আগেই বলে রাখা ভালো আমি নিজে তেমন পদের স্ক্রিপ্ট লেখিনা আর আমি যেসব জিনিস নিয়া চিন্তা করি সেসব জিনিস শুনলে পাব্লিক বলে - ভাই কি কন! তারপরেও চিন্তা করি এবং লিখি। প্রথমে ভাবছিলাম - একদিন সব স্ক্রিপ্ট দিয়া একটা একটা কইরা শর্ট ফিল্ম বানামু। এখন ভাবতেছি - আস্তে আস্তে সবগুলা স্ক্রিপ্ট পোলাপানরে দিয়া দিমু, তারা শর্ট ফিল্ম বানাবে। এই জন্য সিনেমা পিপলস এর আন্ডারে ৬ টা প্রোজেক্ট চালাইতেছি। জানিনা কয়টা সফল হবে, তবে অন্তত ৩/৪ হলেও আমাদের অনেক বড় পাওয়া হবে। আর আমার স্ক্রিপ্ট থাকে ওপেন, মানে যে কেউ মেরে দিতে পারবে কিন্তু এখনো যখন কেউ মারে নাই, তখন বুঝতেই পারতেছেন আমার গল্পগুলা কেমন বিখাইউজ
যাইহোক, অনেক আগে স্ক্রিপ্ট কিভাবে লিখতে হয় সে ব্যাপারে পোস্ট দিয়েছিলাম। আসলে সে লেখাটা ছিলো ফরমেশনের উপর গুরুত্ব দিয়ে। আপনি একটা স্ক্রিপ্ট লিখবেন, কিন্তু আমি পড়ে কিছুই বুঝলাম না। তাহলে আপনার স্ক্রিপ্ট হয়ে পড়লো ভ্যালুলেস। আর তাই, ফরমেশন নিয়ে বেশ বিস্তারিত পোস্ট দিয়েছিলাম। শুধু আমি না, সামু ব্লগে স্ক্রিপ্ট রাইটিং নিয়ে আমার আগে দুজনের লেখা আছে। একটা রন্টি ভাইয়ের , আরেকটা শামীম ভাইয়ের ।
কিন্তু ফরমেশন জানলেই তো হবেনা, কিছু ব্যাপার স্যাপার তো আছেই। নাইলে ফর্মেশন মেনে লিখলেও কেনো ভাল স্ক্রিপ্ট খারাপ স্ক্রিপ্ট এর মান নির্ধারন হয়! স্ক্রিপ্ট লেখার আগে আপনাকে প্রথমেই বুঝতে হবে আপনার গল্পটা কতটা অ্যাট্রাক্টিভ। গল্পটা মৌলিক তো! কপি-পেস্ট গল্প নিয়ে কাজ করলে পাব্লিক ছুড়ে ফেলে দিবে। তবে আপনি গল্প অ্যাডাপ্ট করতে পারেন। ধরুন, একটা ইতালিয়ান গল্প পড়ে আপনার বেশ ভাল লাগলো। আপনি সেই গল্পটিকে নিজের সমাজ ও দেশের আঙ্গিকে নতুন রুপ দিতেই পারেন। প্রায় পুরোটাই যদি কপি পেস্ট এর মতো হয়ে যায়, তাহলে বলে দিতে পারেন যে বিদেশী গল্পের ছায়াবলম্বনে। তবে আমার পরামর্শ থাকলো, গল্পে কিছু পরবর্তন আনুন। গল্পের শেষে টুইস্টটা পরিবর্তন করতে পারেন কিনা দেখুন। অথবা, নায়কের মোটিভ চেঞ্জ করতে পারেন কিনা দেখুন। এসব ছোটখাটো পরিবর্তন করেও গল্পটাকে ইন্টেরেস্টিং রাখতে পারলে বুঝবেন স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আপনি একেবারে খারাপ না
তো চলুন দেখে নেই কি কি ব্যাপারগুলোতে আমরা জোর দিবো। অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে - স্ক্রিপ্ট লেখার সময় আমরা কি কি ভাববো এবং কি কি করবো।
* গল্প কেমন হবেঃ প্রথমেই আপনার গল্প বা আইডিয়াতে চোখ বুলান। গল্পে কি টুইস্ট আছে? একেবারে সাদামাটা গল্প কি? কোথাও কি উত্তেজনা আছে? বিরহ আছে? আনন্দ? সবকিছুই যে একটা গল্পে থাকতে হবে এমন নয়; কিন্তু আপনার গল্পের বা আইডিয়ার মাঝে যদি কোন কিছুই না থাকে তাহলে কি গল্পটা ফ্লাট হয়ে যাবেনা?
