আপনি কবি হিসেবে ৭০ বছরের বেশি বয়স অতিবাহিত করেছেন। দীর্ঘ কবি জীবন আসলে কেমন?
আমার ধারণা, আমার নিজের কথা বলতে পারি। দীর্ঘ জীবন তো এমনি অতিবাহিত হয়নি। অনেক কষ্ট, অনেক দারিদ্র্য, অনেক দুঃখ, আবার সুখও। জেল-জুলুম। কিছু লোক আছে, যে কবিদের প্রতারণা করে সুখ পায়। এসব প্রতারণার শিকার হয়েছি। মোটামুটি একটা জীবন কাটিয়েছি।
কবি জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বলতা কোথায়?
আমার মনে হয় যে, লিখতে পারায়।
লিখতে পারার মধ্যেই কবি জীবনের সবচেয়ে বড় উজ্জ্বলতা। আবার যদি সবচেয়ে বড় গ্লানির কথা বলি, সে গ্লানিটা কোথায়?
গ্লানিটা হলো লিখতে না পারায়। একজন কবি লিখতে পারছেন না, এটাই তার জন্য চরম অসুবিধার। অনেকে জীবিত আছেন কিন্তু আর লিখতে পারছেন না। এটা গ্লানিকর। দুই নাম্বার কথা হলো, আমার মতো যারা দীর্ঘ জীবন পার হয়ে এসেছেন তাদের শারীরিক নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়। যেমন আমার চোখ নেই, অস্পষ্ট দেখি। দেখতে না পারা হলো বিরাট একটা অভিশাপ। আগে প্রতিটি জিনিস খুটিয়ে দেখেছি। খুটিয়ে দেখেছি, খুটিয়ে পড়েছি। এখন তো সেটা আর পারছি না। এক সময় ছিল যে, সারাটা বাংলাদেশ আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। একটা ঝোলা কাধে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছি, নৌকায় নদীতে। মানুষের সঙ্গে। কতো জেলে, কতো ধীবর, কতো যাযাবর, কতো বেদেনি। এ জীবনের যতো বৈচিত্র্য এটা তো আমি ঠিকমতো গ্রহণ করেছি এবং সেটা ব্যক্তও করেছি। আমার লেখায় তা আছে। হয় গল্পে আছে, কবিতায় আছে, নয় তো উপন্যাসে আছে। আছে।
জীবনের পরিণত পর্বে এসে মানুষের মধ্যে এমন কিছু উপলদ্ধি হয় যা অসাধারণ, অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে উপলব্ধিটা হয়েছিল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। সভ্যতা সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে। মানুষের উত্থান-পতন সম্পর্কে। একজন কবি হিসেবে আপনি যখন জীবনের পূর্ব প্রান্তের দিকে তাকান তখন কি উপলব্ধি হয়?
আমি রবীন্দ্রনাথ খুব উত্তম রূপে পড়েছি। ভাসা ভাসা না। থরোলি পাঠ করেছি। রবীন্দ্রনাথের সব ঠিক আছে, সব অসাধারণ। কিন্তু শেষ বয়সে এসে তিনি জবাব খুজতে গিয়ে বলেছেন, প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল, কে তুমি? তারপর শেষ দিনের অস্তাচলগামী সূর্য প্রশ্ন করেছে, কে তুমি? কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। রবীন্দ্রনাথ এ বেদনাটা উপলব্ধি করেছিলেন। এ বেদনাটা আমার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। কারণ প্রথম দিনের সূর্যকে আমি যখন প্রশ্ন করছি তখন এটা জেনেই করেছি যে, উত্তর আমাকে খুজতে হবে। উত্তর আমাকেই বের করতে হবে। সূর্যটা কোনো উত্তর দেবে না।
সে উত্তর কি পেয়েছেন?
আমি তো সব জায়গা দেখতে পাই। একটা কবিতা আছে না, কবির নাম আমার ঠিক মনে নেই, আছো অনলে অনীলে/ চির নভোনীলে/ভূদরে সলীলে গহনে/ আছো বিটপীলতায় জলদের গায়/ শশী তারকায় তপনে। আমি নয়নে বসনও বাধিয়া/ আধারে মরিব কাদিয়া/ দেখি নাই কিছু, শুনি নাই কিছু/ দাও হে দেখায়ে..। আমার বিশ্বাসটা খুব দৃঢ়। আমি সব জায়গা দেখি, বুঝতে পারি। সর্বত্র একটা অস্তিত্ব আমি দেখতে পাই। একজন যদি চায়, আবিষ্কার করবে তাহলে সে সেটা পেয়ে যায়। আমি পাই, স্পর্শটা বুঝি, অনুভব করি।
জীবন পর্বের কোন সময়টাকে আপনার সবচেয়ে আনন্দময় মনে হয়েছে?
