somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন বীরাঙ্গনা এবং একটি মুক্তিযুদ্ধ

০২ রা জুন, ২০১২ রাত ২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এক বছর পুরোনো লেখা। সামু থেকে বিশাল সময়ের জন্য হাইবারনেশনে চলে গিয়েছিলাম। আশা করি এই পোস্টের মাধ্যমে আবার সামুতে নিয়মিত হতে পারবো।)

প্রস্তাবনা
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব কিংবা উৎসাহের কোন শেষ নেই।
এটি পুরোপুরিই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার জন্য এত চমৎকার সংগ্রাম, ত্যাগ কিংবা প্রচেষ্টার কোন তুলনা হয় না। এতগুলো প্রাণ উৎসর্গ কিংবা এত আত্মত্যাগ- খুব কম দেশকেই করতে হয়েছে। কথাটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। অনেক দেশই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং কোন কোন দেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখনো পরিণতি লাভের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ দেশটির মানুষের মতো আত্মত্যাগ কিংবা বীরত্বগাঁথা আক্ষরিক অর্থেই অতুলনীয়। আমরা এমন এক ইতিহাসের অংশীদার, যা নিয়ে গর্ব করাটা কখনোই দোষের কিছু না। আবার মুক্তিযুদ্ধের এ ইতিহাস নিয়ে গর্ব করার পর অন্য সব কাজে মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাও গ্রহণযোগ্য না। অথচ এ দৃশ্য এখন মোটামুটি স্বাভাবিক।
যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা উঠলেই আমরা মোটামুটি কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে অভ্যস্ত। হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, স্বাধীনতার ঘোষণা (এবং ঘোষক- যাঁর নাম পাঁচ বছর পরিক্রমায় পরিবর্তনশীল), মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, রাজাকার- বদর- শামস বাহিনী, অসহায় মানুষের সীমান্তের ওপারে আশ্রয়, শরণার্থী শিবিরে নিরুপায় মানুষগুলোর দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পরিপূর্ণ সামরিক প্রতি আক্রমণ, ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ এবং অবশেষে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন আন্তর্জাতিক সীমারেখার সৃষ্টি।
বলে রাখা উচিত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সবসময় একটা কেন্দ্র থাকে। এটি মূলত নির্ভর করে সময়ের উপর। সময়ের প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়। যেমন, একটা সময় ছিল যখন স্বাধীনতার ঘোষক কে-এই ব্যাপারটি একটি বার্নিং কোয়েশ্চেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল (যদিও কখনোই এ ব্যাপারটি নিয়ে পানি ঘোলা করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না)। আবার এখনকার সময়ে রাজাকার অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি কেন্দ্রিক ইস্যু। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করার সময় সবাই-ই এখন যেমন যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে কথা বলে, তখনকার সময়ও স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে মানুষজন কথা বলতো (কোন দলকে সমর্থন করা হয় তার উপর ভিত্তি করে)।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির কথা বলি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলি, শহীদ যোদ্ধাদের স্মরণে সৌধ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালাই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই বীরাঙ্গনাদের কথা। এই দেশটাকে স্বাধীন করার পেছনে এ সকল বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের কোন সীমারেখা নেই। যে সকল নারী আপন সত্ত্বা এবং সম্ভ্রম হারিয়েছিল একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মূল্য দিতে গিয়ে, তাঁদের অবদানের কথা কখনোই অস্বীকার করা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের দেশে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি-সহায় কিংবা সাহায্য ব্যাপারটি বেশ বিচিত্রভাবে অনেকাংশেই উপেক্ষণীয়। স্বাধীনতার চার দশক পর একাত্তরের নির্যাতিতা সেসব নারীদের প্রাপ্তি একটাই-'বীরাঙ্গনা' উপাধি। কেউই যে তাদের নিয়ে কথা বলে না- তা নয়। কিন্তু বীরাঙ্গনাদের জন্য অন্তত যতটুকু করাটা উচিত, তার তুলনায় কিছুই করা হয় নি বললেই চলে।

নারীর প্রতি সহিংসতা
একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড দিয়ে। যার উদ্দেশ্য ছিল এক ধাক্কায় "ভীরু বাঙালী"র মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনী এই গণহত্যা প্রায় সম্পূর্ণ সফলতার সাথে সমাপ্ত করে। আর তাদের হত্যাযজ্ঞের অনুষঙ্গ ছিল নিরীহ নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা।
একাত্তরে নারীদের উপর কি ধরনের নির্যাতন হয়েছিল তা নিচের অংশটুকু পড়ে সামান্য হলেও ধারণা করা যেতে পারে। কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে এই অংশটুকু নেওয়া হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের "জোছনা ও জননীর গল্প" উপন্যাস থেকে। মূল সূত্র "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: অষ্টম খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, পৃষ্ঠা ৪৪"।

চুন্নু ডোম
ঢাকা পৌরসভা
রেলওয়ে সুইপার কলোনী
২২৩ নং ব্লক, ৩ নং রেলগেট
ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।

