রাজার সঙ্গে রানীর সম্পর্ক নিয়ে কানার সঙ্গে কানির একটা গন্ডগোল লেগে যায়। উত্তাল সমুদ্রের মাতাল ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তারা ভাবে, আমরা তো চাইলে আকাশে উড়ে যেতে পারি। ঐ বিশাল জলরাশির উপর দিয়ে ঘুরেও আসতে পাড়ি, দেখে আসতে পারি শহর বন্দর নদী নালা গ্রাম। তখন কানির মনে হয় আমি আসলে একটা ঘুড়ি। বানরের লেজের মতই আমার বুকের মধ্যে একটা সুতা লাগানো আছে। সুতা টান দেয়ার লোক আছে। লোকের নাম ঈশ্বর। সে আমাকে দয়া করে পাঠিয়েছে। নাটাই ঘুরাতে শুরু করলেই আমাকে তার হাতে গিয়ে পৌছাতে হবে। আর কানার মনে হয় আমি আসলে একজন রাজা। আমার রাজ্যে অনেক পাখি আছে, তাদের রং লাল। তারা আকাশে উড়ে যেতে পারে, আবার জলেও সাতার দিতে পারে। তারা রাজপ্রসাদের কার্নিশের উপর হাগতেও পারে।
যে সম্পর্কটা নিয়ে তারা আলোচনা করছিল, তা রাজার সঙ্গে রানীর। রাজা কাঞ্চনের ছোট ভাই আর রানী কান্তার ছোট বোন। অর্থাৎ তাদের আলোচনার ব্যক্তি দুজন বেয়াই আর বেয়াইন। রানীর কিছু সমস্যা আছে। সে সমস্যা সমাধানের ডাক্তার কর্তৃক নির্দেশীত পথের সন্ধানেই তাদের এতো দূর আসা। রানী থাকতো তাদের গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। একদিন দুপুর বেলা হঠাৎ তার মন উদাস হয়। এবং সে পিঠের চুল আকাশে উড়িয়ে বাঁশঝাড় পিছনে ফেলে সামনে হাঁটে। সে কেবল সামনেই হাঁটে। তার স্তন গুলি দুলতে থাকে, তার শরীরটা থেকে ঘ্রাণ বের হয়। সামনের বড় বড় নালা, খাল বিল কাঁটাঝোপ সে হয়ত লাফিয়েই পার হয়। সবাই বলে তার নাকি পাখা গজিয়ে ছিল, সে নাকি চোখে মুখে সব রঙিন দেখেছিল। কেননা এর পর রানীকে আর সাত আট দিন গ্রামে দেখা যায় না। তার বাবা মা খোঁজা খুঁজি করে না তারা দম খিচ্চা থাকে। তারা শেষ কয়েক দিন বাড়িতে পান তামাক নিষিদ্ধ করেই বিষয়টা সমাধান করতে চায়। রানীর মা কান্না করে না। কিন্তু পোটলায় বাঁধা পানির মতোই তার ভেতর থেকে জল বের হয়। সে রাত দিন ভুলে গিয়ে কেবল চোখের জল ফেলে। শেষে রানীর বাবা তাকে একদিন রাতে ধমক দেয়। হয়ত বা একটু আধ একটু মারেও। রানীর বাবা হয়ত তার গলা টিপে ধরে। তার পেট নিয়া আজেবাজে কথা কয়। মেয়েকে না পেয়ে রাতের অন্ধকারে হয়ত তাকেই খুন করতে চায়। কেননা রাতের বেলা সে কলার বাকলের মত চকির বাইরে পরে থাকে। সে গভীর রাতের দিকে ইনিয়ে বিনিয়ে আবার কাঁন্দে। কোন কোন রাতে তাকেও দেখা যায় আঁচল মাটিতে লুটিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে যাচ্ছে। তখন রানীর বাবাকে দেখা যায় দুটি রক্তচক্ষু হাতে নিয়ে তার পেছনে পেছনে আসে। কোন কোন রাতে সে হয়ত আবারও তাকে কঞ্চি দিয়ে পেটায়। অথবা বউকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে। তারপর তারা বড় বড় দুটি রাজহাঁস হয়। তারা জলকেলি করে। চাঁদের আলোয় সেই দৃশ্য দেখে কড়াইয়ের ডালে বসে থাকা একটা পেঁচা চিতল মাছ ধরার জন্য ঝপ্পর করে পুকুরের মধ্যে পড়ে। এবং উড়ে যাওয়ার সময় সে একটা ইগল হয়ে যায়। কিন্তু সমস্ত ঘটনাগুলো তারা বাড়ির