সেটা তো মনে করতে পারছি না। তবে কিছু সুখ হয়। যেটা খুব দুর্লভ। যখন কোনো লেখা শেষ করি। সেটা যখন ছাপা হয়। নানা টেলিফোন আসতে থাকে। অজ্ঞাত, অপরিচিত লোকেরা এসে বাসায় দেখা করতে চায়। তখন ভালো লাগে বেশ। বুঝি এখনো টানার, মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা আমার মধ্যে রয়ে গেছে।
সেটা তো আপনার লেখায় সব সময়ই আছে। সোনালি কাবিনের আমি অনুরক্ত। সোনালি কাবিনের কবিতাগুলোর অনেক বছর পর সে কবিতার অনুরণন পেলাম দ্বিতীয় ভাঙনে এসে। সনেট পঞ্চকে। বহুদিন পর এটা ফিরে এলো কিভাবে?
এটার তো কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। যতোদিন চোখ সচল ছিল, দেখতে পেয়েছি, ততোদিন নানা ছন্দ চিন্তা হয়েছে। নানা বিষয়ে নানা ইমেজারি কাজ করেছে। কবিতার ব্যাপারে কখন যে কি ঘটে যায়, সেটা অনেক সময় কবিও জানে না। সোনালি কাবিন যখন আমি লিখি তখন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। অভাব-দারিদ্র্যের মধ্যেই ছিলাম। গোর্খা ডাক্তার লেন বলে জেলেপাড়ার দিকে একটা জায়গা আছে, সেখানে থাকতাম। ইকবাল ম্যানসন বলে একটা বিল্ডিংয়ের চারতলায় থাকতাম। আমার পাশে থাকতেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। চট্টগ্রামের লোকগায়ক। হঠাৎ সোনালি কাবিন লিখি সে সময়। হয়তো একটা মেয়েকে দেখেই লিখেছি বা তাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছি। কিন্তু সেটা তো বড় কথা নয়। কোনো বিশেষ নারী এটার জন্য বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এই ছন্দভঙ্গিটা। একটানে ১৪টা সনেটে এসে আমি শেষ করে দিলাম। এগুলো আকস্মিক ঘটনা। অনেক সময় বলে না যে, কবিরা বিশেষ কোনো ভরের থেকে এই কাজটা করে। এ রকমই মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু, ভর তো না, নিশ্চয় আমার ভেতর প্রস্তুতিটা ছিল। গবেষণাটা ছিল। লেখাপড়া না জানলে, ইতিহাস না জানলে এটা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের আদি ইতিহাস সম্পর্কে আমার বেশ উৎসাহ ছিল, পড়াশোনা ছিল। বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ নিয়ে আমার দারুণ আগ্রহ ছিল। যখন ছোট ছিলাম তখন আমি একজন আর্কিওলজিস্ট হতে চেয়েছিলাম। প্রত্নতাত্ত্বিক হতে চেয়েছিলাম, হয়েছি কবি। এ জন্য এ বিষয়টা আমার কাব্যে খুব এসেছে।
সনেট পঞ্চকের সময় কি ঘটেছিল?
সনেট পঞ্চক তো অ্যাকচুয়ালি ঐতিহ্যবাহী কবিতা। খনা একজন প্রাচীন কবি। আমাদের দেশে জন্মেছিলেন। বলা হয় যে, তিনি বাঙালি ছিলেন। আবহাওয়া দেখে বা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে কৃষিকাজের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করতেন তিনি। প্রকৃতির কবি। যদি ঝড়ে ফাগুনে, রাজা যায় মাগনে, এসব বিষয় এসেছে খনার কবিতা থেকে। এব প্রতি আমার মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। সে মুগ্ধতা থেকে আমি খনার সনেটগুলো লিখেছিলাম। এগুলো যে এতো ভালো হবে আমি তখন বুঝতে পারিনি।
আপনার সাম্প্রতিক একটা লেখা পড়লাম। সেখানে আপনি বলছেন, একজন কবিকে গদ্যে পারদর্শী হতে হবে। কেন একজন কবিকে গদ্য লিখতে হবে?