গল্পে টুইস্ট আনুন। এমন সব টুইস্ট নিয়ে চিন্তা করুন যা আগে কখনো হয়নি। অথবা পুরোনো টুইস্টগুলোকে ঝালাই করে দেখুন এগুলকেই নতুনরুপে হাজির করা যায় কিনা।
* স্ক্রিপ্ট ডেভেলপঃ আচ্ছা, স্ক্রিপ্টটাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে ফেলুন। প্রথমেই মনে করুন আইডিয়া দাড় করালেন। এবার সিকোয়েন্স অনুযায়ী আইডিয়াকে একটা খাঁচাতে রুপ দিন। মানে, গল্প কিভাবে এগুবে সেটা সিকয়েন্স ওয়াইজ এক লাইন দুই লাইন করে লিখে স্ক্রিপ্ট এর প্রাথমিক কাজ শেষ করুন। ধরি, সবমিলিয়ে আপনার সিকোয়েন্স দাড়িয়েছে ৫০টি। এই ৫০টি সিকোয়েন্স এর প্রতিটিতে আপনি এক লাইন দুই লাইন লিখে বুঝিয়েছেন গল্প কিভাবে এগুচ্ছে।
এবার প্রতিটি সিকোয়েন্স নিয়ে ভাবুন। ভাবুন, সিকোয়েন্স টু সিকোয়েন্স সঠিক ভাবে যাচ্ছে কিনা। ভাবুন, প্রতিটি সিকোয়েন্সের লোকেশন কেমন হবে এবং লিখে ফেলুন। কোন কোন ক্যারেক্টার সিকোয়েন্সে থাকবে সেটাতো লিখবেনই।
এবার লিখে ফেলুন বর্ননা। মানে সিকোয়েন্সগুলোতে কিভাবে কি হবে। বিস্তারিত বর্ননা লিখে ফেলুন।
এবার ডায়ালগ লেখার পালা। ক্যারেক্টারগুলোকে জায়গামতো বসান। তাদের ডায়ালগ সেট করুন। ডায়ালগ লেখার পর সেগুলোকে নিজের মুখে উচ্চারন করুন। কাউকে না পেলে নিজেই একের অধিক ক্যারেক্টার এর ডায়ালগ অভিনয় এর মতো করে উচ্চারন করুন। ডায়ালগ যখন আপনার মুখ হয়ে আপনার কানে প্রবেশ করবে তখন দেখবেন কিছুটা পরিবর্তন করতে হতে পারে। ডায়ালগে মেটাফোর ব্যবহার করুন। ডায়ালগ শর্ট কিন্তু অর্থবহ করুন। মনে রাখবেন, বেহুদা ডায়ালগ দেয়ার চেয়ে ভিজুইয়ালাইজ করে দেখানো উত্তম।
* দর্শকের ইমাজিনেশন নিয়ে খেলুনঃ আপনার স্ক্রিপ্টে সবসময় আপনি দর্শকদের ইমাজিনেইশন নিয়ে খেলবেন। আপনার দর্শকদের সবসময় এমন অবস্থায় রাখার চেষ্টা করুন যেনো তারা বর্তমান সিকোয়েন্স দেখতে দেখতে ভাবতে থাকে - এর পরে কি হবে, এর পরে কি হবে!
