বাংলাদেশের মেয়েরা মহিলা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিশাল অর্জন। কারন আমাদের দেশে সামাজিকভাবে মেয়েদের ব্যাপারে আমরা এখনও যথেষ্টই "অবিচারকারী।" উদাহরণ দেই। ধরা যাক আমার বাড়িতে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে। নিতান্তই ছোটলোকের খান্দান হলে তখন আমি আমার মেয়েকে এক পিস্ মাংস খেতে দিব, ছেলেকে দুই পিস্। মেয়েকে পানি খেতে দিব ছেলেকে দুধ-ডিম। ছেলেকে উচ্চবেতনে ভাল স্কুলে পড়াবো, মেয়েকে মোটামুটি এভারেজ মানের একটা স্কুলে পড়ালেই চলবে। ছেলেকে ক্রিকেট/ফুটবল কোচিংয়ে নিয়ে যাব, মেয়েটার আরও বেশি প্রতিভা থাকলেও ওকে খুব বেশি হলে গান নাচের স্কুলে নিব।
তারপরেও ধরে নিলাম আমি ভাল শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের যুবক। ছেলে ও মেয়েতে কোন বিভেদ টানিনা। আমি দুইজনকেই সমান খেতে দিয়েছি, সমান পরতে ও পড়তে দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও কিছু ব্যাপারে আমি ঠিকই অবিচার করবো। মেয়ে মাগরেবের নামাজের পরে বাড়িতে ফিরলে ঘরে কেয়ামত নামিয়ে ফেলি, অথচ ছেলে এশার ওয়াক্ত শেষে বাড়িতে ফিরলেও কোমল গলায় বলি, "এত দেরি হলো কেন বাবা?"
সন্ধ্যার পরে কারফিউতো ছেলে মেয়ে দুইজনের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। রাস্তায় বেরোলে দুইজনেরই সমান বিপদে পড়ার কথা। ধরে নিলাম ছেলে আমার শক্ত সমর্থ, ও নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারবে। তাহলে মেয়েকেও শক্ত সমর্থ বানানো কি আমার উচিত না? কারাতে ট্রেনিং সেও নিক। দুই চারটা রাস্তার গুন্ডাকে যেন সে মেরে শুইয়ে দিতে পারে। কারাতে জীবনে অনেক কাজে লাগে। আমার এক কলিগের বৌ কারাতে জানে। ওদের স্বামী স্ত্রীতে জীবনেও ঝগড়া হয়না। কেন হয়না সেটা একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝে নেন।
তো যা বলছিলাম, আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড বা পশ্চিমা দেশগুলো এবং চীন জাপান ইত্যাদিতে স্কুল কলেজে লেখাপড়ার চাইতেও স্পোর্টস, আর্টস ইত্যাদিতে চরম গুরুত্ব দেয়া হয়। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বিভিন্ন খেলাধুলায় হাত পাকায়। সেই সময়েই ওদেরকে ট্যালেন্ট অনুযায়ী আইডেন্টিফাই করে আরও ভাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়, যাতে ওরা ওদের প্রতিভা অনুযায়ী জীবন গড়তে পারে। নাহলে মাত্র আড়াইকোটি জনসংখ্যার অস্ট্রেলিয়া কিভাবে ক্রিকেটে হেক্সাজয়ী হয়? অলিম্পিকেও ওদের এত এত পদক জয়? নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড কারোর জনসংখ্যাই আমাদের এলাকার তুলনায় কিছুই না। তারপরেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে (খেলা হোক বা "দুর্নীতি" ছাড়া অন্য যেকোন ফিল্ডে) ওদের পারফরম্যান্স দেখেন, আমরা ধারে কাছেও না। হ্যা, দুর্নীতিতে আমরা নাইজেরিয়া, গানা ইত্যাদি সহ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশের সাথে টেক্কা দিতে পারি। কিন্তু বিদেশে গেলে এই বাঙালিরাই "সৎ ও পরিশ্রমী" হয়ে যাই! বিদেশে পুলিশ রিপোর্ট দেখেন, আমাদের কোন গ্যাং নাই, মাফিয়া চক্র নাই, পুরাই মশলাহীন ডাল ভাত জাতীয় নিরীহ একটা সম্প্রদায়। আমাদের দেখলে পুলিশ বুকে ধাক্কার মতন খায়না, হাত আপনাতেই পিস্তলে চলে যায়না। আমাদের সর্বোচ্চ দৌড় হচ্ছে মিথ্যা কথা বলে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া ও সরকারি বেনিফিট খাওয়া। মানে হচ্ছে, আমাদের রক্তে দুর্নীতি বা বদমায়েশি নেই, কিন্তু সুযোগ পেলে ছাড়ি না, এই আর কি।
তো যাই হোক, আমাদের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে "আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ!"