এ জন্য যে, কবি তো সব কথা কাব্যে বা ছন্দে না-ও বলতে পারেন। গদ্যটা কবির জন্য একান্ত দরকার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব লেখকই খুব ভালো গদ্য লেখক ছিলেন।
কখনো কি মনে হয় যে, কবিতা মানুষের পূর্ণ অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করতে পারে না?
এটাও ঠিক না। অনেকে আছেন, যারা শুধু কবিতাতেই কাজ করেছেন। কিন্তু তারা যদি গদ্যে লিখে কিছু বলতেন তা হলে কতোই না ভালো হতো। এটা আমরা মনে করি। যেমন জসীমউদ্দীন। আমরা তো জসীমউদ্দীনকে সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশি কাথার মাঠের জন্য বিখ্যাত মনে করি। কিন্তু জসীমউদ্দীনের গদ্য যে এতো সুন্দর তা বোঝা যায় যখন ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় বইটা পড়া হয়। চলে মোসাফির আরেকটি বই। এসব গদ্য লিখে তিনি প্রমাণ করেছেন, অসাধারণ এক গদ্যশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। ভালো কবি যারা তারা প্রায় সবাই ভালো গদ্য লিখেছেন।
আপনার ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল? আপনি তো কবিতার তুমুল সাফল্যের মধ্যে গদ্য লিখতে শুরু করেছেন।
আমি কিন্তু কবিতার পাশাপাশি প্রথম থেকেই গদ্য চর্চা করতাম। সেটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমার মধ্যে প্রথম থেকে এটা ছিল। দুইটা তরবারি ছিল আমার। একটা খাপে আটকে রেখেছিলাম, আরেকটা খুলে রেখেছিলাম। পরে যখন আমার গদ্য লেখার প্রয়োজন বোধ হলো তখন আমি লিখেছি। এছাড়া সংবাদপত্রে চাকরি করতাম বলে গদ্যে আমার একটা দক্ষতা এমনিতেই ছিল।
আমাদের সমাজে এক ধরনের ক্যাটেগরাইজেশন কাজ করে। একজন কবিকে কবি হিসেবেই দেখার চেষ্টা চলে অথবা একজন গদ্যকারকে স্রেফ গদ্যকারই ভাবা হয়। সহজ একটা ক্যাটেগরির মধ্যে তাকে ফেলে দেয়া হয়।
এটা আধুনিক বিচার নয়। ইওরোপে যারা ভালো কবি তারা সবাই ভালো গদ্য লেখক। কবিতা তো লিখেছেন কিন্তু পাশাপাশি কোনো একটা উপন্যাস লিখেছেন যেটা বেস্টসেলার। সেটা বিক্রি করেই খান। কবিতা তো আর আর্থিক সাফল্য এনে দিতে পারে না। কবিরা গদ্য লিখলে খুবই ভালো হয়। তাছাড়া সমকালীন বিষয় নিয়ে গদ্য লিখতে পারা হলো কবিত্বেরই লক্ষণ। একজন কবি যখন গদ্য, উপন্যাস, গল্প লেখেন তখন তাকে কিন্তু বিচার করতে হবে সব বিষয় নিয়ে, কবি হিসেবে। অনেক জাতির ভাষায় কবি শব্দটা প্রয়োগ করা হয় গদ্য লেখক পদ্য লেখক সব মিলিয়ে। আমাদের দেশেও আমি যদি গ্রামে যাই লোকে বলে যে, কবি আসছেন। আমি যদি গদ্য লেখকও হই তবুও কিন্তু তারা আমাকে কবিই বলে। এটা কেন বলে? যারা ভাষায় সৃজনশীল উদ্ভাবনাময় কিছু রচনা করেন তারাই তো কবি। বিভক্তি করে তো কোনো লাভ নেই।
গদ্য ও পদ্য লেখার প্রক্রিয়ায় আপনি কোনো পার্থক্য অনুভব করেন?
পার্থক্যটা তো আমার মধ্যেই। আমার মধ্যে যখন লেখা আসে তখন মানসিক প্রস্তুতির মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়, এটা কাব্যে বলবো না গদ্যে বলবো। আমি যেটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটায় লিখি। আমি সে লেখাটা নিয়ে আগে ছন্দের চিন্তা করি। যেমন কোনো লেখা লিখতে গিয়ে অক্ষরবৃত্তের চাল এসে যায়। তখন এটা কবিতার জন্য তৈরি হয়। আর গদ্য হলো চিন্তা, আমার জ্ঞান, পারম্পর্য বিশ্লেষণ করে গদ্য লিখতে হয়। গদ্য পরিশ্রমের কাজ। গদ্য লিখতে হলেই যুক্তি-তর্ক স্থাপন করতে হয়। একটা লাইন লিখলাম, তারপর এলোমেলো লাইন লিখলেই তো হবে না। আমার ধারণা, এ পার্থক্যটা আমি বুঝি ভালো করে।
কবিতা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা কি?