১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান।...আমরা উক্ত পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের যে রাজপথ শাখারীবাজারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার দু'ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী পুরুষের, কিশোর-শিশুর বহু পচা লাশ। দেখলাম বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাখারীবাজারের দুদিকরে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে, অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম।...পাঞ্জাবীরা প্রহরায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উশৃংখল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম।...আমরা ১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ শাখারীবাজর থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিনশত লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সনের ২৯ মার্চ সকাল থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুপার্শ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ি, রমনা কালিবাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি।...আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙালী যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি।...আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিধিঁয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁজড়া দেখেছি। মেয়েদের লাশের স্তন পাই নাই, যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখেছি।...মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।...(১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ) আমি সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙালী লাশ উঠাচ্ছিলাম তখন অসংখ্য বিহারী জনতা আমাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল, বাঙালীদের পরিণতি দেখে উপহাস করছিল। আমরা সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে আটটি বাঙালী যুবকের লাশ তুলেছি, কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে, সবার পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁজড়া হয়ে আছে।...পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি; প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পিছন দিকে বাঁধা ছিল।...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সম্মুখ থেকে দুজন রূপসী যুবতী মেয়ে এবং তিনজন যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি।...(৩১ মার্চ) সেদিন অসুস্থ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে পারি নাই।


চুন্নু ডোমের এই কথাগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি শকুনদের অত্যাচারের খুব ক্ষুদ্র অংশ তুলে আনে। কিন্তু একটি বিশেষ দিকে আমরা নজর দিতে বাধ্য হই। সেটি হল নারীর প্রতি সহিংসতা।
মুক্তিযুদ্ধ এমন একটা সময় ছিল যখন দেশের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-তরুণ সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে যতটুকু করতে পারা যায় ততোটুকু করার চেষ্টা করেছিল সকলে। পুরুষদের অনেকে যেমন অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, অসংখ্য নারীও তেমনি সেইসকল যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল নির্দ্বিধায়। আর সাহায্য করতে গিয়ে বা মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার জন্য শত শত নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আর সে নির্যাতনের ভয়াবহতা কল্পনা করাটা দুষ্কর।
নারীদের প্রতি সহিংসতার সর্বোচ্চ স্তর কোনটি? আমরা মোটামুটি সবাই বলব- ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণ। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি ছিল যে শুধুমাত্র "ধর্ষণ" কিংবা "গণধর্ষণ" এর মতো শব্দগুলো দিয়ে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। চুন্নু ডোমের কথা দ্বারা আমরা সামান্য হলেও ধারণা পাই। যেসকল নারী হানাদার বাহিনী দ্বারা নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাঁদের আমরা বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছি। কিন্তু বিনিময়ে সে সকল নারী সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবারে নিজ নিজ অধিকার হারিয়েছেন। সমাজের উচ্ছিষ্ট অংশের ভাগ্য বরণ করেছেন। অনেকে দু:স্বপ্নের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যাও করেছেন। সমস্যা হল, তাঁদের দিকে ফিরে তাকানোর জন্য কেউ ছিল না।

ইতিহাস এবং...
সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট অনেক বেশি বিস্তৃত। আর এই বিস্তৃতির একটি বিরাট অংশ জুড়েই রয়েছে নারীদের সংশ্লিষ্টতা। ইতিহাস স্পষ্টরূপে এর সাক্ষ্য দেয়। নিচে কিছু তথ্য প্রমাণ তুলে ধরা হল।

Gen. A. A. Khan Niazi did not deny rapes were being carried out and opined, in a Freudian (showing one's secret thought or feelings, especially those connected with sex) tone, “You cannot expect a man to live, fight, and die in East Pakistan and go to Jhelum for sex, would you?” (East Pakistan: The End Game, Brigadier Siddiquei)
"জেনারেল এ এ খান নিয়াজী (পূর্ব পাকিস্তানে) ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেন নি। বরং লালসাময় কন্ঠে তিনি বলেছিলেন, "তুমি কখনোই এটা আশা করতে পারো না যে একজন মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে বাস করবে, যুদ্ধ করবে এবং মারা যাবে- কিন্তু যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য ঝিলাম যাবে।" (ইস্ট পাকিস্তান: দি এন্ড গেইম, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী)

John Hastings, A Methodist missionary worked in Bangladesh for 20 years:
“I am certain that troops have raped girls repeatedly, then killed them by pushing their bayonets up between their legs.” (from Newsweek)
জন হ্যাস্টিংস, একজন মেথডিস্ট মিশনারি বাংলাদেশে ২০ বছর কাজ করেন। তিনি বলেছিলেন:
"আমি নিশ্চিত সৈন্যরা নারীদের ক্রমাগত ধর্ষণ করে এবং তাদের দু পায়ের মাঝখানে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।" (নিউজউইক)

In her ground-breaking book, Against Our Will: Men, Women and Rape, Susan Brownmiller likened the 1971 events in Bangladesh to the Japanese rapes in Nanjing and German rapes in Russia during World War II. “… 200,000, 300,000 or possibly 400,000 women (three sets of statistics have been variously quoted) were raped. Eighty percent of the raped women were Moslems, reflecting the population of Bangladesh, but Hindu and Christian women were not exempt. … Hit-and-run rape of large numbers of Bengali women was brutally simple in terms of logistics as the Pakistani regulars swept through and occupied the tiny, populous land …” (p. 81).
তাঁর এই অভিনব বই, অ্যাগেইন্স আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেইপ-এ সুসান ব্রাউনমিলার জাপানের নানজিং এ ধর্ষণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় জার্মান ধর্ষণের ঘটনার সাথে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ধর্ষনের ঘটনার যোগসূত্র স্থাপন করেন। "দুই লক্ষ, তিন লক্ষ কিংবা সম্ভবত চার লক্ষ (তিনি ধরনের তথ্যই বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে) নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। আশি শতাংশ নারীই ছিলেন মুসলমান। কিন্তু হিন্দ বা খ্রিস্টান নারীরা এর বাইরে ছিলেন না। বাঙালী নারীদের আঘাত এবং ক্রমাগত ধর্ষণ নৃশংসভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে সাধারণ যৌক্তিকতা লাভ করে। কারণ এই ক্ষুদ্র- জনসংখ্যা পূর্ণ ভূখণ্ডটি তারা দখল করে নিয়েছিল।

“Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty,” Brownmiller writes. “Girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted … Pakistani soldiers had not only violated Bengali women on the spot; they abducted tens of hundreds and held them by force in their military barracks for nightly use.” Some women may have been raped as many as eighty times in a night (Brownmiller, p. 83). How many died from this atrocious treatment, and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at.
"ধর্ষণ ব্যাপারটি শুধুমাত্র সুন্দরী নারীদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না," ব্রাউনমিলার লিখেছেন, "আট বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে ৭৫ বছর বয়সী দাদীরা পর্যন্ত যৌন আক্রমণের শিকার হন।....পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালী নারীদের ঐ স্থানে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হয় নি। তারা অসংখ্য বাঙালী নারীকে অপহরণ করে নিজেদের ব্যারাকে নিয়ে যেত। উদ্দেশ্য রাতে চাহিদা মেটানো।" কোন কোন নারী সম্ভবত আশি বারের মতো ধর্ষণের শিকার হন (ব্রাউনমিলার, পৃষ্ঠা ৮৩)। কতজন নারী নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আর কতজন নারীকে গণহত্যার অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছিল তা শুধু অনুমান করা যাবে।

Two [Pakistani soldiers] went into the room that had been built for the bridal couple. The others stayed behind with the family, one of them covering them with his gun. They heard a barked order, and the bridegroom’s voice protesting. Then there was silence until the bride screamed. Then there was silence again, except for some muffled cries that soon subsided. In a few minutes one of the soldiers came out, his uniform in disarray. He grinned to his companions. Another soldier took his place in the extra room. And so on, until all the six had raped the belle of the village. Then all six left, hurriedly. The father found his daughter lying on the string cot unconscious and bleeding. Her husband was crouched on the floor, kneeling over his vomit. (Quoted in Brownmiller, Against Our Will, p. 82.)
"নববিবাহিত দম্পতির জন্য তৈরি রুমটাতে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য গেল। অন্যরা পরিবারটির পিছনে দাঁড়িয়েছিল, একজন তাঁর বন্দুক তাক করে রেখেছিল। হঠাৎ তারা একটা গর্জন শুনল। সাথে সাথে বরের কন্ঠে প্রতিবাদ। তারপর কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু শান্ত। একটু পর কনের চিৎকার ভেসে আসল। এরপর সামান্য চাপা কান্না ছাড়া আবার সব চুপচাপ। একটু পর একজন সৈন্য রুম থেকে বেরিয়ে আসল। তার পোশাক অগোছালো। সে তার সঙ্গীদের দিকে দাঁত বের করে হাসল। আরেকজন সৈন্য ঐ রুমে ঢুকল। এবং পরপর ছয় জন সৈন্য ধর্ষণ করল মেয়েটিকে। তারপর ছয়জনই দ্রুত চলে গেল। মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় দেখল। মেয়েটির স্বামী তখন হাঁটু গেড়ে মেঝেতে পড়ে আছে। নিজের বমির উপর।" (অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল, পৃষ্ঠা ৮২, লেখক- ব্রাউনমিলার।

“ …..Some army officer raided the Rokeya Hall, the girls’ hostel of Dacca University, on October 7, 1971. Accompanied by five soldiers, Major Aslam had first visited the hostel on October 3, and asked the lady superintendent to supply some girls who could sing and dance at a function to be held in Tejgaon Cantonment. The superintendent told him that most of the girls had left the hostel after the disturbances and only 40 students were residing but as a superintendent of a girls’ hostel she should not allow them to go to the cantonment for this purpose. Dissatisfied, Major Aslam went away. Soon after the superintendent informed a higher army officer in the cantonment, over the telephone, of the Major’ s mission.
However, on October 7, at about 8 p.m. Major Aslam and his men raided the hostel. The soldiers broke open the doors, dragged the girls out and stripped them before raping and torturing them in front of the helpless superintendent. The entire thing was done so, openly, without any provocation, that even the Karachi-based newspaper, Dawn, had to publish the story, violating censorship by the military authorities...."
"....১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর কিছু আর্মি অফিসার হঠাৎ করে রোকয়া হলে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেল) এ আক্রমণ করল। এর আগে পাঁচজন সৈন্য নিয়ে মেজর আসলাম প্রথম অক্টোবরের ৩ তারিখে হোস্টেলে গিয়েছিল। মহিলা সুপারিটেন্ডেন্ট এর কাছে গিয়ে সে নাচ গানে পারদর্শী কিছু মেয়েকে একটি অনুষ্ঠানের জন্য তেজগাঁও ক্যান্টনমেন্টে পাঠাতে বলে। সুপারিটেন্ডেন্ট বললেন যে অধিকাংশ মেয়েই জটিলতা সৃষ্টির পরপর হোস্টেল ছেড়ে চলে যায়। মাত্র ৪০ জন মেয়ে ছিল কিন্তু হোস্টেলের সুপারিটেন্ডেন্ট হিসেবে তিনি কখনোই তাঁদের হোস্টেলের বাইরে পাঠাতে পারেন না। মেজর আসলাম অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যায়। একটু পরে সুপারিটেন্ডেন্ট মেজরের উদ্দেশ্যের কথা ক্যান্টনমেন্টের একজন বড় কর্মকর্তাকে জানান।
যাই হোক, অক্টোবরের ৭ তারিখ রাত আটটার দিকে মেজর আসলাম এবং তার সৈন্যরা হোস্টেলে আক্রমণ করে। সৈন্যরা দরজা খুলে মেয়েদের বাইরে নিয়ে আসে। এরপর ধর্ষণের পূর্বে নির্মমভাবে অসহায় সুপারিটেন্ডেন্টের সামনে তাদের নির্যাতিত করা হয়। পুরো ঘটনাটি কোন উত্তেজনার কারণ ছাড়াই পুরো উন্মুক্তভাবে ঘটানো হয়। এমনকি করাচী ভিত্তিক পত্রিকা, ডন, মিলিটারি কর্তৃপক্ষের প্রতি সেন্সরশীপ ভঙ্গ করে এ খবর প্রকাশ করেছিল..."
হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার খুব ক্ষুদ্র অংশ চিত্রায়িত হয়েছে উপরের বর্ণনাগুলিতে।
বীরাঙ্গনারা ধর্ষণের ফলে যেসব যুদ্ধশিশু গর্ভে ধারণ করেছিলেন তাদের অধিকাংশই গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে গর্ভপাত বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় সন্তান জন্ম হয় ঠিকই। কিন্তু সেই সন্তান কখনোই স্বীকৃতি পায় নি। বিভিন্ন দেশের দম্পতি তাদের দত্তক হিসেবে নিয়ে যায়। অপরদিকে হতভাগা ঐসব নারীরা সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রেণীতে পরিণত হন। আজ অবধি এই অবস্থা খুব বেশি বদলায় নি। লিংকিটিতে ক্লিক করে ছবিটি দেখা যেতে পারে।
Click This Link

