকতো। সেই দাদা এখনও বেঁচে আছেন এবং যথেষ্ট সুস্থ আছেন। যখনই আমি আমার গ্রামে যাই তখনই সেই গল্পটা শোনার বায়না ধরি উনার কাছে। উনি গভীর মমতা নিয়ে সেই গল্পের শুরু করেন আর আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। সম্ভবতঃ তিনি সেটা আঁচ করতে পারেন এবং অনেকটা সময় নীরব থাকেন।
আমাদের মেঝো চাচা ছিলেন দারুণ ছিমছাম মানুষ। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। তার কথায় কোনো আঞ্চলিকতার টান ছিলোনা। নিজের পোশাক নিজেই ধুয়ে দিতেন এবং সবসময় আয়রন করা কাপড়চোপড় পরিধান করতেন। দেখতেও ভীষণ সুন্দর ছিলেন তিনি। গানের গলা ছিলো অপূর্ব। গান লিখতেন এবং সুরও করতেন তিনি। ছোটদের নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজনের উদ্যেক্তা মূলতঃ তিনিই ছিলেন। আমার বেশ মনে আছে, একবার আমাদের এই চাচা তার বাড়িতে একটা বাগান করলেন। কামিনী থেকে শুরু করে শিউলি সবই ছিলো। ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহে উনি বাড়ি আসতেন। কারণ, ঢাকা ছিলো উনার কর্মস্থল আর বাড়িতে সংসার। আসার সময় খুব কৌশলে নানান প্রকার ফুলের গাছ নিয়ে আসতেন এবং আমার হাত দিয়েই তিনি সেইসব গাছ লাগানোর আব্দার করে বসতেন। তার ধারনা ছিলো- আমার হাতে নাকি গাছ মরে যায়না। গাছেরা প্রাণ পায়। তার এই অদ্ভুত আব্দারে আমি রীতিমত আবেগাপ্লুত হতাম এবং সেই চেষ্টায় সফল হতাম। নিজেকে নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে হতো। আমার উপর নির্ভর করা যায়, তার মানে, আমি আসলে ততটা ছোট নই!!
'সোহাগ করা তারি সাজে শাসন করে যে'...এই অর্থহীন বাক্যটি আমার ক্ষেত্রে একেবাড়েই ব্যবহৃত হয়নি তা নয়। তবে, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমার উপর আঁচড় কম পড়তো। আমাদের ঘরের একটা জানালার শিক ভাঙ্গা ছিলো, সেই ভাঙ্গা স্থানটা আমার বড় বেশী প্রিয় ছিলো। অনায়াসেই আমি সেই ফাঁকা দিয়ে ছুটে পালাতাম। আশ্রয় নিতাম আব্বার বড় চাচীর কাছে। ছোটখাটো গড়নের ধবধবে চুল, শত সহস্র ভাজসমৃদ্ধ হাত, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর স্বল্প কথা বলা বিশিষ্ট এই মানুষটির গায়ের ঘ্রাণ আমার বরাবরই ভালো লাগতো। তিনি একমনে বলে যেতেন- 'সোলেমনের (সোলায়মান) সাহসতো কম না! আমার কইলজাডার শরীরে যুদি ইট্টুখানি ছুঁয়া লাগে তাইলে দেহিস তোরে কি করি! আহুম (আসবো) নাকি আমি?!' আব্বার উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি হতো আর আমি তার চারপাশে তার শখের পোষা ডজনখানেক বেড়ালের সাথে এক হয়ে যেতাম। সারাদিন দাদুর সাথে থেকে শেষবেলায় বাড়ি ফিরতাম। আব্বা তখন অন্যরকম মানুষ। রাগের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকতোনা আর। মেঝোটা আবার অসম্ভব জেদি ছিলো । ওকে শারীরিক আঘাত করলে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং বলতো- 'আরো মারেন, থামলেন ক্যান? মারেন।' তবে, এমন অত্যাচার আব্বা দু'একবারই করেছেন। যার ছিটেফোটা আমাতে পড়েনি আমার অনবদ্য কৌশলের কারণে।
সামনেই শীতের মৌসুম। আকাশে বর্ণিল মেঘেরা সাজুগুজু করে বেড়াচ্ছে। তিনদিন ধরে দমকা বাতাসও ছুটছে বিরামহীন। আজ ভোরে একপশলা বৃষ্টিও আলিঙ্গন করলো ধূলির ধরা। শীতের বুঝি আর তর সইছেনা। স্মৃতির জানালাগুলো খোলাই থাকে সবসময়। অতি কল্পনাপ্রবণদের স্বস্তি যেমন আছে তেমনি কষ্টও আছে ঢের। এই যে মেঘলা আকাশ, বিরামহীন বাতাস আর বৃষ্টির আলিঙ্গন সবই আমাকে আমার সেই সময়ের ভিড়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতির সব রুপই আমার অনেক পরিচিত। আজ আমি আমার অনেক প্রিয়জন ছেড়ে অনেকটাই দূরে। ভাইবোনগুলো একেক স্থানে ছড়ানো ছিটানো। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে হাতের মুঠোয় অনেক সুযোগ-সুবিধা। তারপরও আরো কত কি না পাওয়া ঘিরে থাকে এই আমাকে! স্মৃতির ঝাঁপি খুললে আনন্দ-বেদনার কাব্যগুলো এক নিমিষেই চলে আসে মনের আদিগন্ত আকাশে। এখানে উড়ে যায় পানকৌড়ি কিম্বা একঝাঁক শুভ্র বক! মন নদীতে খেলে যায় তীব্র অনুভূতির খেলা। যেখানে থেমে থাকা ডিঙ্গির গলুইয়ে বসে, ছিপ হাতে একজন শিশু অপেক্ষায় থাকে ছন্দের পশরায় মাছ ধরার দুর্দান্ত নেশায়! যে নেশা তার বড় বেশী কাঙ্খিত।