অনেক সময় একটা চিত্রকল্প থেকে কবিতা তৈরি হয়। অনেক সময় একটা শব্দ থেকে হয়। হাটছি, একটা শব্দ মনে পড়লো। এ শব্দটাই আলো ছড়াতে ছড়াতে আমাকে টেবিলে নিয়ে আসে। লিখতে বাধ্য করে। যখন অল্প বয়স ছিল, তখন রাস্তায় চলার সময় হয়তো দুইটা লাইন এসে যেতো। সিগারেটের প্যাকেট খুলে, ছিড়ে এটার ভেতরে লিখে রাখলাম। না হলে আবার ভুলে যাবো।
পুরো কবিতাটা একবারে মাথায় তৈরি হয়ে যায় কখনো ?
এটা খুব কমই হয়েছে। প্রথমে একট স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়, কয়টা লাইন আসে। কয়টা লাইন কমপ্লিট। লিখতে বসি যখন তখন এটা আবার চেঞ্জ হয়। চেঞ্জ হয়ে পুরো কবিতাটাই বেরিয়ে আসে।
গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে?
এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার যে, অনেক সময় উপন্যাস লিখতে বসেছি কোনো চিন্তা না করে। কোনো বন্ধু বলেছে বা পত্রিকা বলেছে, তো প্রস্তুতি ছাড়াই লিখতে বসেছি। পুরো গল্পের স্ট্রাকচার তৈরি হচ্ছে। চরিত্র তৈরি করছি যেমন আমি দেখেছি। চরিত্রের ডিটেইল করতে গিয়েই গল্পটা বেরিয়ে আসে। প্রেম, কাম, যৌনতা, হিংস্রতা সব থরে থরে আসতে থাকে।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে পুরনো টেকনিক নেইনি কখনো, যেহেতু আমি ছোটগল্প লেখক এবং আমি শর্ট উপন্যাস লিখি। মাইক্রো উপন্যাস আমিই প্রথম তৈরি করেছি। আমি এর প্রবর্তক না হলেও প্রসারণকারী।
গল্পটা পূর্ণাঙ্গ হয়েই যে আসে, তা নয়। লিখতে বসে আমিই সাজাই। তাছাড়া আমার একটা নতুন বিষয় হয়েছে, আমি চোখে দেখতে পাই না। আমাকে কারো না কারো ওপর নির্ভর করতে হয়। এ নির্ভরতাটা আমাকে কল্পনার দিক দিয়ে কিছু সুবিধা দিয়েছে।
অনেক লেখকের অন্ধত্ব তাদের নতুন সৃজনশীলতা এনে দিয়েছিল।
আমি এক সময় তো দেখতাম। সব দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। চোখের সবচেয়ে ভালো ও খারাপ ব্যবহার আমি করেছি। এ স্মৃতি তো আমার মধ্যে কাজ করে। এখন চোখ অপরিচ্ছন্ন হয়েছে বয়সের ভারে। এটাকে খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছি। দৃষ্টিশক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেটা কাজে লাগাই।
২.
এবার অন্য প্রসঙ্গ। নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রেম ও ভালোবাসার পার্থক্য কোথায়?
আমার ধারণা, দেহগত মিলনের আগে যে সম্পর্ক তৈরি হয় সেটা আসলে আকর্ষণ। যৌন আকর্ষণ থেকে সেটা হয়। কোনো নারী যখন কোনো পুরুষকে দেহ দিয়ে খুশি করে তখন এরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নাম হলো প্রেম। সামগ্রিক অর্থে ভালোবাসা হলো মানুষের প্রতি মানুষের একটা আকর্ষণ। একজন মানুষকে পছন্দ করি সেটা তো এমনিতেই করি না। আর দশজনের চেয়ে আলাদা বলেই তো পছন্দ করি। তার কিছু গুণ থাকে, কিছু প্রতিভা থাকে।
নারীর মনোযোগ পাওয়া বা প্রেম ব্যাপারটা আপনাকে কতো গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে?