মধ্যেই রাখে। তারা ভাবে যে কাক পক্ষিও কিছুই জানে না। তারা ধুঁয়ো ছড়ানোর চেষ্টা করে যে মেয়ে তাদের খালার বাড়ি গেছে। কখনও বলে বোনের কাছে গেছে। কখনও বলে মারা গেছে। যদিও তারা খালার বাড়িটাই ইস্টাবলিষ্ট করতে চায়। কিন্তু ইস্টাবলিষ্ট ব্যক্তির মনের দূর্বলতার মতই বাকি কয়েকটি মিশ্র খবরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সোনা ডাঙা গ্রামবাসী সন্দেহ প্রবণ হয়ে ওঠে। ফলে তারা জানতে চায়। তারা কঠিন ভাবে প্রশ্ন করে। তারা চক্ষু লাল করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে একেক জন একেক সময় রানীর বাবা মায়ের সামনে দাঁড়ায়। তখন রানীর বাবা মায়ের মনে হয় মেয়েটা তাদের না, মেয়েটা গ্রামবাসীর। তারা পালক পিতা মাতা। তারা মেয়েটাকে হয় তো চুরি করে ছিল। তখন ১২ রাত তারা কাঁন্দে। তারা চুলার মধ্যে জল ঢেলে ক্ষুধার্ত পেটে নির্ঘুম জেগে থাকে। তাদের চারটি চোখ আগুনের মতই জ্বলজ্বল করে।
এই যখন অবস্থা, তখন রানীকে একদিন হঠাৎ ভূতের মতোই তাদের বাঁশঝাড় থেকে উঠে আসতে দেখা যায়। তার জামা কাপড় ছেঁড়া। তার গাল গুলো তোবরানো। পা দুটি আগের চেয়ে ঢেঙ্গা । যেন সে একটা বক। যেন তার উপর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে গেছে। যেন তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। যেন সে নিজেকে অন্য কোথাও ফেলে এসেছে। রানীর বাবা শহিদউল্লা দুপুরের খাওয়া শেষে পিসাব করতে গিয়ে একটা স্বর্ণের গোলার মতই তাকে আবিষ্কার করে। এবং বুঝতে পারে এ ধন, তার সইবে না, এ ধন তার জন্য কাল হবে। তবুও হয়ত লোভ সামলাতে না পেড়েই সে তাকে সেই মানিকের মতই জড়িয়ে ধরে। আর কাঁন্দে আর চুমোয় চুমোয় রানিকে আরও স্তব্দ করে দিয়ে নিষিদ্ধ মালের মতই ঘরে নিয়ে আসে। তারপর তারা চেষ্টা করে লাঙল দিতে গিয়ে কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া কৃষকের মতই রাষ্ট্রের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে রানীকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু তারা সফল হয় না, তারা ব্যর্থও হয় না। তারা পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারে না । তারা আবারও অনেক জটিল প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। তারা বলে যে মেয়েটাকে পরী নিয়ে ছিল। পরীর দেশ ভ্রমন শেষে সে ফিরে এসেছে। সে গ্রামের মঙ্গল করবে, সে গ্রামের সম্পদ স্বরূপ। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই রানীর পেটটা যখন জোয়ারে ফুলে ওঠা নদীর মত বাচ্চাদের হাতে ফুলে ওঠা কন্ডমের মত বড় হতে থাকে, তখন তারা আর বিষয়টা লুকাতে পারে না। তারা আর বিষয়টা জানাতে পারেনা। তারা আর বিষয়টা সামাল দিতেও পারে না। ফলে তারা কাঁন্দে মেয়ের গলা জরিয়ে তারা স্বামী স্ত্রী কাঁদতে বাধ্য হয়। এবং নিরূপায় হয়ে বড় মেয়ে কান্তাকে ফোন করে।
ফলত বিষয়টা কাঞ্চন মানতে নারাজ। সে বলে পুরুষের প্রতি তো তার একটা ভীতি একটা বিদ্দেশ আসার কথা।
তোমার কেন মনে হচ্ছে ঘৃণা আসবে?