* রিভাইজ দিনঃ এমনো হতে পারে, স্ক্রিপ্ট লেখার সময় আটকে গেছেন। কোন কিছু মাথায় আসতেছেনা। বা, গল্প কোথাও শেষ হচ্ছেনা। অথবা, মিলছেনা কোন কিছু।
খেয়াল করে দেখুনতো - কোথাও কি কোন ভুল হলো কিনা! হয়তো পূর্বের কোন সিকোয়েন্সে প্যাঁচ লাগিয়ে বসে আছেন। রিভাইজ দিন; জট খোলার চেষ্টা করুন। ঘটনার প্রবাহ পরিবর্তন করুন। কাহিনী কিছুটা ঘুরিয়ে দেখুন জট খুলছে কিনা।
তাতেও কাজ না হলে স্ক্রিপ্ট ফেলে রাখুন। একেবারে মাথা থেকে দূর করে দিন এটার কথা। নতুন কিছু নিয়ে ভাবুন। অনেকদিন পর আবার এটা নিয়ে বসুন; দেখবেন অনেক অদেখা জিনিস দেখা হয়ে যাচ্ছে।
* স্ট্র্যাকচার নিয়ে খেলুনঃ আমি ধরেই নিয়েছি আপনি জানেন যে একটা স্ক্রিপ্টের ৩টে অংশঃ শুরু, মাঝ ও শেষ। কিছু ব্যাতিক্রম বাদে সকল স্ক্রিপ্টের স্ট্র্যাকচার এরকমই। এখন দেখুনতো, শেষ্টা শুরুতে এনে অথবা মাঝেরটা শুরুতে নিয়ে এসে আপনি স্ক্রিপ্ট দাড় করাতে পারেন কিনা! এরকম অনেক ফিল্ম আছে যেগুলোর শেষটা শুরুতেই দেখিয়ে দেয়া হয়। হতে পারে আপনার স্ক্রিপ্টটা সেরকম। হতে পারে আপনি শুরুর অংশটুকু মাঝে দেখিয়ে শেষেরটুকু শুরুতে দেখালেই আপনার গল্পটা আরো ইন্টেরেস্টিং হবে।
ট্রাই করুন না!
* দর্শককে অ্যাটাচ করুনঃ আপনার কনসেপ্ট টা খুব বেশী জটিল? সাধারন দর্শক বুঝতে পারবেতো? আপনি যদি এমন কোন আইডিয়া নিয়ে ভেবে থাকেন যেটা সবার জন্য না, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি টার্গেট করেন আপামর দর্শক তাহলে আপনার গল্প হতে হবে সহজ ও সাবলীল কিন্তু ইন্টেরেস্টিং। এমন কিছু নিয়ে আসুন যেটা দর্শক নিজেকে গল্পের সাথে রিলেট করতে পারে। দর্শক যেনো ভাবে এটা তার গল্প। অথবা, দর্শক যেনো ভাবে - 'আহা! আমি যদি নায়ক/নায়িকার জায়গায় থাকতাম!'
