২০০৬ ইং সনের ১৯ আগষ্ট আমার দ্বৈত জীবনে পদার্পন। পৈত্রিক নিবাসে মা থাকেন একা। আমি একটু দুই মাইল দুরের বাজারে অল্প একটু জায়গায় পেশাগত কারনে থাকতে হয়। বিয়ের কিছুদিন পরেই হঠাৎ একদিন দেখি বাসার ছোট্ট আঙিনায় একটা বিড়ালের বাচ্চা দঁড়িয়ে। মায়াভরা চোখদুটি দেখে কেমন যে ক্ষুধার্ত মনে হলো। আমি তাকে কাছে ডাকলাম। আমার সহধর্মিনী রাগত স্বরে বললে - "এসব কি করছ ? আমি বিড়াল দেখতে পারিনা।" আমি ঠান্ডা মুখে বললাম - দেখছনা প্রানীটা ক্ষুধার্ত- কিছু খাবার দাও খেয়ে চলে যাক। সে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। অগত্যা আমিই তাকে দুটো ভাত দিলাম - সে খেল।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি আবারো সে উপস্থিত। গিন্নী বললো - বিড়াল ছানাটি কোথাও যায়নি- সারাদিন আজ সে খাটের নিচে রাখা ব্যাগটার উপর শুয়ে ছিল। আমি আবারো তকে খাবার দিলাম। সে শুধু খায় আর ঘুমায় । তার প্রতি আমার দয়া, ভালবাসা দুটোই জন্ম নিল। আমি খাবার খাওয়ার সময় তাকে কিছু খাবার না দিয়ে খাওয়া শুরু করতে পারিনা।
শীতকাল এলো সে আমার কাছাকছি আসতে লাগল। আমি নীরবে তাকে আশ্রয় দেই। শরীরের উকুন দুর করার জন্য উকুন নাশক সাবান দিয়ে গোসল করাই। সে ঘর ছেড়ে কোথাও যায়না। ধীরে ধীরে সে আমার কথাগুলো ও বুঝতে লাগল।
আমি কোথাও যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলে সে আমার মুখের দিকে বিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি তাকে খাটের কোনায় বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলি- "বাইরে যাবিনা-বাইরে গেলে অন্য বিড়ালরা তোকে মারবে।" ঢাকা থেকে সণ্ধায় বাড়ি ফেরার পথে সে দেখি রাস্তায়। এক দৌড়ে আমার পায়ের কাছে মাথা ঘষতে লাগল। আমি তাকে নিয়ে বাড়ি আসি। গিন্নী আশ্চর্য হয়ে বলেন- এইমাত্র দেখলাম সে ঘর থেকে দৌড় দিল। সারাদিন ভাল করে খাবারও খেল না- ঘর থেকে বাইরে ও গেল না। তুমি আসছ বলেই দে বোধহয় দৌড় বাইরে গেল। তোমার কখা কি সে বুঝে? আমি বলি - তুমি না বুঝলেও একটা জানোয়ার আমার কথা বুঝে এবং মানে। রাতে সে আমার পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমায়। ঢাকায় গেলাম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে। রাতে গিন্নীকে ফোন করে জিজ্ঞাস করি- আমার সগির মিয়া কোথায় ? গিন্নী রাগ করে বলে- আমার চেয়ে সে-ই তোমার আপন, আমাদের কথা জিজ্ঞাস করতে পারনা?। দোকান থেকে তার জন্য বিস্কিট কিনে বৈয়ামে রাখি। আমার মা বাসায় এসে এই সব কান্ড দেখে বলে - তুই তো আমার চেয়েও তার খেয়াল বেশি রাখিস দেখছি। আমি কিছূ বলতে পারিনা।
একদিন প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হলাম আমি। গিন্নী মাথায় পানি ঢালছে। সে আমার সগির মিয়া মাথার কাছে তার পা গুটিয়ে বসে পানি ঢালা দেখছে। গিন্নী পানি ঢালতে ঢালতে বলে - দেখ তোমার বিড়ালের কান্ড- সে কেমন করে বসে দেখছে তোমাকে। আমি আড় চোখে তাকে দেখি- আর চোখের পানি মুছি। আর মনে মনে বলি পাঁচ বছরে যখন সন্তানের মুখ দেখতে পারলামনা- তখন সেই আমার ....। বাসার পাশেই মসজিদ। আমি নামাজে যাই- সে আমার পাশে গিয়ে বসে থাকে। আসার সময় লোকেরা আমাকে বলে -আবু হোরায়রা। আমি নিশ্চুপ থাকি। সে বড় হয়েছে। বয়স তার দেড়/ দুই বছর।
