উঠোনটা দেখতে একটা পরিকল্পিত ফুলের বাগান মনে হয়। বাগানের শুরুটা হয়েছে বকুল দিয়ে। এরপর যথাক্রমে কামিনী, শেফালী, বেলি সহ নানান ধরনের গোলাপের বাহার। নেই শুধু হাস্নাহেনা। সেই উঠোনের একপাশে একটা চেয়ারে বসে মাঝ বয়স পেরুনো একজন ভদ্রলোক আপনমনে কিসব লিখে যাচ্ছেন। গল্প, কাব্যে তার জুড়ি মেলা ভার। বাড়ির ছোটরা তাকে ঘিরে থাকতো। তার কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, এতফুলের মাঝে হাস্নাহেনা নেই ক্যানো? উত্তরে বলেছিলেন- 'ওর গন্ধ উগ্র। এসব উগ্রগন্ধে রাতবিরেতে সাপখোপ আসতে পারে।' আমি বললাম, তাহলে কামিনী বা বকুল! এদের গন্ধও কি উগ্র নয়? তিনি হেসে সোজাসাপ্টা বলে দিলেন- 'না, ওসবের গন্ধ উগ্র নয়, মিষ্টি গন্ধ। বাতাসার মত মিষ্টি। আর এই মিষ্টি ওরা এড়িয়ে চলে'।
ভদ্রলোকের নাম ইউসুফ আহমেদ। জন্মের সময় অসম্ভব রুপবান ছিলেন বলে নবীর নামে নাম রাখা হয় ইউসুফ। ঢাকায় চাকুরী করেন। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসেন। দু'দিন কাটিয়ে আবার চলে যান কর্মস্থলে। আসার সময় কত কি নিয়ে আসেন তিনি! আমাদের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। তিনি তার স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ভালোই দিনযাপন করতেন। সকালের ঘুমটা ভাঙতো - 'আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ। তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি মোর স্থান' সুরের ধারায়। তিনি তার হারমোনিয়াম আমাকে কখনো ধরতে দিতেন না। তার দুই মেয়ে কী দারুণভাবে রপ্ত করে ফেললো কতশত সুর! ছেলেটা সেসময় কাছে থাকতোনা। ওকে পাঠানো হত মুদি দোকানে, দরকারী জিনিসপত্র আনতে। আমি ওটা ছুঁতেই পারতামনা। আমাকে বলা হতো- 'তোর গলায় গান হবেনা কবিতা হবে' । একদিন তার সামনে থাকা সাদা খাতাটা আমার সামনে রেখে বললেন- 'এটা ভরে ফেল। তোর যেমন ইচ্ছে তেমন করেই লিখতে থাক। যা কিছু আসবে, সবই আনবি। কিছুই আটকাবিনা'। আমার খুশি দেখে কে! মনের সমস্ত উচ্ছ্বাস দিয়ে গেঁথে যেতাম একের পর এক বাক্য। তখন আমার বয়স কতইবা হবে সাত কি আট! তার মেয়েদের চাইতে ছেলেটার সাথে আমার ছিলো দারুণ বন্ধুত্ব।
