ক্ষেতের আইল ধরে মফিজ মিয়া দৌড় হাটা দেয়। রাত বারোটার মেইল ট্রেইন আসতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।
রাত বারোটার মেইল ট্রেইন আর তার জীবন যেন একই সুত্রে বাধা হয়ে গেছে। রেললাইনের দুই পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিটেগুলোর একটিতে মফিজের বাস। দিনে কিংবা রাতে যখনই ট্রেইনগুলো দৌড়ায় ঘরবাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে কাপিয়ে দিয়ে যায় আশেপাশের ঘরবাড়ি আর মানুষগুলোকেও।
বছর তিনেক আগে একমাত্র মেয়েটির বিয়ে দেয় মফিজ মিয়া। দুইমাইল দুরের সবচাইতে কাছের স্টেশনটিতে মেইল ট্রেইনগুলোই কেবল যাত্রা বিরতি দেয়। রাতের বারোটার মেইল ট্রেইনে বরযাত্রি সহ মেয়েকে তুলে দিতে গিয়ে অঝোরে কেদেছিল মফিজ মিয়া। মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে ধার করজ করে নিকট আত্মিয় করিমের কাছ থেকে। করিম থাকে দশমাইল দুরের জেলা শহরে। প্রতি মাসের শেষের দিকে মফিজের কাছে আসে সুদের টাকা নিতে। আসে রাত বারোটার ট্রেইনে। সুদের টাকা আদায় করে পরের দিন সকালে রওয়ানা দেয় নিজ ঠিকানায়। প্রতিবারই ট্রেন যখন তার বাড়ি পাড়ি দিয়ে উজানের স্টেশনের দিকে দৌড়ায়, মফিজ মিয়া শংকিত মনে প্রহর গুনে করিমের। সুদের টাকা গুনতে গিয়ে এ কয় বছরে জমিজমাসহ সবই হারিয়েছে মফিজ মিয়া পৈত্রিক ভিটেটা শুধু বাকি। গতকয় কিস্তির সুদের টাকা পরিশোধ হয়নি।
করিমের গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে বৌ বেড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে পালিয়েছে মেয়ের আশ্রয়ে। সবমিলিয়ে হাপিয়ে উঠেছে মফিজ মিয়া। আজ আবার করিম আসবে সুদের টাকার তাগিদ দিতে। সেই রাত বারোটার মেইল ট্রেইনে।
সন্ধ্যা থেকেই অসহনীয় এই মনের জ্বালা থেকে পরিত্রানের ঊপায় খুজে বেরাচ্ছিল মফিজ মিয়া। করিমের কাছে তার অসহায় অবস্থানের অনুভুতিটি ক্রমেই চেপে বসেছিল তার মাথায়। কারো কাছ থেকে একটুখানি সাহায্যের আশায় মনটা তার বেপড়োয়া হয়ে উঠেছিল ক্রমশঃই। যতই সময় গড়াতে থাকে ততই মরিয়া হয়ে উঠে মফিজ মিয়া। একসয় আবার হতাশায় নেতিয়ে পড়ে, অবসাদে ভেংগে আসে দেহমন।
রাত বারোটার দিকে উঠোনের এককোনায় এসে বসে। তাকায় রাতের আকাশের দিকে। তারা ঝলমল আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু মনে পড়ে মফিজ মিয়ার। মা কিংবা বাবার কোলে বসে এমনি কাটিয়ে দেয়া রাতের অনেক প্রহরের কথা।
রাত বারোটার মেইল ট্রেইন আসতে যখন আর খুব একটা দেরি নেই, তখনই সিদ্ধান্ত নেয় মফিজ মিয়া। পরিত্রানের উপায় খুজে পায়।
দৌড়াতে দৌড়াতে রেলের ব্রিজের গোড়ায় এসে পৌছায় মফিজ মিয়া।
তারপর অপেক্ষার প্রহর গুনে ট্রেন আসার।
ঘন্টা পেরোয় ট্রেন আসেনা। মফিজ ভাবে ট্রেন লেট। কিন্তু দুঘন্টাতেও তিন ঘন্টাতেও ট্রেন আসেনা। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ঘুমে চোখ বুজে আসতে তার। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকে মফিজ মিয়া। কিন্তু সেই রাতে আর আসা হয়না রাত বারোটার মেইল ট্রেইনের।
একসময় ভোরের আজানে ধরফরিয়ে জেগে উঠে মফিজ মিয়া।
ভোরের সতেজ আলো বাতাসে মফিজ মিয়ার দেহমনও শুদ্ধ হতে থাকে।
সিদ্ধান্ত পালটায় সে। হাটা ধরে নিজের ভিটের দিকে।
এর পরের দিনে সারা এলাকায় রাস্ট্র হয়ে যায় রাত বারোটার মেইল ট্রেইন তিন চার মাইল ভাটিতে এক ভয়াবহ দুরঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষও মরেছে ম্যালা। মফিজ মিয়া তখনো জানেনা, মারা পড়া মানুষদের মধ্যে করিম মিয়াও একজন