নারীর মনোযোগ পেতে হলে আগে জানতে হয়, প্রেম ব্যাপারটা কি এবং গভীর অভিনিবেশ সহকারে এটার চর্চা করতে হয়। দেখতে হয়। এটা পেতে হলে এর ভেতরে ঢুকতে হয়। এর মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দও আছে। এ আনন্দের জন্যই একজন আরেকজনের কাছে আসে। এটা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। অনেক মানুষের কাছে যেতে পেরেছি।
প্রেম ব্যাপারটাকে জানতে হলে, মানুষ সম্পর্কে জানতে হয়। পুরুষকে নারী সম্পর্কে, নারীকে পুরুষ সম্পর্কে খুব ভালো করে অবহিত হতে হয়। জানতে হয়। এটা ঘটলেই সম্পর্ক তৈরি হয়।
আপনি কি এখনো নারীর প্রতি লিপ্ত ভালোবাসা অনুভব করেন?
সত্যি কথা বলতে কি, এটা করি আমি। আমি কবি বলেই যে করি, তা না। আমি কল্পনাপ্রবণ মানুষ বলেই করি। আমরা যা দেখি তার সবটা দেখা নয়। আমাদের বিপরীত লিঙ্গে যারা তাদের আমরা সবটা দেখি না। কিছু দেখি, কিছু কল্পনা করি। এ জন্যই এতো রহস্য তৈরি হয়। কখনো আমরা সবটা দেখি না। আমরা কোন সময় ত্রিমাত্রিক চোখ পাবো যে, তিনটা দিকই দেখতে পাবো। তাই আমরা কল্পনা করি। সবটা দেখতে না পাওয়াই রহস্যের মূল কারণ।
নারীর কাছে আমার নানা ঋণ আছে। নারীর কথা বলতে গেলে কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করতে হয়। নানা নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে। নানাভাবে তারা আমাকে সাহায্য করেছে। আমার তো মনে হয়, মেয়েরা কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ।
কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি জীবনের কোনো একটি পর্বে নারীর সঙ্গ পাননি?
আমার জীবনে এটা কখনো ঘটেনি। কারণ আমি অল্প বয়সে বিয়ে করেছি। আর খুব পরনির্ভর জীবন। আমার সব একজন করে দিয়েছে। এ জন্য আমি এটা ঠিক বুঝতে পারি না, নারীসঙ্গ বিবর্জিত জীবন কেমন তা আমি জানি না।
৩.
আধুনিক কবিতার সঙ্গে গানের এক ধরনের বিচ্ছেদ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ গানকে কবিতার সঙ্গে কবিতাকে গানের সঙ্গে মিলিয়েছেন। কিন্তু তারপর সে ধারাটি আর থাকেনি।
আগে তো গান গাওয়া হতো। কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত প্রায় সব কবিই গান লিখেছেন এবং তাদের একটা গীতসম্ভার আছে। কিন্তু ত্রিশের কবিরা এসে গানের সঙ্গে কবিতার একটা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলেন। তার গান আর রাখলেন না। বললেন, আমার কবিতাতেই গান আছে, মিউজিক আছে। আমি সে মিউজিক সৃষ্টি করি ছন্দে। এটি গাইতে হবে কেন? গাইতে হলে তবলা, হারমোনিয়াম দরকার। একটা যন্ত্র দরকার। সঙ্গীত সৃষ্টি করতে হলে নানা রকম অনুষঙ্গ দরকার। কিন্তু আধুনিক কবিরা বললেন, ত্রিশের কবিরা বললেন, না আমি কারো ওপর নির্ভরশীল হবো না। শুরু হলো অন্যরকম খেলা। এটাই ত্রিশের অবদান। জীবনানন্দ দাশ এলেন।
অনেকে বলেন ত্রিশের দশকের এ চর্চা অর্থাৎ গান বা সাঙ্গীতিক চর্চা থেকে কবিতার বিচ্ছেদ বাংলা কবিতার ক্ষতি করেছে।
ক্ষতি কেন? ক্ষতি নয়। এতে আধুনিকতার একটা প্রকারভেদ ঘটলো। যেটা পৃথিবীতে সর্বত্রই একটা সময় ঘটেছিল। আগে তো গানই সবকিছু ছিল। কিন্তু গানের জন্য যন্ত্র দরকার, গলা দরকার, গায়িকা দরকার। আধুনিক কবি এসব করতে যাবেন কেন? তার আয়ো