ছেলেটার নাম আদিল। আমাদের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে বয়সে। খুব ফর্সা ছিপছিপে শরীর। এই ছেলেটার একটা কাহিনী আছে। খুব ছোট অবস্থায় আদিলের মা-বাবার মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরী হয়। দু'জনের বসবাস হয় দু' মেরুতে। কাগজে কলমে তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে যায়। মা নতুন করে অন্যত্র সংসার পাতেন। আর বাবা চলে যান দেশের বাইরে। দেড় বছরের ছোট্ট আদিলকে তখন আদিলের খালা(এখন যাকে মা বলে ডাকে) নিজের কাছে নিয়ে আসেন। নিজের যেহেতু কোনো ছেলে নেই তাই তাকে দিয়ে সেই স্বপ্নটাও পুরণ করবেন। আদিল জানতো, এরাই তাদের বাবা-মা। সেই শিশু বয়স থেকেই আদিল ছিলো কাজপাগল ছেলে। ঘরে বাইরেও তাকে বিশেষভাবে পরিশ্রম করতে হতো। স্কুলের চাপ, ঘরের চাপ সব মিলিয়ে কেমন হিমশিম খেতো সে। তার বাবা তাকে বলতো- 'কাজ করলে শরীর ভালো থাকে। মন ভালো থাকে। আর আদিল ভাবতো-'শরীর আর মনটা কি শুধু একা আমারই ভালো রাখতে হবে! বোনদের ভালো রাখতে হবেনা'! বোনেরা সংগিত চর্চায় মগ্ন থাকতো আর আদিল তখন পাশের ডোবা থেকে বালতি ভরে কচুরীপানা এনে উঠোনের কোণে জমিয়ে রাখতো তার বাবার নির্দেশে। কারণ, এগুলো নাকি ফুলগাছের জন্য খুব ভালো সার।
আমাদের পুরো পরিবার এই ছেলেটাকে ভীষণরকম আদর করতো। আমাদের মা যখন কিছু তৈরী করতো তখন ওর জন্য অন্য পাত্রে তুলে রাখা হতো। আমরা একই সাথে গাঁয়ের ধুলোবাতাস মেখে বড় হচ্ছিলাম। সবগুলো ঋতুতেই আমরা দারুণ ভালোলাগায় কাটিয়েছি। বিশেষ করে বর্ষার কথা না বললেই নয়। একসাথে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, ডিঙি বেয়ে বিলের শাপলা তোলা, পানির নিচ থেকে ডুব দিয়ে শালুক তোলা সহ কত কি! বোশেখ মাসে পাড়ার সবাই মিলে একযোগে হৈহৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়তাম খোলা আকাশের নীচে। আকাশ তখন কালোমেঘের ভেলা সাজিয়েছে। বাতাসে উড়ছে শুকনো পাতা। টিনের চালে কাচা-পাকা আম পড়ার শব্দ। আর আমাদের উচ্ছ্বাস যেনো বাড়তেই থাকতো! আমরা একসাথে ঘুড়ি বানিয়েছি, উড়িয়েছি। শীতের ভোরে শিউলি কুড়ানো, চুলার ধারে বসে ভাপা পিঠা খাওয়া, ভরদুপুরে মটরশুটি পুড়িয়ে খাওয়া সবই হত দারুণ আনন্দে। আদিল ছিলো আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। আদিলের বোনদের জন্য একজন গৃহশিক্ষক ছিলো। পড়াতো দু'বোনকে আর কারণে অকারণে আদিলের পিঠে বেত্রাঘাত পড়তো খুব বেশী। স্কুল থেকে ফিরতে কেন দেরী হলো সেই কৈফিয়ত দেয়ার আগেই কান দুটো লাল করে ফেলা হতো তার! আর এ কাজটা করতেন ইউসুফ সাহেব। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম- যে মানুষটা ফুল ভালোবাসে, শিশু ভালোবাসে, গান বাজনা ভালোবাসে তার হাতে কিভাবে বেত ওঠে! কিভাবে আঘাতের চিহ্ন একে যেতে পারে সে!!