কয়েকজন বীরাঙ্গনা

বীরাঙ্গনা প্রভাসিনী:
"....শমসেরনগর বাজার থেকে প্রায় ১০ মিনিটের হাঁটা পথ কড়ইতলা। সেখানে লোকজনকে বীরাঙ্গনা প্রভাসিনী মালাকারের ঘর কোথায় জানতে চাইলে স্থানীয় লোকজন বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি একটি জরাজীর্ণ ঘর দেখিয়ে দেয়। ওই ঘরের সামনে যেতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক যুবক। জানান, তিনি প্রভাসিনী মালাকারের একমাত্র পুত্র কাজল মালাকার। পরিচয় পেয়ে তিনি ডেকে আনেন তার মা প্রভাসিনী মালাকারকে। ঘণ্টা দুয়েক কথা বলেন একাত্তরের বীরাঙ্গনা প্রভাসিনী। তিনি জানান, এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা একাত্তরে তার নির্যাতনের ঘটনা জানলেও কেউ প্রকাশ করেনি। কিন্তু প্রায় এক বছর আগে একই এলাকার জনৈক ব্যক্তি তাকে পাঞ্জাবির বউ ও তার ছেলেকে পাঞ্জাবির ছেলে বলে কটা করে। এ নিয়ে এলাকায় সালিশ হয়। এরপরই তার নির্যাতনের কাহিনী প্রচার হতে থাকে। বর্তমানে গ্রামের অনেকেই তাদের কটাক্ষ করেন...।
’৭০-এর ডিসেম্বর বা ’৭১-এর জানুয়ারি মাসে বিয়ে হয় প্রভাসিনী মালাকারের। সাল, তারিখ তাঁর মনে নেই। তবে মনে আছে বিয়ের চার মাসের মধ্যেই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুতেই আশপাশের গ্রামগুলোর নারী-পুরুষ-শিশুরা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। প্রভাসিনী মালাকারের বাবার বাড়ির সবাই ভারতে আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে। তার শ্বশুরবাড়ির সবাই সিদ্ধান্ত নেন ভারতে আশ্রয় নেয়ার। তবে প্রভাসিনীর মা অসুস্থ থাকায় তিনি বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
দুবাড়ির সবাই ভারতে আশ্রয়ের জন্য যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর অসুস্থ মা একা বাড়িতে কীভাবে থাকবেন এ চিন্তায় প্রভাসিনী তার স্বামীকে জানান তিনি তার অসুস্থ মায়ের সঙ্গে এ দেশেই থাকবেন। কিন্তু তার স্বামী এতে রাজি হননি। যেদিন ভোরে প্রভাসিনীর স্বামীর বাড়ির লোকজন ভারতে রওনা হবেন তার আগের দিন রাতে প্রভাসিনী স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান বিক্রমকলস গ্রামে বাবার বাড়িতে। রাতে প্রভাসিনীকে খুঁজে না পেয়ে তার স্বামী কামিনী রাম মালাকার সপরিবারে ভারতে চলে যান।
সদ্য বিবাহিতা প্রভাসিনীকে নিয়ে তার মা পড়েন বিপাকে। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের কুদৃষ্টি থেকে কীভাবে প্রভাসিনীকে আড়ালে রাখা যায় সে চিন্তায় তাঁর মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে গ্রামের রাজাকার নজির মিয়া ও জহুর মিয়ার কুদৃষ্টি পড়ে প্রভাসিনীর ওপর। মে মাসের এক সন্ধ্যায় ওই রাজাকাররা বন্দুকের মুখে মায়ের কাছ থেকে প্রভাসিনীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় একই গ্রামের বাদল মাস্টারের বাড়িতে। ওই বাড়িতে অবস্থান করছিল পাক আর্মিরা। সে রাতে প্রভাসিনীর ওপর দিয়ে বয়ে যায় নির্যাতন। পরদিন সকালে পাক আর্মিরা তাকে ছেড়ে দেয়। এ অবস্থায় তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে আশ্রয় নেন জাঙ্গালহাটি গ্রামে তার বড় বোনের বাড়িতে। সেখানে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এলাকার কুখ্যাত রাজাকার কাদির, ইনতাজ, জহুর, রইছ পুনরায় জাঙ্গালহাটি গ্রামে অবস্থিত প্রভাসিনীর বড় বোনের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়।
ওই রাতে রাজাকাররা প্রভাসিনীকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প শমসেরনগর ডাকবাংলোয়। আবারো তার ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার। এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরদিন সকালে পাক আর্মিরা তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় ছেড়ে দিলে তিনি আবারো বড় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর প্রভাসিনীর স্বামী ভারত থেকে দেশে ফেরেন। দেশে ফিরেই তিনি প্রভাসিনীকে তার বড় বোনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে আনতে গেলে প্রভাসিনী সব ঘটনা স্বামীকে জানিয়ে স্বামীর বাড়ি যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রভাসিনীর স্বামী কামিনী রাম মালাকার সব কিছু জেনেই তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রভাসিনীর গর্ভে জন্ম হয় এক পুত্রসন্তানের। স্বাধীনতার পর প্রভাসিনী রাজাকার নজির, ইন্তাজ, ইদ্রিছ, রইছদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামিরা গ্রেফতার হয়ে কারাবাস করে।
৮০-এর দশকে প্রভাসিনীর স্বামী কামিনী রাম মালাকার মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর প্রভাসিনী তার একমাত্র ছেলে কাজল মালাকারকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে প্রভাসিনী ব্যবসা শুরু করেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করেন টুকরিতে করে। এক সময় ছেলে কাজল মালাকারকে বিয়ে করান। কাজল মালাকারের ঔরসে জন্ম নিয়েছে ৬ সন্তান। বর্তমানে প্রভাসিনীর পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৯। নিজের ফেরি ব্যবসা ও ছেলে কাজল মালাকার রিকশা চালিয়ে যা উপার্জন করেন তা দিয়েই কোনোমতে চলছে প্রভাসিনীর সংসার।
প্রভাসিনী জানেন না আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ইজ্জত হারানো নারীদের সরকার বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছে। জানা না থাকায় তিনি বীরাঙ্গনা উপাধি পাওয়ার জন্য কোনো আবেদন করেননি...।
(বীরাঙ্গনা প্রভাসিনী, ইসমাইল মাহমুদ, সাপ্তাহিক ২০০০, ফিচার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১০)

বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবী:
মিটামইনের সরকারহাটির সেই ১৯৭১ সালের বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবীর (৫০) খবর কেউ রাখে না। সহায়-সম্বলহীন রাসমনি দেবী অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বীরাঙ্গনার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। কিন্তু বিদায়ী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার বাড়ির পাশের বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবীর খবর হয়তো তিনি নিজেও রাখেন না। বক্তৃতা-বিবৃতিতে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। কিন্তু এদের কথা কেউ বলেন না। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকার। সম্প্রতি কথা হয় রাসমনি দেবীর সঙ্গে। ১৯৭১ সালের শ্রাবণ মাসে মিটামইন সরকারহাটির মৃত রামলোচন চত্রক্রবর্তীর মেয়ে রাসমনি দেবীর বয়স যখন ১৬ বছর, তখন একই উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ঢালারগাঁও ছত্রিশে এক টগবগে যুবকের সঙ্গে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার বিয়ে হয়। তার বিয়ের পরপরই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর তান্ডবলীলা এবং ঘটতে থাকে একের পর এক বর্বরোচিত ঘটনা। তখন বর্ষাকাল। চারদিকে অথৈ পানি। ওই সময়ই তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর মেয়ে-জামাই ফিরাগমন করে জামাইয়ের নিজ বাড়ি ছত্রিসে চলে আসেন রাসমনি দেবীকে নিয়ে। চলে আসার দু’দিন পরই হঠাত দুপুরবেলায় পাক হানাদার বাহিনী ঢালারগাঁও ও ছত্রিসের প্রায় ৩ শ’ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আরো ২০ মহিলাকেও তারা নিয়ে যায় ইটনা পাকবাহিনী ক্যাম্পে। প্রথমে যাদের ধরা হয় তাদের গুলি করে হত্যা করে। মিটামইন উপজেলায় আতপাশা ভয়রা গাছের নিচে তাদের গণকবর দেয়। আর মহিলাদের গণধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়। সুন্দরী রাসমনি দেবী অর্থাৎ যিনি বীরাঙ্গনা খেতাব পান তাকে গণধর্ষণ করে নদীতে ফেলে দেয়। ইটনা থানার ছিলনী গ্রামের জেলেরা রাসমনিকে নদী থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যায়। তখন তিনি অজ্ঞান ছিলেন। জেলেরা তাঁকে আগুনের তাপ দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে আসে। জ্ঞান ফেরার পর নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে তিনি মিটামইন সরকারহাটির কথা বলেন। জেলেরা তাকে মিটামইনে পৌঁছে দেয়। তার স্বামীকে পাক হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এরপর থেকেই রাসমনি মিটামইনে তার পিত্রালয়ে বসবাস করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাসমনিকে এক হাজার টাকা প্রদান করেন এবং তাকে একটি সার্টিফিকেটও দেন। সেই থেকেই রাসমনি দেবী বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিত এবং দুর্বিষহ জীবনের গ্লানি বয়ে বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর ওই কাজের পর স্বাধীনতার ৩৬টি বছর কেটে গেল; কিন্তু কোনো সরকারই রাসমনি দেবীর খবর নেয়নি। এমনকি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন ডেপুটি স্পীকার ও পরের সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদও তার খোঁজ নেননি। বর্তমানে তিনি খুব কষ্টে তার ভাই দেবরাজ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে আছেন। দেবরাজ পান-সুপারির ব্যবসা করে কোনোরকমে দিনযাপন করেন। এ বছর স্থানীয় ইউএনও অফিসের পিয়ন নরেশ দাস ইউএনও সাহেবকে বলে রাসমনি দেবীর জন্য বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। এ টাকা দিয়ে রাসমনি চলতে পারেন না। মিটামইনে এই রাসমনি দেবীর মতো অনেকেই আছেন যাদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। রাসমনি দেবীরা আমাদের গৌরব। তাদের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন নিজেদের দৈন্যকেই প্রকট করে তোলে। রাসমনি দেবী মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই ফিরে যান সেই দিনগুলোতে। ডুকরে কেঁদে ফেলে বিলাপ করেন, ‘আমি আবার যুদ্ধ দেখতে যাই।’
(বিজয় কর রতন, সমকাল ইন্টারনেট এডিশন, ৭ জানুয়ারি, ২০০৮)

বীরাঙ্গনা হাজেরা:
ভিক্ষা করেই চলেন বীরাঙ্গনা হাজেরা বেগম। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বামী-সন্তান হারানো লক্ষ্মীপুরের বীরাঙ্গনা হাজেরা বেগমের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলেনি। জীবনের শেষ বেলায় চলাচলে অক্ষম হাজেরা বেগমকে দুমুঠো অন্ন জোগাতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। ৬৫ বছর বয়সী হাজেরা বেগমকে স্থানীয় অনেকেই চেনেন না। তবে তার ওপর পাক হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। লক্ষ্মীপুর সদর থানার ১৬নং ইউনিয়নের শাখচর গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন হাজেরা বেগম। বেশ কম বয়সেই যশোরে মনির হোসেন নামে এক পুলিশ হাবিলদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। রাজাকারে যোগ দেওয়া নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মনির হোসেনের সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের ঝগড়া হয়। পরে মনির হোসেন স্ত্রী হাজেরা বেগম ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে লক্ষ্মীপুর চলে আসেন। দিন তারিখ মনে না করতে পারলেও হাজেরা বেগম জানান, ঠিক সন্ধ্যার দিকে লক্ষ্মীপুরের কাছাকাছি অর্থাৎ বাগবাড়ি মাদাম ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছতেই পাক হানাদার বাহিনীর সামনে পড়েন। হাজেরা বেগমের সামনেই স্বামী মনির হোসেন ও দুই সন্তানকে উপর্যুপরি কয়েক রাউন্ড গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে হাজেরা বেগমকে ধরে নিয়ে বটু চৌধুরীর বাড়ির পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নেওয়া হয়। রাতে সেখানে তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী। প্রয়াত চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনের দয়ায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে আছেন শাকচর গ্রামের চাল-চুলা ছাড়া ছোট্ট এই ভিটেতে। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখা হাজেরা বেগমকে লাঠি ভর দিয়ে প্রতিদিনই অন্নের সন্ধানে বের হতে হয়। (সিটিজি নিউজ)

বীরাঙ্গনা রিজিয়া:
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লী রয়েড়া গ্রামের ঝোপের মধ্যে ডোবার পাশে জীর্ণশীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে ছোট একটি একচালা ছাপড়া ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বীরাঙ্গনা রিজিয়া খাতুনের বসবাস। পরনে সাদা শাড়ি অসংখ্য তালি দেওয়া আর ঘরের বারান্দায় এক পাশে রান্না ঘর।... স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও ৬২ বছরের বৃদ্ধা বীরঙ্গনা রিজিয়া বেগম আজও ভুলতে পারেননি সেদিনের পাক বাহিনীর কাম্পে নরক যন্ত্রনার কথা। সে কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন। সেই থেকে তাঁর কষ্টের জীবন শুরু,আজও দুঃখ কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন এই বীরঙ্গনা। ১৯৭১ সালের মে মাস। পাকসেনারা বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে চালাচ্ছো অত্যাচার, হত্যা ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য।
রিজিয়া বেগমের বাড়ি ছিল রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কসবামাঝাইল গ্রামে। পিতা নজু মন্ডলের ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে ১৮ বছরের রিজিয়া বেগম ছিলেন দ্বিতীয়। গ্রামে গ্রামে তখন পাক হানাদার বাহিনী আর রাজাকারের অত্যচারের ভয়ে মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই রিজিয়ার বাবা বাড়িতে সুন্দরী যুবতী মেয়ে রাখা নিরাপদ মনে করেননি।
শৈলকুপা মাইলমারি গ্রামের খালু রফিক ছিলেন এলাকার প্রভাবশালী তাই খালু খবর পাঠান রিজিয়াকে তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। মে মাসে রিজিয়া বড়ো ভাই আজমত আলী ও ছোটবোন মোমেনাকে সাথে নিয়ে মাইলমারি গ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন। পথের মাঝে রানীনগর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার হাজারী মন্ডলের বাড়ির নিকট পৌছাতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। এই লম্পট রাজাকার হাজারী মন্ডল তাদের রাতে নিরাপদে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৌশলে তাঁর বাড়ি নিয়ে যায়।
রিজিয়া জানান: দিনটি ছিলো সেমাবার। পরদিন সকালে হাজারী পাক বাহিনীর ক্যাম্পে খবর দেয়। রিজিয়ার হাতে ছিলো একটি দামী রিকো ঘড়ি। পাক সেনারা ও রাজাকাররা ঘড়িটি দেখে বলে এটি গোপন খবর পাঠানো যন্ত্র। তাঁর নিকট থেকে ঘড়িটি ছিনিয়ে নেয়। এর পর পাক সেনাদের দৃষ্টি পড়ে সুন্দরী রিজিয়ার উপর এবং জানায় তাদের সাথে শৈলকুপা সেনা ক্যাম্পে না গেলে তাঁর ভাই বোনকে তাঁর সামনে হত্যা করা হবে। ভাই বোনের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন জলাঞ্জলি দেন। তাকে আনা হয় শৈলকুপার ওয়াপদা অফিসের বাংলোতে। তারপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন।
রিজিয়া জানান সেখানে আরো ১৫/১৬ জন নারীকে বন্দী অবস্থায় তিনি দেখেছেন তারা ছিলও অসম্ভব সুন্দরী। কিন্তু কারোর সঙ্গে কোন কথা বলতে দিত না। এর পরেও বুটদিয়ে লাথি মারতো, অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাত করতো। শৈলকুপা যেদিন শক্রমুক্ত হলো তার কয়েকদিন আগে তাদের ওয়াপদাতে নিয়ে রাখা হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ৮ নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটি দল শৈলকুপা আইবি থেকে যখন উদ্ধার করেন তখন সবাই ছিল বিবস্ত্র অবস্থায়। অন্য নারীরা বস্ত্র পেয়ে যে যার মত নিজ বাড়ী ও এলাকাতে ফিরে যান। (শেখ শফিউল আলম লুলু, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি, নিউজ ফার্স্ট বিডি)