একদিন সন্ধায় মাগরিবের নামাজ শেষে বাসায় আসি। গিণ্ণী বালিশে হেলান দিয়ে তসবিহ জপছে। সগির মিয়া খাটের উপড় শুয়ে। আমি তার পিঠে হাত বুলাচ্ছি। বিদ্যুত নেই। কুপির আলোতে- বসে আছি। হঠাত দেখি আমার আদর ফেলে সমস্ত অলসতা ছেড়ে সে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। অত:পর লাফ দিয়ে নিচে নামে এবং দরজার পাশে অনুসন্ধিঃসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গিন্নী বলে - কি ব্যাপার বিড়াল এমন করল কেন ? আমিও আশ্চর্য হই-কারন সে আমার আদর ফেলে এভাবে যাবার কথা না। আমি হাতে টর্চ নিয়ে সগির মিয়ার অনুসণ্ধিৎসু পথে দেখি- খয়েরি রংয়ের এক সাপ। আমি হাতে লাঠি নিতে ঘাড় ফেরায়ে- দেখি সাপটি উধাও। সগির মিয়া অস্থির ভাবে নাকে শুকে শুকে এদিক উদিক করে। লোকজন ডাকাডাকি করি-গিন্নীর পর্দা করার কারনে লোকও আসতে পারেনা। তবুও লোকজন আসল কাছাকছি সারারাত খূঁজলাম সাপটিকে পাওয়া গেলনা। দেয়াল ঘেরা সীমানার কোথাও সাপটিকে পাওয়া গেল না। নিদ্রাহীন দুঃস্বপ্নে কাটল সারারাত, কয়েকরাত ।
পনের/বিশ দিন পরের ঘটনা। আমার সগির মিয়া কিছুই খায়না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। দু'চার দিন এভাবে কাটে। আমি অস্থির হয়ে উঠি ডাক্তারের কাছে যাই, হোমিও ঔষধ খাওয়াই। নামাজ পড়ে দোয়া করি। আল্লাহর কাছে বলি "হে আল্লাহ্ তুমি আমাকে সন্তান না দিয়ে যদি খুশী হও-ভাল- তবু আমার এই সগির মিয়াকে ভাল করে দাও। কিন্তু সগির মিয়ার কোন পরিবর্তন নাই। অবশেষে এক শুক্রবারে বিকাল বেলায়- আমি দোকানে বসে কাজ করছিলাম। গিন্নী অস্থির ভাবে ডাক দেয়- শোন বিড়ালনটা মনে হয় মারা গেল। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি তার নিথর দেহ-কিন্তু সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি- কিরে তুই মরেও আমার দিকে এমন করে কি দেখছিস? আমাকে দেখার সাধ কি তোর মিটলনা। আমি তার মৃতদেহে হাত বুলাই। গিন্নী বলে- একি করছ তুমি-তুমি এভাবে কাঁদলে লোকে কি বলবে।
আমার বাসায় কোন কোদাল নেই- পাশের বাড়ির আব্দুর রহমানের কাছে গিয়ে বলি রহমান ভাই- আমাকে একটা কোদাল দিবেন ? রহমান ভাই জিজ্ঞেস করেন- বাজারের দিন আপনি কোদাল দিয়ে কি করবেন। আমি বল্লাম আমার বাচ্চাটা মারা গেছে। আমি তাকে আমার চোখের জলে মাটিচাপা দিলাম।
অবশেষে ...
কয়েকদিন পর আমার শুন্য বুকের কষ্ট দুর করার জন্য বাজারে আক্কাস ভাইর চায়ের দোকান থেকে অন্য আর একটা "বিড়াল" ধরে আনলাম- সে হলো মাদী বিড়াল। সে বড় হলো । তার প্রথম সন্তানের একজন পুরুষ। সে আগেরটার মত নয়- তবে আমার অনেক কথাই শুনে। আমার কম্পিউটারে কাজের সময় ধৈর্য় ধরে বসে থাকে - আবার কখনও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। দৃষ্য দেখুন :
বি:দ্র: আমার পাঁচ বছর বিবাহিত জীবনে কোন সন্তান নেই- সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী আল্লাহ্ পাক যেন আমাকে একজন আসল "সগির মিয়া" দান করেন।
এ ধরনের আরো কিছু পোষ্ট - পোষা প্রাণী বিষয়ক সত্য কাহিনী:
অন্য রকম দখলদারিত্ব: দেখুন আমি কেমন আছি....
জীবনের টুকরো গল্প : ৩ একটি কুকুরের মরন পণ অভিমান
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:২৭