তাই আমাদের দেশে মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে, এই ব্যাপারটা আমরা মানতেই পারিনা। এই বিষয়টা মজার, "মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ" দেশে সরকারি অফিসে পিওন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই ঘুষ খায়, বাজারে পণ্যে ভেজাল থেকে শুরু করে সিন্ডিকেটের যন্ত্রনায় পণ্যে হাত দেয়া যায়না - এমন একটা সেক্টর নাই যেখানে দুর্নীতি হয়না, যার কাজ দুর্নীতি দমন, মানে আমাদের পুলিশ বাহিনী, তারই প্রধান আমাদের বেনজির স্যার হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে একদম ফালাফালা করে দিয়েছেন। এমনকি ঘরের কাজের লোকটাকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠালে সেও দুই চার টাকা মেরে দেয়ার ধান্দায় থাকে - ব্যাংক থেকে লোন নিলে ফেরত দেয়ার কথা ভুলে যায়, তা সে যত বড় ইনফ্লুয়েঞ্জার বাপই হোক না কেন - স্কুলে, কলেজে, মাদ্রাসায় শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয় - এতকিছুতে আমাদের ঈমানী চেতনা নষ্ট হয়না, আমাদের ইসলামী বিবেক জাগ্রত হয় শুধুমাত্র মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরে খেলায়।
তো এই বিষয়ে একটা কথা আগেই বলে নেই। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে ইসলাম কি বলে, ইসলামিক নির্দেশনা কি।
আমাদের দেশটা আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্র নয়। আমাদের আইন ব্যবস্থা সেক্যুলার আইন ব্যবস্থা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইসলামিক রাষ্ট্রের খলিফা নন। কথাটা আগেই জানিয়ে রাখলাম, কারন এরপরের কথাগুলি এর উপরই নির্ভরশীল।
একটি আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এর সিটিজেনদের খেয়াল রাখা। যেমন খলিফা আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), উসমান (রাঃ) আলী (রাঃ) প্রমুখদের সময়ে ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে সিটিজেনগন বেতন ভাতা পেতেন। আজও "ইসলামিক রাষ্ট্রের" নিয়ম হচ্ছে যখন কোন নারীর স্বামী মারা যাবেন, তখন তাঁর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া, ইউটিলিটি, সন্তানদের লেখাপড়া ইত্যাদির খরচ ব্যয়ভার "রাষ্ট্র বহন করবে।" যেমন, কিছু আরব দেশ। ওদের সিটিজেনরা জন্মের সাথে সাথেই মিলিওনিয়ার হয়ে যায়। রাষ্ট্র ওদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়, এমনকি বিশ্বের যেকোন দামি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলেও আপনাকে পকেট থেকে একটা পয়সাও খরচ করতে হবেনা। চিকিৎসাও ফ্রি। রাষ্ট্র বলার অধিকার রাখে "হে নারী, তোমার কাজ পর্দা করা, তুমি বাইরে বেরিও না।" কারন সে সেই নারীর সংসার খরচ দিচ্ছে।
আমাদের সমাজে আমরা সেই কাজটা করিনা। হয়তো এককালীন টুকটাক সাহায্য করি, বেশিরভাগ সময়েই "thoughts and prayers" বলি, নাহলে "মানবিক বিয়ের" ধান্দায় থাকি। এমন না যে আমরা গরিব দেশ। আমাদের গত সরকারের নেতা কর্মীরা যে পরিমান টাকা চুরি করেছে, বিদেশে পাচার করেছে, সেটা না করলে বহু বছর আগেই আমাদের দেশ ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত হয়ে যেত। আমার দেশে একটি বিধবা রমণী বাইরে না বেরোলে ওর সন্তানদের পালবে কে?
আমার পয়েন্ট হচ্ছে, ইসলাম কোন নিয়ম জারি করলে অবশ্যই "ব্যালেন্স" করেই সেই নিয়ম জারি করেছে। খোঁজ নেন, দেখবেন আমি কতটা সঠিক বলছি। নারীর সম্পত্তি বন্টনের বিষয়টাই নিতে পারেন। ভাই সম্পত্তিতে ভাগ শুধু শুধু বেশি পায়না, মা বোনের দায়িত্ব পালনেরও নির্দেশ পায়। অথচ আমাদের দেশে আমরা ঐ দায়িত্বটা এভয়েড করে শুধুমাত্র বেনিফিটটাই খাই। "চাকরিতে বেতন নিব, কিন্তু কাজ করবো না" মেন্টালিটি। ইসলাম আপনাকে বেতন দিলে কাজও করার নির্দেশ দিয়েছে। বুঝাতে পেরেছি?