এদেশে মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা চালান। বীরাঙ্গনারা ভিক্ষা করেন। আর রাজাকারেরা নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। অনেকেই সেইসব রাজাকারদের ভোট দেয়। তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। তাদের আদর্শ মেনে চলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ আসলেই 'যুদ্ধাপরাধ' শব্দটিকেই কুসংস্কার হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চালায়। কারণটা ঠিক বোঝা যায় না। এদেশের উপর একাত্তরে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেই ঝড়ের বিস্তৃতি লাভের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সেইসব মানুষদের, যারা নির্দ্বিধায় হানাদার বাহিনীর চাকরের কাজ করেছে। অথচ এই সামান্য কথাটাই অনেকে বুঝতে চান না। বরং উল্টো যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চান "যুদ্ধাপরাধীর বিচার" পুরাই অর্থহীন একটা ইস্যু।

কেউ কথা রাখে নি
As per our statistics on the abortion centers and hospitals around the country, less than 10% of the total raped women visited those centers. In most cases the abortions were done locally and efforts were taken to keep those incidents secret due to social situation. The doctors and specialists, like Dr Anwarul Azim, involved in the hospitals and abortion centers agreed to this statistical information. In reality the raped women who became pregnant after September and less than three months pregnant in early 1972, they did not go the abortion centers and hospitals at all. In our account, the number of women of this category was at least 88,200. Moreover, in those three months, raped 162,000 women and 131,000 Hindu refugee women simply disappeared, assimilated into the vast population, without any report at all. (The Rape of 71: The Dark Phase of History -Dr. M A Hassan)
"দেশের বিভিন্ন গর্ভপাত কেন্দ্র এবং হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষিতা হওয়া নারীদের মাত্র ১০ শতাংশ এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে গিয়েছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে এ ধরনের ঘটনাগুলো গোপন রাখা হয়েছিল। ডা. আনোয়ারুল আজিমের মতো হাসপাতাল এবং গর্ভপাত কেন্দ্রগুলোর ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞরা এই পরিসংখ্যানের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। বাস্তবে, যেসকল ধর্ষিতা নারী সেপ্টেম্বরের পরে এবং ১৯৭২ সালে তিন মাসের কম সময় গর্ভধারণ করেন, তাঁদের কেউই গর্ভপাত কেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যান নি। এ ধরনের নারীর সংখ্যা অন্তত ৮৮,২০০। আবার, এ তিন মাসে ধর্ষিতা ১৬২,০০০ নারী এবং ১৩১,০০০ হিন্দু উদ্বাস্তু নারী কোন রিপোর্ট করা ছাড়াই বিশাল জনসংখ্যার ভিতর পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যান।" (The Rape of 71: The Dark Phase of History -Dr. M A Hassan)

মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দিক যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখব সেই সময়ে সবচেয়ে দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা ছিল নারীদের। এবং নানাভাবে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অকল্পনীয় সব অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তাঁদের প্রতি। এ ধরনের অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়াও অনেকটা অসম্ভব ছিল। কারণ নারীদের জন্য তখন ঘরে থাকাটা মোটেই নিরাপদ ছিল না। পাশাপাশি পালিয়ে বাঁচাও ছিল কঠিন কাজ। নারীদের অনেকেই সেসময় অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন- এ কথা সত্যি। কিন্তু অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়াটাও যথেষ্ট কঠিন ছিল। ফারুক ওয়াসিফ তাঁর অনেক আগের একটি লেখায় (সেইসব 'বীরাঙ্গনা', তাদের না-পাক শরীর এবং একাত্তরের কাজলরেখাদের কথা- মুক্তাঙ্গন, ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯) এ ধরনের কিছু কথা বলেছিলেন। তাঁর সেই লেখায় চমৎকার একটি অংশ ছিল এইরকম:

....যুদ্ধে সামিল হয়েছেন এমন নারী বিরল নয়। অথচ সত্তরের ডিসেম্বরে ছাত্রীদের কাঁধে ডামি বন্দুক দিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হলেও যুদ্ধের সময় মেয়েদের নিয়ে আলাদা কোনো বাহিনী গঠন কিংবা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ধর্ষিতার সারিতে তারা, গণহত্যার মোট সংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশও তারা। শাহীন আফরোজের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। জাতীয়তাবাদ কি তবে পুরুষের মতাদর্শ?

সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধে এবং এর পরবর্তী সময়ে নারী মাত্রই বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং দুর্ভাগ্যের অংশীদার। এ দৃশ্য ফুটে ওঠে তাঁর লেখার আরেক জায়গায়:

জাতীয় মুক্তির যুদ্ধের ‘গৌরব’ কি কেবলই পুরুষেরই? ১৯৭৩ সালে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন নারী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের দরিদ্র নারী তারামন বিবি। তিনি তার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পাওয়ার খবর জানতে পারেন ঘটনার ২৪ বছর পর।


যশোরের হালিমার কথা ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন এভাবে:

যশোরের হালিমা পারভীনের কাহিনীও কম মারাত্মক নয়। ১৯৭১ সালে হালিমা অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে বড় মানুষ হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার পিতাকে নির্মম প্রহার করে। এ দেখে হালিমার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায়। তিনি তার পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অস্ত্র তুলে নেন। তারা ৩৫ জন তরুণ-তরুণীর একটি বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং নেন। হালিমা একাধিক অপারেশনে অংশ নেন এবং আর্মি ও রাজাকার হত্যা করেন। একটা পর্যায়ে স্থানীয় দালালরা খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তারা ঘেরাও হয়ে যান। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা দেন এজন্য যে, নইলে অনেক গ্রামবাসীও মারা পড়ত। তাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সামনেই সব পুুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। হালিমার সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন ফাতেমা ও রোকেয়া নামের আরো দু’জন নারী যো। হালিমার ভাষায় : যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমরা আরো হাজার হাজার নারীকে বন্দি থাকতে দেখি… তাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজ হাতে তাদের কবর খুঁড়তে হতো।… বাড়ি ফেরার পর আমি বুঝলাম আমার যুদ্ধ শেষ হয়নি। যদিও যশোর স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমি স্বাধীন হইনি। আমার যুদ্ধ যেন নতুন করে শুরু হলো। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আমার নিজ মানুষদের সঙ্গে, আমার নিজের দেশের সঙ্গে যাদের জন্য আমি যুদ্ধ করেছি, যাদের জন্য আমি সব হারিয়েছি। আমার যুদ্ধ এখনো চলছে (ওমেন ইন ফ্রন্টাল ওয়ার: শাহীন আফরোজ, ২০০৫)। হালিমা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধের মধ্যে বন্দি হন। কিন্তু তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠে নাই, উঠেছে বীরাঙ্গনার খাতায়। এই ছিল তার পুরষ্কার! হালিমা ছোটবেলায় চেয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। সেই সাধ অর্ধেক পূরণ হয়েছে। তিনি ডাক্তার হতে পারেননি, অনেক কষ্টে সিভিল সার্জন অফিসের আয়া হতে পেরেছেন।

পাঠকদের অনুরোধ করব পুরো লেখাটা পড়ে নিতে: http://www.nirmaaan.com/blog/faruk-wasif/5796
একাত্তরের নারীদের দুর্দশার পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পর তাঁদের প্রতি জন্য যতটুকু করার কথা ছিল তাঁর তুলনায় কিছুই করা হয় নি। তাঁদের জন্য যা সাহায্য এসেছিল তার প্রায় সবই ছিল এনজিও কিংবা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্যোগের কারণে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েও নারীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ছিলেন। অসংখ্য বিশেষ দিবস পালন করি আমরা। কিন্তু বীরঙ্গনাদের জন্য এদেশে কি একটি বিশেষ দিবস আছে?

শেষ কথা
বীরাঙ্গনারা পরাজিত। জীবন যুদ্ধে পরাজিত। সামাজিক সংকীর্ণতা এবং দুর্দশার কাছে পরাজিত। তাঁদের পরাজয়ের কারণ অনেক। এ পরাজয়ের মূল দায় তাদের, যারা বীরাঙ্গনাদের উপেক্ষা করেছিল। সমাজ এবং রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবে গণ্য করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের তাঁরা তাঁদের মান মর্যাদা পান নি। এখনো কি পেয়েছেন?
৭১ এর বীরাঙ্গনা অধ্যায়টি প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো। সমস্যা হল এ অন্ধকার আমাদেরই সৃষ্টি। আমরা প্রদীপের আলোয় তৃপ্ত হতে চাই। আর অন্ধকারটুকু দূরে ঠেলে দিই।


(কৃতজ্ঞতা: এ লেখাটি লেখার পেছনে একজন মানুষের সরাসরি প্রভাব আছে। তাঁর নাম আদনান মান্নান। তাঁর পরিচয় অনেক। তিনি শিক্ষক, সংগঠক, বিতার্কিক- এরকম অনেক কিছু। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির একটি বিতর্ক কর্মশালায় গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি ক্লাস নিয়েছিলেন। ক্লাসের শেষদিকে কয়েকজন বীরঙ্গনার কাহিনী শোনান। কাহিনীগুলো শুনে অনেকদিন পর পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সেই স্তব্ধতা থেকেই এ লেখা।
লেখাটির মূল উদ্দেশ্য সবাইকে কিছু তথ্য জানানো। একটি নিষিদ্ধ (কিন্তু জ্ঞাত) অধ্যায়ের প্রতি পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ। আশা করি সামান্য হলেও তা করতে পেরেছি। সবার জন্য শুভাকামনা।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১২ রাত ২:৩৮
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×