এভাবে সময়ের সাথে সাথে আমরা সবাই একযোগে মানুষ হচ্ছিলাম। আদিল ক্লাস নাইনে উঠলো। আমি ক্লাস সেভেন এ। আমাদের মাঝে বিশেষ কোনো ছুটির দিন ছিলোনা। সবদিনই ছিলো ছুটির দিন। একটুকরো অবসর আমরাই তৈরী করতাম। পাড়ার সবাই মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। সেখানে প্রধান অতিথী হিসেবে বক্তব্য রাখতেন ইউসুফ সাহেব। আমাদের এমন কাজে তিনি উৎসাহ দিতেন। তিনি এবং তার স্ত্রী সময় সময় কেনইবা আদিলের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতেন সেটা ছিলো এক রহস্য। আদিলের বাবা নাকি প্রায়ই দেশের বাইরে থেকে খোঁজখবর নেন ছেলের। যেকোনো সময় এসে আদিলকে নিয়ে যাবেন এমন কথাও আছে। আদিল তখন পর্যন্ত এসবের কিছুই জানতোনা। অসম্ভব হাসিখুশি ছেলেটা একদিন স্কুল থেকে ফিরলো কালবৈশাখির তান্ডব নিয়ে। দুপুরেও কিছু খেলোনা। এক বিকেলে হুটহাট নিরুদ্দেশ। বাড়ির সবার মত আমিও অস্থির। খুঁজছি সম্ভাব্য চারপাশ। কিন্তু কোথাও তার সাড়া নেই! সেদিন ছিলো শুক্রবার, ইউসুফ সাহেব তড়িঘড়ি করে ঢাকা ছুটলেন। তার স্ত্রীও সাথে যেতে চাইলেন। অবশেষে ভর সন্ধ্যায় যখন তিনি বাড়ি থেকে বের হবেন ঠিক সেই মুহূর্তে থরথর দেহে একজোড়া ভীত চঞ্চল চোখ চোখাচোখি হলো ইউসুফ সাহেবের। এর পরের গল্প বেশ করুণ। কয়েক ঘন্টার খোঁজাখুঁজির তীব্র আক্রোশ ছবি হয়ে ফুটে রইলো আদিলের পিঠে!!
সেদিন কি এমন ঘটেছিলো স্কুলে! আদিলের কাছে অনেকবার জানতে চেয়েও জানতে পারিনি। এরপর থেকে প্রায়ই সে অন্যমনস্ক থাকতো। স্কুলে যাওয়া একরকম ছেড়েই দিলো সে! তার ছিপছিপে রোগা শরীরটা আরো বেশী রোগা হতে থাকলো। ইউসুফ সাহেব এখন আর তাকে কারণে অকারণে বেত্রাঘাত করেন না। আচরণ করেন বিপরীতগোছের। খুব বেশী আদিখ্যেতা শুরু হয়ে গেল তাকে ঘিরে। তাকে নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তোলার চেষ্টা করেন। ঝরা ফুল তুলে ছেলের হাতে সুবাস মেখে দেন। কিন্তু আদিল হয়ে গেলো অনেকটা রোবট টাইপ। কথাবার্তা একেবাড়েই কম বলতো। তার শরীরে অন্যরকম এক আদিল যেনো বসবাস শুরু করেছে! সবচেয়ে কষ্ট পেতাম আমিই। এরুপর সবকিছুর সাথে একরকম ছাড়াছাড়া সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। মাঝে হুটহাট ঢাকা থেকে তার মা এলেন। সাথে আদিলের ছোট্ট এক ভাই। আদিল তাকে শুরু থেকেই নিজের মাকে খালা বলে জেনে এসেছে। সম্পর্কগুলো এমন যে, নিজের চোখে সবকিছু কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগতো।
একদিন ঘন আষাঢ়। বর্ষাকালে এম্নিতেই আমাদের গ্রামের একেকটা বাড়িকে মনে হত একেকটা দ্বীপ। চারপাশে পানি আর পানি। বর্ষার সময় আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে একটা করে নৌকা থাকতো। এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়ার জন্য কেউ কারো উপর নির্ভর করে থাকতোনা। যেকোন মানুষ এলে ঘর থেকেই মনে হয় সেই বৈঠার শব্দ শোনা যেত। ইতিমধ্যে আদিল জেনে গেছে যে, সে যেখানে আছে তাদের সাথে তার সম্পর্ক কি। মনের উপর সেই চাপটা কি ধরনের হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সন্ধ্যাবেলায দারুণ বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমরা যেহেতু পাশাপাশি থাকি তাই সন্ধ্যাকালীন গল্পের আসরে আমিই ছিলাম মূল বক্ত।। আদিল সহ আরো অনেকেই ছিলাম একসাথে। বরাবরের মতই ও ছিলো অন্যমনস্ক। তারপরও ওকে আনন্দে রাখাটাই ছিলো আমাদের সবার মুখ্য বিষয়। এমন সময় উঠোনের ধারে অপরিচিত কন্ঠ শুনলাম। জড়ো হলাম সবাই উঠোনে। এসে দেখি একজন ভদ্রলোক। ফর্সা ছিমছাম শরীর, মাথার চুলগুলো আধপাকা। দারুণ টিকালো নাক। মুখের মাঝে একধরনের গভীর মায়ার ছায়া পড়ে আছে যেনো। তিনি হচ্ছেন আদিলের জন্মদাতা ! নৌকা থেকে নামতে নামতেই তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন- 'আদিল, আমার আদিল কোথায়?!' ইউসুফ সাহেব বেশ ভালোভাবেই জানতেন তার আসার খবর। সে অতি ব্যস্ত হয়ে তাকে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। আমরা সবাই যখন নতুন এই মানুষটাকে দেখছি তখন আমাদের পাশে আদিলকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সে ছিলো ঘরের এককোণে। ইউসুফ সাহেব আদিলকে ডেকে আনলেন এবং কাচুমাচু হয়ে বলে গেলেন এক এক করে সবকথা। আদিল যে তার ছেলে না এটাই প্রকাশ করলেন। কিন্তু এই প্রকাশটা আদিলের কাছে মনে হয় অনেক আগেই হয়েছিলো। যেদিন সে স্কুল থেকে এক আকাশ ঝড় নিয়ে ফিরেছিলো সেদিনই হয়তোবা জেনে গিয়েছিলো তার শেকড়েরর গল্প!!
এরপরের দৃশ্য, বাস্তব করুণ দৃশ্য। বাবা-ছেলের গভীর আলিঙ্গনের দৃশ্য। দু'জনেই ছিলো শব্দহীন। মাত্র একদিন থাকলেন আমাদের গ্রামে। এরপর আদিল চলে গেলো বাবার সাথে। ওর সাথে আজ প্রায় বিশ বছর ধরে কোনো দেখাদেখি নেই। শুনেছি, বাইরেই পড়াশুনার পাঠ চুকিয়েছে। ভালো চাকুরী করছে। নতুন জীবন গড়েছে। সেই ঘরে ফুটফুটে ছেলেপুলেও হয়েছে। শুনে মনটা ভরে যায়। জানিনা ওর সাথে আর দেখা হবে কিনা। এখনও মনে পড়ে, ওর বিদায়ের দৃশ্য। চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিলো- " তুই যে কথাটা জানতে চাইতি সেটার উত্তর হচ্ছে - 'আমি অনেক আগেই জানতাম আমি এদের ছেলে না। কাজ করলে অনেক কষ্ট দুঃখ ভুলে থাকা যায়। আমি এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখতাম। আমি জানতাম, আমার বাবা একদিন সত্যিই আসবে। কারো উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই রে। ভালো থাকিস " । সেই মুহূর্তে মনে হলো আদিল যেনো অনেক বড় হয়ে গেছে, অনেকটা আকাশের মত। যাকে দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায়না। মনটা কী এক অজানা ব্যাথায় নীল হয়ে গেলো।
এখন বোশেখ মাসের শেষ। সামনেই আষাঢ়। বৃষ্টির পশরা এখন দারুণ। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ কালো হয়। সাজুগুজু করে বেড়ায় মেঘের দল। এমন ঘনকালো দিনে হুট করেই আদিলকে মনে পড়লো আমার। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মৃতির ফ্রেমে কী ভীষণ যত্নে আছে। আহা ! এমন করেই থাকুক স্মৃতির ঝাঁপি। চোখের কোণে আষাঢ়ের ঢল নামতে শুরু করেছে। এ ঢল আনন্দের। আমার সেই বন্ধুটির শেষ মুহূর্তের অভিনব গল্প। যেখানেই থাকুক সে, আষাঢ়ের কালো মেঘ তাকে যেনো স্পর্শ না করে।