এখন এই যে গরিব মেয়েগুলো, গ্রাম গঞ্জ বা দূর মফস্বল থেকে উঠে এসে, পরিবার, সংসার, সমাজের চরম বাধা উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম অর্জন করেছে, এটি একটি বিশাল অর্জন।
এখন আমি বলতেই পারি, "আমি একজন মুসলিম, এবং
আমার ধর্ম মেয়েদের ফুটবল খেলা সমর্থন করে না।" এবং আমাকে দোষ দেয়ারও কিছু নেই। আমি আসলেই সঠিক।
তবে আমাকে এইটাও দেখতে হবে, ইসলাম কিভাবে একে ব্যালেন্স করেছে। এই দলের প্রতিটা মেয়ে মুসলিম নয়, বিশেষ করে যে মেয়েটা চ্যাম্পিয়ন বানালো, সে একজন চাকমা। একজন অমুসলিমের উপর ইসলামী পর্দাপ্রথা খাটেনা। আরব দেশের বিচে অমুসলিম রমণীরা বিকিনিতে ঘুরে। ইসলাম মেয়েদের পর্দাকে ব্যালেন্স করেছে পুরুষকে কঠিন নির্দেশনা দিয়ে যে চোখ তুলেও তাকাতে পারবো না। মানে হচ্ছে, একটি মেয়ে পর্দা না করলে যে গুনাহ পাচ্ছে, আমি চোখের পর্দা না করার জন্য ঠিক একই পরিমান গুনাহ পাচ্ছি। অথচ আমাদের সেদিকে খেয়ালই নাই। অন্যরা দোযখে চলে যাচ্ছে, এই টেনশনে আমার ঘুম হারাম, আমি নিজে যে ফেঁসে যাচ্ছি, সেই ব্যাপারে পুরোপুরি বেখবর।
এবং তারচেয়েও বড় কথা, ওকে দুই চারটা কথা শোনাবার আগে আমাকে দেখতে হবে, ওর সংসারের কোন ব্যয়টা আমি বহন করছি? ওর পরিবারের জন্য মাসিক বাজার, ইলেকট্রিক বিল, বাচ্চাদের স্কুলের খরচ, চিকিৎসা ইত্যাদির কোনটা আমার পকেট থেকে যায়? তাহলে ও যদি বেশ্যাবৃত্তি না করে, কাউকে খুন না করে, ছিনতাই না করে, চুরি ডাকাতি না করে, কারোর কোন ক্ষতি না করে, জুয়া না খেলে নিজের পরিশ্রমে দুই তিন মাসের বকেয়া বেতন সত্বেও ফুটবল খেলে কিছুটা টাকা আয় করে, তাহলে আমার কটু কথা বলার অধিকার কোত্থেকে আসে?
কিছু বেয়াক্কেল তর্কে আসতে পারে কিন্তু ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাওতো "জুয়া!" এমন মূর্খ, আহাম্মকদের গালি দিলে ফেসবুক আমাকে ব্যান করে দেয়, এমনিতেও রেস্ট্রিকশনের উপর আছি। নিজ দায়িত্বে "জুয়া" কাকে বলে সংজ্ঞা সহ শিখে নিবেন।
বাফুফে ওদেরকে ১ কোটি টাকা পুরস্কার দিয়েছে, বিসিবি ২০ লাখ। আরও অনেক সংস্থা অনেক টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবে। খুবই উত্তম। কিন্তু উনারা সবাই আসেন সাফল্যের পর। তা ওদের ট্রেনিং পিরিয়ডেও যদি কেউ কেউ এগিয়ে আসেন, বিশেষ করে একদম অংকুর অবস্থায়, তাহলে সাফল্যের পরিমান আরও বাড়বে বলে আশা করি। কারন টাকার প্ৰয়োজন তখনই বেশি হয়।
আমাদের দেশের জনসংখ্যা আঠারো কোটি, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় নয়গুন। আমরা যদি অস্ট্রেলিয়ার মতন ফ্যাসিলিটিজ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে গাণিতিক হিসাবে আমাদের ৫৪ বার পুরুষ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার কথা।