কেন নয়, আমি যতদূর জানি এভার্যাশন তো একটা ভয়ানক বিকল্প। এর শারীরিক মানসিক সুদূর প্রসারী প্রভাব আছে। তুমি জানো উন্নত কান্টিরির সচেতন মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এভার্যাশন করায় না। এমন পরিস্থিতিতে হয় তারা বাচ্চা কে মেনে নেয় নয় তো প্রসব হওয়ার পর তাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে।
ভয়ানক নয় সে কথা তো বলছি না কিন্তু ব্যক্তির তো এমন একটা ফিলিংও হতে পারে যে আমার কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না।
কিন্তু নেড়া বেল তলায় একবার যায়, কান্তা।
কান্তা চুপ করে থাকে। সে কিছু বলে না, শুধু বাতাস তার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। তার পর সে উঠে দাঁড়ায় পা দিয়ে বালিতে একটা গর্ত করে। আঁচলটা টান দিয়ে বলে কিন্তু মেয়েটির তো মনে হতে পারে এখন আর আমাকে কেউ পছন্দ করবে না। কেন না তুমি তো জান। এর ফলে কামের সেই ফিলিংটা ব্যক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। অনেক মেয়ে তো বন্ধাও হয়ে যায়।
তা তো হয়। কিন্তু মৃত্যুর আশঙ্কা আছে জেনে দ্বিতীয়বার গর্তে প্রবেশ করাটা কেমন না। আমার তো মনে হয় সে একটা প্রবল ঘৃণা একটা প্রতিশোধ প্রবণতা কাজ করে। সক খাওয়ার পর ইলেকট্রিসিটির প্রতি মানুষের ভীতি ভারে কান্তা। আমাকে ভুল বুঝনা, আমি ভয় পাচ্ছি। একজন সচেতন বড় ভাই হিসেবে আমি রাজাকে রানীর সঙ্গে মিশতে দিতে পারি না।
কান্তা করুণ চোখে কাঞ্চনের দিকে তাকায়। এবং তাকিয়েই থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখে জল আসে। তার মুখ শক্ত হয়। আঁচলটা বুকের উপর আরও একটু চেপে ধরে সে বলে তোমরা পুরুষরা কোন দিন বুঝবে না তোমরা বুঝতে পারবে না। তারপর সে মাথা উচু করে উল্টো দিকে হাঁটা দেয়।
ফলে কাঞ্চন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকবার চেষ্টা করে সিগারেট ধরায়। বীচ চেয়ারের উপর গিয়ে কিছুক্ষণ বসে। সমুদ্র এতো নীল যেন নিচেও আরেকটা আকাশ। যেন তা রূপার তৈরী কোন বাটি। যেন তা কোন দূর মহা লোক থেকে ফেলে দেয়া ঝর্নার ধারা। সে আবার পায়ে পায়ে কান্তার দিকে এগিয়ে যায়। কান্তার আঁচল একটা পাখির পালকের মতই তার দেহে ধাক্কা খায়। সে কান্তার হাত ধরে। তারা হাসে না । তারা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের মনে হয় তারা দুটি পাখি। কানা আর কানির মনের ভেতর আকাশ মোচর দিয়ে ওঠে। তারা পাখি হয়ে যায়। তারা জলে ঝাপিয়ে পড়ে। তারা দুটি সামুদ্রিক হাঁসের মতই বাসতে থাকে। তারা মনে হয় এভাবেই ভাসতে থাকবে অনন্তকাল।
কিন্তু তারা ওঠে। করা নোনাজল হয়ত তাদের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলোকে কামড় দেয়। কিংবা তাদের শীত শীত লাগে। কিংবা তারা হয়ত কিছু একটা ভাবে, যে ভাবনা প্রকাশের জন্য স্থল ভাগ প্রয়োজন । কিংবা হয়ত মাটির জন্য তাদের মন বেকুল হয়ে ওঠে। ফলে তারা আর জলে থাকতে না পেরেই হয়ত বীচ চেয়ারগুলোতে বসে। আকাশে রোদ থাকে কিন্তু সে রোদ বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশি কিছু করতে পারে না। কান্তা আকাশের দিকে তাকায়, তার মন বুঝি দৃষ্টির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঐ দূরের মেঘের সঙ্গে একটা পেরেকের মতই বিধে যায়। আর সে মেঘ তাকে একটা গুনা টানা নৌকার মতই টানে। কান্তা বেশে চলে। সে কিছুটা কালো হয়েও ওঠে। আর একটা বিমান এসে তাকে এফোর ওফোর করে চলে যায়। ফলে তার চোখ বেয়ে ভেজা শাড়ির আঁচলের মতই জল ঝড়ে। সে জলে পতনের শব্দ হয় না, কিন্তু ক্ষরণ চলতে থাকে। আর চাল থেকে গড়িয়ে পড়া জলের মতই বুঝি তার মনের ভেতরে একটা গর্ত হয়। গর্তের ভেতর পোকা মাকর হয়ত জমে ওঠে। সেই পোকা মাকড় গুলো সমুদ্রের পারে আটকে থাকা সামুদ্রিক ঝিনুক গুলোর মত মনের পারে আটকে থাকে। তারা আঠার মতই আটকে যায়। যেন ছুরি দিয়ে কেটেও তাদের সরানো যাবে না। কাঞ্চন বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে শেষে নিরবতা ভেঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্যেই হয়ত বলে। রানীকে তুমি বাড়ি পাঠিয়ে দেও কান্তা।
কেন?
