somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঁচার আশ....

২৫ শে জুন, ২০১৩ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাড়ির ঠিক উত্তর পশ্চিম কোণে প্রকান্ড এক শিমুল গাছ ছিলো। টকটকে লাল আভা নিয়ে ফুটে থাকতো শিমুলফুল। অলস দুপুরে সেই গাছের তলায় একটা পাটি পেতে, গাছের শিকড়ে মাথা রেখে পড়ে যেতাম রুপকথার বই। রুপকথার সোনার কাঠি রুপার কাঠির জগতে থেকে আমার শিশুমনের বিশাল জগতটা টইটুম্বুর আনন্দে ভাসতো। সেই বই যেনো আবদ্ধ ঘরে পড়া যায়না, এর জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে শিমুলতলা। সেটা ছিলো আমার তপ্ত দুপুরের সেরা বিনোদন।

আমার বেড়ে ওঠা যৌথ পরিবারে। দাদা, দাদু, তিন চাচা, চাচী আর তাদের সন্তানদের সাথে কাটতো আমার সারাবেলা। সবাই যার যার মত ব্যস্ত মানুষ। বড় চাচা ঢাকায় থাকতেন। প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। তিনি এলেই হুল্লোড় শুরু হতো। আমাদের দাদু'র চোখমুখ চিকমিক করতে থাকতো। কারণ, তার বড় ছেলে প্রতি সপ্তাহেই তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বই নিয়ে আসতেন। দাদু ছিলেন অসম্ভব পড়ুয়া একজন। আমার এখনও মনে পড়ে, বঙ্কিম চন্দ্রের বেশ কিছু লেখা আমি আমার দাদুর মুখে শুনেছি। যেগুলো পরবর্তীতে আমাকে নতুন করে পড়তে হয়নি। তার বলার ভঙ্গিমা ছিলো এতটাই মনোমুগ্ধকর এবং জীবন্ত। প্রতিটি চরিত্র আমার চোখের সামনে ভাসতো, মোটকথা তিনি ভাসাতে পারতেন।এ ছিলো উনার বিশাল দক্ষতা। কপালকুন্ডলা, রাধারানী, দেবীচৌধুরানী'র কাহিনী শুনে শুনে কত স্থানেই যে আমার মন বিচরণ করেছে তার হিসেব নেই। বাড়ির সকল শিশুদের মধ্যমনি ছিলেন আমাদের দাদু। আমার বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। স্মৃতির ঝাঁপি যখনই খুলি তখনই তার সেই চিকমিকে মুখটা মনে পড়ে আমার।

আমি বড় বেশী সৌভাগ্যবান। ষড়ঋতুর আমেজ আমার ভেতরে সবসময়ই টইটুম্বুর ছিলো। এখন আষাঢ় মাস। আষাঢ় এলেই আমি ফিরে যাই আদিগন্ত খালবিলের চিত্রে। যেখানে একজোড়া চোখ দেখতো নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। লাল-সাদা শাপলার হাট বসেছে যেনো। নতুন পানিকে বরণ করেছে স্থির থাকা কচুরীপানার পুকুরগুলো। কি স্বচ্ছ সেই জলধারা! সেই জলধারার উপর দিয়ে উড়ে যেতো একঝাঁক সাদা বকের দল। আরো ছিলো নাম না জানা হরেক রকম পাখির আনাগোনা। বিচিত্র সেই পাখিদের ওড়াওড়ি দেখে খুব ইচ্ছে করতো তাদের দলে ফেরার। হৃদয়ের কল্পরাজ্যে কখনো যাইনি তা কিন্তু নয়। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এর কোনো শেষ নেই, সম্ভবতঃ শেষ থাকতে নেই।

আমাদের গ্রামের নাম 'বানিয়াড়া'। আমার এক মামা ছিলেন যিনি আমাদের গ্রামটাকে নিয়ে বেশ মজা করে বলতেন- 'দুনিয়ার যত আড়াগাড়া, তাই দিয়া বানাইছে বানিয়াড়া'। সত্যিই, আমাদের শৈশবের সময়টাতে আমার কাছে মনে হতো আমি একটা জঙ্গলের মাঝেই বসবাস করছি। যে জঙ্গল ছিলো আমার অসম্ভব প্রিয়। বাড়ির একদম উত্তরে ছিলো বিশাল বাঁশঝার। তার চারপাশজুড়ে ছিলো ছোট-বড় নানান ধরনের গাছপালা। পানির নিচে সর্পিল ভঙ্গিতে শোভা পেত স্পাইরোগাইরা সহ নানান সব উদ্ভিদ। নিজের হাতে ছোট-ছোট হাত বড়শির মাঝে কেঁচো গেথে সেগুলো ফেলে রাখতাম সেই পানির মাঝে। সূর্য্যের নরম আলো ফোটার আগেই সেখানে চলে যেতাম এই আমি! কোনো বড়শিতে আটকে থাকতো বাইম মাছ, কোনোটাতে কই আবার কোনো বড়শিতে পেঁচিয়ে থাকতো সাঁপ। এখন ভাবলে গায়ে শিহরণ জাগে। কি দস্যি ছিলাম সেসময়! কোনো রকমের ভয় কাজ করতোনা তখন। পুব আকাশটা তখন একটু একটু করে লালচে হতে শুরু করেছে। আমি সেইসব মাছ, সাঁপ নিয়ে বাড়ি ফিরছি। হাত দিয়ে বড়শি থেকে সাঁপ ছোটানোর কাজটা করার ক্ষেত্রে আমি ছিলাম এক অবন্ধ্য শিশু। রীতিমত স্বাধীনচেতা একজন।

