ছোটবেলায় মহাত্মা গান্ধীর জীবনীর একটা শিশুতোষ সংস্করণ কীভাবে যেন পড়তে হয়েছিল। হিন্দুঘরের ছেলে হিসেবে বিবেকানন্দ কিংবা গীতাও বাদ যায়নি। নিশ্চয়ই আশা করা গিয়েছিল যে এসব সেবন/চর্চার মাধ্যমে আমি অহিংস হয়ে উঠব। বয়স যতই যায়, আমি চিনচিন করে পেটে যে ব্যথাটা অনুভব করি সেটা, অচিরেই আবিষ্কার করি, সেটা হয়তো হিংসাই হবে। গান্ধী, গীতা, বিবেকানন্দ কিছুতেই কাজ হলো না। আবার হিংসা যে অমহৎ সেই জ্ঞানও টনটনে। ফলে সেটা মুকাবিলার কসরৎও পেটের মধ্যে চলতে থাকে। পেট, ফলে, জটিল এক রান্নাঘর হয়ে উঠল।
কিন্তু তারপরও এই মন্তব্য আমি হিংসাবশতঃ করছি না। সামহোয়েরইনব্লগ-এর সতীর্থরা যে উঠেপড়ে টপটেন মার্কা একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করছেন তাতে আমার কিছুতেই শান্তি লাগছে না। এই লেখা রচনার আগে আমি দেখে নিয়েছি যে আমার কোনো "রচনা" মনোনীত হয়েছে কিনা। না-হলে হিংসার থিয়োরী অনুযায়ী বোঝা যেত সহজে। কিন্তু লক্ষ্য করা গেল দুটো গল্প আমার মনোনীত হয়ে আছে ৪২৬টা রচনার মধ্যে। এমনও ভাবা যেতে পারত যে আমার দুটো না হয়ে ২২টা হয়নি বলেই আমার হিংসা। কিন্তু আসলেই হিংসাজনিত কর্মকাণ্ড এটা নয় আমার তরফে। ব্লগে বিস্কুট দৌড় না-টেনে আনাটা সকলের জন্যই জরুরি কাজ ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই মহারোগটা একজন দু'জনের নয়; বেশ মহামারী আকারেই বিদ্যমান। কৌশিক ৫০০০ টাকা গাঁট থেকে খরচ করছেন বলে তাঁকেই প্রকট ভাবার পক্ষপাতী আমি নই।
আমার মনে পড়ে, ব্লগের "সাহিত্য" প্রিন্টবন্দি করবার উদ্যোগেই আমি খুব খুশি ছিলাম না। কিন্তু পয়লা যখন এর মুখোমুখি হই আমি তখনও নিজে ব্লগার নই। এর বিপক্ষে বলা অনধিকার চর্চা হতে বাধ্য ছিল। কিন্তু এখন নিজে একজন ব্লগার হিসেবে, তাও ৪২৬টা মনোনয়নের ২টার মালিক, কথা কওয়ার একটা হক ধরে নিয়েছি।
ব্লগের স্বাধীনতা নিয়ে আমার কখনোই উচ্চকিত ভক্তিভাব ছিল না। ছিল না, কারণ এর অদৃশ্য মালিকানা নিয়ে আমি ভুলভুলানির খেলায় থাকি না। মালিক অদৃশ্য থাকলেও মালিক থাকেন, এই সাধারণ হুঁশবুদ্ধিটা আমার ছিল। ধরেই নিচ্ছি অন্য অনেকেরই তা আছে, ও ছিল। কিন্তু চতুষ্পার্শ্বে ব্লগীয় বাকুম বাকুমে সেইটা প্রায়শই উহ্য হয়ে যায়। ফলে নিজের ঈমান শক্ত রেখে আমি মনে রেখে চলেছিলাম আমি ইয়াহুর "স্বাধীন" প্রজা; ফেসবুকের "সার্বভৌম" রঙ্গিলা প্রজা; সামহোয়ের-এর "সৃজনশীল" প্রজা ইত্যাদি।
এরপরও ব্লগের যে জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ তাহলো "সম্পাদকীয়" এখতিয়ারের নামে এখানে কর্তন/ছেদন প্রক্রিয়াটা মুদ্রণ-স্থাপনার মতো নয়। এখানে স্বজনতোষণ আছে, দলাদলি আছে, আরও আছে গালাগালি। কিন্তু সাহিত্য/বুদ্ধিজীবিতার নামে এখানে অনায়াসে কাউকে খারিজ করে দেয়ার সুযোগ কম। কিংবা সুযোগ থাকলেও একটা হালফিল চর্চা হিসেবে এটা জারি নেই। ব্লগের এই চরিত্রটার জন্য নয়া সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে ব্লগের গুরুত্ব স্বতন্ত্র। কিন্তু এটা তো বিধাতার রাজ্য না যে আপনা-আপনি এরকম চলতেই থাকবে। ব্লগের শক্তিমত্তার জায়গাগুলো উদ্ঘাটন ও জারি রাখতে চাইলে এর ব্যবহারকারীদের দায়দায়িত্বও নিতে হবে।
আমার মনে হয় এই বিস্কুট দৌড়ের মতো মুদ্রণ-স্থাপনার প্রতিষ্ঠিত চর্চাগুলো এখানে আমদানি করতে শুরু করে ব্লগের শক্তিমত্তার জায়গাগুলো খর্ব করতে বসেছেন সতীর্থরা। কোনো উদ্যোগের নিন্দা করলে লিবেরেল চিত্ত হা রে রে রে করে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে বসে। সেটা করতে গিয়ে ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি খুব দৈনন্দিন ব্যাপার। ফলে আমার ধারণা টপ-টেন ধরনের এই প্রতিযোগিতার আয়োজকেরা গোস্বা করবেন আমার উপর। কিন্তু আমি নিশ্চিত আছি, আপনাদের দোয়ায়, কী বিষয়ে আমি কথা বলছি।