আমি আর কতদূর করতে পারি বল। আমার শ্রম, আমার অর্থের উপর দিয়ে যাক সেটি কোন প্রভলেম নয়, আমার ভাইকে তো আর আমি বলি দিতে পারি না বল। তাছাড়া ওরা এখন যে ভাবে মিশছে। আমাকে ভুল বুঝ না। আমার হাইপোথিসিস বলছে । যে কোন মুহূর্তে আবার একটা এ্যাকসিডেন্ট ঘটবে।
কিন্তু গ্রামের লোকদের তুমি চেন না কাঞ্চন। সেখানে ফিরে গেলে রানী আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।
ছয় মাস হয়ে গেছে আমার বিশ্বাস এখন তারা সব ভুলে গছে।
না, তারা একটা ঢেকুর তুললেই আবার সব মনে করতে পারবে। আর ঐ সমাজটা আর কিছুতেই রানীকে কোন দিন স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেবে না
তবে ওদের এই মেলা মেশা তুমি ঠেকাও
তা কি করে সম্ভব !
কাঞ্চন এ বার ক্ষেপে ওঠে । তা হলে তুমি আমাকে একটা পরামর্শ দেও, এখন আমার কি করা উচিৎ ?
কান্তা কিছুই বলে না। সে আবার উঠে দাঁড়ায়। পাড়ের ঢেউগুলো দিকে দেখে। একটা কাক কি করে প্রবল বাতাসের মধ্যেও একটা মরা মাছ খুটে খুটে খায়, সেটা দেখার জন্যই যেন তার দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা না হতেই একটা মাতাল বোধ হয় তাকে অতিক্রম করে যায়। হোটেলে তাদের পাশের রুমে ওঠা ভোটকা ভাবিকে আসতে দেখা যায়। কান্তা এগিয়ে যায় সূর্য যে দিকে ডুবে যাচ্ছে সেই দিকে। তার মনে হয় সেও যদি এমন লাল হয়ে ডুবে যেতে পারতো। তার মনে হয় সেই রানী। তাকেই যেন কিছু লোক ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে । তারই যেন নারি ভুরি ছিড়ে একটা তিন মাসের বাচ্ছা বের করা হয়েছে। কান্তার কেমন যেন বমি বমি লাগে। তার গলা শুকিয়ে আসে। সে চোখে যেন কেমন অন্ধকার দেখে, অথবা চোখ তার ঠিকই আছে, সূর্য ডুবে যাওয়ার কারণে এমনি বুঝি সব অন্ধকার লাগে। হঠাৎ তার খুব কাছে তার চুলের কাছে, তার ঘাড়ের কাছেই যেন সে কারো নিঃশ্বাস টের পায়। সে পিছনে দিকে তাকায়। কিন্তু পিছনে অনেক দূর পর্যন্ত কাউকে দেখা যায় না। কান্তার গা ছমছম করে ওঠে । তার শরীর ভারি হয়ে আসে। সে উল্টা দিকে হাঁটা দেয়। এখনও চাঁদ ওঠেনি তবু বেশ আলো আছে বালুর জমিনের উপর। কোথাও একটা পুরুষ কণ্ঠ আঞ্চলিক ভাষার কোন করুণ সুরে গান গেয়ে ওঠে। গানটা তার দিকে যতো এগিয়ে আসতে থাকে কান্তার পায়ের জোর ততই ভারে।
৩০/৪/২০১০
(অপ্রকাশিত)