সাঁতারে পটু ছিলাম দারুণ। আমাদের পিতৃদেব চার ভাইবোনকে এইটুকুন বয়সেই রীতিমত পারদর্শী করে তুলেছিলেন সাঁতারে। উল্টোসাঁতার থেকে শুরু করে ডুব সাঁতার সবটাতেই চৌকস ছিলাম আমি। পানির এলাকার মানুষ আমি। চারদিকে বিলঝিল, আর পুকুরের অভাব নেই। বর্ষার জলে এম্নিতেই থই থই করতো চারপাশ। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে মাছ ধরার বিষয়টা শুধুমাত্র ছোট ছোট হাত বড়শিতে স্থির থাকলোনা। তা ছড়িয়ে পড়লো হরেকরকমের জালে এবং বিচিত্র সব ছিপে। সেই অভিজ্ঞতা বড় বেশী আনন্দের। হাত থেকে ছুটে যাওয়া মাছ সবসময়ই আমার কাছে বড় বলেই প্রমাণিত হতো। যে মাছ ধরে রাখতে পারিনি তার আয়তনটা বেশ বড়ই থাকতো অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। এ নিয়ে দমফাটা হাসিও হাসতেন বাড়ির বড়রা। আমার চোখ বেয়ে নামতো অঝোর শ্রাবণ। নাকে মুখে সেই শ্রাবণ জল মেখেআবারও একই চেষ্টাই করে যেতাম এই আমি, মাকড়শার মত অনেকটা। ধৈর্য নিয়ে, সময় নিয়ে এক সময় বড়সড় মাছ ঠিকই হাতের নাগালে চলে আসতো। তখন কচিমুখে খেলে যেতো নিযুত শাপলার হাসি। সেই সশব্দ হাসি আমার কানে আজও বাজে।

'ও গানওয়ালা আরেকটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই কিচ্ছু করার নেই।
ছেলেবেলার সেই বেহালা বাজানো লোকটা
চলে গেছে বেহালা নিয়ে চলে গেছে গান শুনিয়ে'।

কেন জানিনা সুমনের উক্ত গানটি শুনলে আমার চোখে জল আসে। আমি ফিরে যাই গানের প্রতিটি শব্দে, বাক্যে। আমি হয়ে যাই সেই অন্যরকম কেউ। আমার কেবলি মনে হতে থাকে সেই বেহালা বাদকের কথা। সে চলে গিয়েছে এটাই আমার মন খারাপ করা বিষয় কিন্তু সে যে গান শুনিয়ে গিয়েছে, ভরিয়ে দিয়েছে প্রাণ সেটা আর ভাবনায় থাকেনা। গান শোনার প্রতি একধরনের আকষর্ণ আছে আমার। সবধরনের গানই শুনতাম। যেটাই শুনতাম মন দিয়ে শুনতাম। আমি মানুষটা অনেক বেশী আবেগপ্রবণ, কল্পনাপ্রবণ। যা কিছু শোনা হতো আমার, সবকিছুই চোখের সামনে নিয়ে আসতে পারতাম। এখনও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে।

আজ আষাঢ়ের এগারো তারিখ। তপ্ত রোদেলা দুপুর এখনও তাদের হাত-পা গুটিয়ে নেয়নি। বিরামহীন ঘাম ঝরছে শরীরে এবং মনে। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বড্ড বেশী মনে পড়ছে আমার। স্মৃতির মনিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে অজস্র স্মৃতির ফুল। এই ফুলে মালা গাঁথার মাঝে একধরনের তীব্র ভালোলাগা কাজ করে। অনেকটা শীতের ভোরের শিউলির মত কিম্বা কচুরীপুকুরের ধারে বর্ণিল হিজলের মত। আমার শৈশব আমার আকন্ঠ পিপাসা দূর করে। মনের খালবিল জুড়ে থাকে শুভ্র বকের সারি। যার উড়ে যাওয়া ডানার ঝাপটায় শীতল হয় চৈত্রের দুপুরের মত তপ্ত হৃদয়। চোখের কোণে চিকমিক করতে থাকে লাল-সাদা শাপলার হাসি। রুপকথার সেই গল্পের পশরা আর সাজাইনা। প্রকান্ড সেই শিমুল গাছটা আর নেই। তবুও মনের প্রশস্ত উঠোনজুড়ে কী দুর্দান্ত আনাগোনা তাদের! আহা!! কতকাল দেখিনা তাদের........।

বাঁচার সাধ আমার। অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। আর এটা অবশ্যই সুস্থভাবে। আমি প্রায়ই বলি- কোথাকার কোন কচ্ছপ তার আয়ু কেনো তিনশ বছর হবে! তার চাইতে মানুষের আয়ু দরকার। ধূলির ধরায় কত কি আছে দেখার, জানার। কিছুইতো দেখা হলোনা, করাও হলোনা। এমন আফসোস আমার হরহামেশাই থাকে। তারপরও যখন পেছনে ফিরি তখন সেই দিনগুলোর কথা মনে করে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে ভেতরটায়। বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট, ভবিষ্যৎ ভাবনা কম ভাবি। আর অতীত! সেটাতো আমাকে জড়িয়ে রেখেছে তার সোনালি চাদরে। বড় বেশী আবেগের ছোঁয়া আছে এতে। এই ছোঁয়া আমাকে অহর্নিশ তাড়িয়ে বেড়ায়। স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ে আমার শৈশব আর আমি জেগে থাকি সেই শব্দের পশরায়।
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×