নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে মানবজাতির ইতিহাস সংগঠিত হয়েছে। এ দু’টি শ্রেণীর কোনো একটিকে বাদ দিয়ে সুন্দর এ পৃথিবীর কল্পনা করা যায় না। নারী ও পুরুষ যেমন দু’টি আলাদা সত্তা তেমনি তাদের কর্মপদ্ধতিও ভিন্ন। কিছু কিছু বিষয় আছে যা তাদের কারো না কারো সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। নারীর ব্যয়ভার বহন করা পুরুষের জন্য আবশ্যক করা হয়েছে। (সহি মুসলিম, হাদিস নম্বর ২১৩৭)। এ জন্য তাকে সৃষ্টিগতভাবেই শক্তিশালী ও পরিশ্রমী করা হয়েছে। পুরুষ যেহেতু পরিবারের সব ব্যয়ভার বহন করবে, তাই তাকে নেতৃত্বের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। (কুরআন ৪ : ৩২, ৩৪)। নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পারে না বিধায় তাদের কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্ব-কর্তব্য ঘরকেন্দ্রিক। সে তার সন্তানসন্ততি ও পরিবারের যাবতীয় বিষয়ের কল্যাণকামী হবে। তার মানে এই নয় যে, তার দুনিয়া ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; বরং নারী তার ও তার পরিবারের প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ায় দোষের কিছু নেই। এমনকি সে ইচ্ছে করলে আর্থিক উপার্জনও করতে পারবে। (আল কুরআন, সূরা নিসা ৪:৩২)। তবে এ জন্য নারী তার সম্ভ্রম রক্ষায় নিরাপদ হতে হবে। কারণ ইসলাম নারীর নিরাপত্তা বিধানে বদ্ধপরিকর। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা লাভে অগ্রসর হতে পারবে, তেমনি কৃষি ও ব্যবসায়ের কাজে অংশ নেয়ারও তারা পূর্ণ অধিকারী। জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ-কারবার, শিল্পকারখানা স্থাপন, পরিচালনা বা তাতে কাজ করারও অধিকার রয়েছে নারীদের। সেই সাথে সমাজ ও জাতির বহুবিধ সামষ্টিক কাজ আনজাম দেয়াও তাদের জন্য বিন্দুমাত্র নিষিদ্ধ নয়। তবে এর দ্বারা এ কথা বোঝায় না যে, নারীদের এসব কাজে অবশ্যই নেমে যেতে হবে। যদি তা-ই করা হয় তাহলে সমাজজীবনে নানা বিপর্যয় ও ভাঙন সৃষ্টি হবে। বস্তুত অনুমতি এক কথা আর বাস্তবে তা চর্চা করা একান্তই জরুরি হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এ অনুমতির চর্চা কেবল প্রয়োজনের খাতিরেই প্রযোজ্য। ইসলাম যদিও নারীর সব হৃতাধিকার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং যদিও তার আইনগত ও অর্থনৈতিক যোগ্যতা পুরুষের সমান নির্ধারণ করেছে; কিন্তু ইসলাম মনে করে, নারীর নিজের, তার পরিবারের ও গোটা সমাজের জন্য এটাই অধিকতর কল্যাণকর যে, সে পুরোপুরিভাবে কেবল পরিবারের কল্যাণসাধনে আত্মনিয়োগ করবে। এ জন্যই ইসলাম তাকে সব অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং তার ভরণপোষণের ভার তার স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। অথচ সে ক্রয়-বিক্রয় এবং অর্থোপার্জনের যাবতীয় কাজের যোগ্য। ইসলাম নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব বিয়ের পরে স্বামীর ও বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতার ওপর ন্যস্ত করেছে। উদ্দেশ্য, সে তার মায়ের তদারকিতে যাবতীয় ঘরকন্নার কাজে প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারে।
এরূপ প্রাজ্ঞ ও কল্যাণময় পন্থায় ইসলাম নারীর মর্যাদা রক্ষা ও সমুন্নত করে এবং তার একটি অধিকারও ুণœ করে না। এভাবে পরিবারের সুখ-শান্তিও সে সংরক্ষণ করে। স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে ভিন্ন কোনো কাজে যেমনÑ ব্যবসায়-বাণিজ্যে, রাজনীতি ইত্যাদিতে নিয়োজিত হতে সে বাধ্য করে না।
নারীদের অর্থোপার্জনের অনুমতি : বিশেষ প্রয়োজনে নারী ঘরের বাইরে গিয়েও অর্থোপার্জন করতে পারবে। এর কিছু প্রমাণ তুলে ধরা হলোÑ
* একজন তালাকপ্রাপ্ত মহিলা সাহাবি রাসূল সা:-এর কাছে খেজুরগাছের ডাল কেটে বিক্রি করার অনুমতি চাইলে তিনি (হুজুর সা তাকে অনুমতি প্রদান করেন। (আবু দাউদ)।
* পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার পর হজরত উমর রা: নবীপতœী সাওদা রা:কে ঘরের বাইরে দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হজরত সাওদা রা: বিষয়টি রাসূল সা:কে জানালেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর ওপর ওহি নাজিল হলে তিনি মহিলাদের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। (সহি বুখারি, মুসনাদে আহমদ)।
হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রা: ঘোড়াকে খাবার দিতেন, পানি পান করাতেন। এ ছাড়া ঘরের যাবতীয় কাজও তাকেই করতে হতো। তিনি নিজে বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত জমি থেকে খেজুরবীজ তুলে আনতেন। যাতায়াতের পথে প্রায়ই রাসূল সা:-এর মুখোমুখি হতেন। কিলাহ নামক এক মহিলা রাসূল সা:-এর কাছে উপস্থিত হয়ে নিজেকে একজন ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন এবং তার কাছ থেকে এসংক্রান্ত কিছু মাসয়ালাও জেনে নেন। হজরত উমর রা:-এর খিলাফতকালে মুহাররামা রা: নামে এক মহিলা সাহাবি আতরের ব্যবসায় করতেন। (তবাকাতু ইবনে সাদ)।
শর্তাবলি : নবী সা: ও তাঁর পরবর্তী যুগে ঘটে যাওয়া এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে প্রয়োজনের তাগিদে নারীরা বাইরে বের হতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মেনে চলা আবশ্যকÑ
১. শরিয়তের বিধানের খেলাফ না হওয়া।
২. পর্দার বিধান পালন করা।
৩. নারী-পুরুষে অবাধ মেলামেশা পরিহার করা।
৪. একই কক্ষে এক বা একাধিক পুরুষের সাথে কাজ না করা।
৫. মা ও স্ত্রী হিসেবে তার পারিবারিক দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত না হওয়া।
৬. ভিন্ন পুরুষের সাথে নিভৃত সাক্ষাৎ না করা।
৭. একান্ত প্রয়োজন অনুভব করা।
উপরি উক্ত যেকোনো একটি শর্তের অনুপস্থিতিতে নারীর বহিরাগমন তার নিজের নিরাপত্তাহীনতা ও সমাজে নানান বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। নারীদের নিরাপত্তার নিমিত্তে ইসলামের দৃষ্টিতে পর্দার আরেকটি অংশ হলো, তাদের নি®প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া। স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে জীবনযাপনে তাদের মৌলিক কাজ গৃহাভ্যন্তরে নিহিত। (আল কুরআন, সূরা আহজাব ৩৩:৩৩)।
নারীর ইজ্জত-সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য পর্দার বিধান অন্যতম। ধর্ষণ, অপহরণ, খুন, এসিড নিক্ষেপ, অঙ্গহানি, ব্যভিচারের অপবাদ, পরকীয়া ইত্যাদির প্রধান কারণ হলো পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা। এভাবে প্রতিটি শর্তের বিপরীতে রয়েছে নারী জাতির জন্য নানান বিপর্যয় ও অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা।
ভাঙন ও বিপর্যয় : আগেই বলেছি, নারীর কাজ করার অনুকূল পরিবেশ হলো ঘরকেন্দ্রিক। তারা যদি তাদের আপন নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়ে অর্থোপার্জনে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্যতা হুমকির মুখে পতিত হবে এবং পারিবারিক চিরসুখের বন্ধন ছিন্ন হয়ে মানবজাতির বংশীয় ধারা ব্যাহত হবে। আমরা সবাই জানি, মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষক মা। মা যদি সন্তানকে যথাযথ আদর-সোহাগ না করে সন্তান শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সন্তান ভবিষ্যতে আর যা-ই হোক মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগবে না। তা ছাড়া পৃথিবীতে যারা শ্রেষ্ঠ মনীষী হিসেবে পরিচিত, তাদের মা-বাবা তাদের থেকে আলাদা ছিল এমনটি পাওয়া দুরূহ। পশ্চিমা দেশগুলোতে মা-বাবা দু’জনই চাকরিজীবী, এমন পরিবারের সন্তানেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসী ও বিপথগামী হয়ে থাকে। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নারীদের নিয়োগ স্বভাবতই পুরুষদের বেকারত্ব বাড়ায়। আমরা চাুস দেখতে পাচ্ছি, এক দিকে বিভিন্ন চাকরিতে নারীদের ভিড় লেগে আছে, অপর দিকে উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে রাস্তায় নামে। বেড়ে চলে কর্মজীবীর পরিবর্তে অপরাধীর হার। আর এটাই হলো নারীর যথার্থ মূল্যায়ন ও সমতার নাম। তাহলে ফলাফল এই দাঁড়াল, নারীদের অধিকারের নামে ঘর থেকে বের করে মাঠে নামানো হলো আর পুরুষদেরকে মাঠ থেকে ঘরে ঢুকানো হলো। তাহলে উন্নয়ন কোথায়? বরং তা হলো নিজেদের স্বার্থ হাসিল।