এই যে দর্শকদের ভেতর এরকম ফিলিংস তৈরী করা - এটাই ট্রিগার।
* ক্যারেক্টারগুলোকে ডেভেলপ করুনঃ শুরতেই মুল ক্যারেকক্টারগুলোর স্বভাব -চরিত্র সহ অন্যান্য বিষয়গুলো নির্ধারন করে ফেলুন। স্ক্রিপ্টের অন্ততঃ একটা অংশে গিয়ে যেনো দর্শক প্রোটাগনিস্টকে বুঝতে পারে। আপনার স্ক্রিপ্টে যেনো প্রোটাগনিস্ট নিজে নিজে ডিসিশন নিতে পারে, স্ট্রাগল করে, এবং অ্যাক্টিভ থাকে। প্রোটাগনিস্ট এর উপর যে কোন উপায়ে ইমোশনাল টাচ দিন। মনে রাখবেন, আপনার প্রোটাগনিস্ট আপনার পেইন্টের মুল সাবজেক্ট, এখন আপনি এটার উপর রঙ চড়াবেন। যে কোন রঙ আপনি ব্যাবহার করতে পারেন কিন্তু পরিমিত রঙ মেশাবেন। অধিক রঙের ফলে আপনার প্রোটাগনিস্ট কে দর্শক গ্রহণ করবেনা এটা ধরে নিতে পারেন।
* এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালুঃ মুভি স্রেফ ৩ চিজো মেই হোতা হ্যায়। এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট। - সবাই মোটামুটি এই ডায়ালগটা জানেন। মোটা হইলেও বিদ্যা বালনরে কিন্তু চরম লাগছিলো। আচ্ছা, অন্য কথায় না যাই এখন। সিরিয়াস পোস্টে পরে পোলাপান লোল ফেলতে শুরু করবে।
তো, এই এন্টারটেইনম্নেট আসলে কি! আপনি একজন স্ক্রিপ্ট্রাইটার হিসেবে দেখবেন আপনার স্ক্রিপ্ট এর এন্টারটেইন ভ্যালু কতখানি। মানে স্ক্রিপ্ট টা কি ইন্টেরেস্টিং? এটা কি আন-প্রেডিক্ট্যাবল যাতে কিনা দর্শক এর শেষ দেখে উঠে? এটা কি এক্সাইটিং? কেউ পড়ার পর কি বলবে - অসাম ম্যান? স্ক্রিপ্টের টুইস্ট টা মারাত্মক? - এসব ব্যাপারগুলো খেয়াল করুন।
* লজিক ঠিক রাখুনঃ আপনার সিকোয়েন্স থেকে সিকোয়েন্সে লজিক যেনো ঠিক থাকে - এটা নিশ্চিত করুন। খুব সহজ ব্যাপার - আপনি চাইলেন আপনার নায়ক যেনো জেল থেকে পালায়। এখন আপনি লিখলেন নায়ক লাথি মেরে সেলের তালা ভেঙ্গে কয়েকজন পুলিশের সাথে ফাইট করে পালিয়ে যাবে। এখন চিন্তা করুন - লাথি মেরে তালা ভাঙ্গা কতখানি লজিক্যাল! দর্শক গাধা হতে পারে, তবে মানুষ হচ্ছে ধীরে ধীরে। আপনি নিজে গাধাই থাকবেন না দয়া করে।
* বর্ননা বিস্তারিত লিখুনঃ আপনার অ্যাকশন লাইন বা বর্ননার প্যারাগুলো এমনভাবে লিখবেন যেনো পাঠক পড়েই বুঝতে পারে কিভাবে কি ঘটছে। (আমি নিজে অ্যাকশন লাইনে খুব বেশী লেখালেখি পছন্দ করিনা কারন আমি নিজের মত করে চিন্তা করে নেই। কিন্তু আপনার উচিত হবে বিস্তারিত লেখা)
ব্লগার অর্জুনের তীর একটা তথ্য যোগ করেছেনঃ প্রিয় হলিউডি সিনেমার স্ক্রিপ্ট ডাউনলোড করে সেটা ভাগ ভাগ করে পড়ে সিনেমাটা রিওয়াইন্ড করে কয়েকবার দেখা যেতে পারে, এতেও একটা মুভি স্ক্রিপ্টের কাঠামো সম্বন্ধে ভালো একটা ধারণা পাওয়া যায়।
উপরে একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করলাম স্ক্রিপ্ট লেখার সময় আপনাকে কি কি ব্যাপার ভাবতে হবে এবং কিভাবে এগুতে হবে। আশা করি হেল্প করবে লেখাটা। প্রচুর লিখতে হবে ভাই, প্রচুর প্রচুর লিখতে হবে। একটা স্ক্রিপ্ট ভাল হয় রিরাইটে।