মনের গভীরে জ্বলে থাকে দীপ বাইরে শুধুই কালো
কখনো বৃষ্টি আঁকাবাঁকা মাটি ঝোরার জলেতে ভেজা;
কি করে মিটবে নিঝুম তৃষ্ণা টুপ টুপ ঝরে ঘুম,
রাতমেঘ ভেসে খুঁজে ফেরে কোনো রূপসা নদীর চর।
এক বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কবিতার এই গুঁড়ো শব্দগুলো হঠাৎ এলোমেলো হাওয়ায় উড়তে শুরু করলো তৃষার বুকের ভিতর। বাস থেকে নেমে একটাও রিকশা ছিল না এই শেষ বিকেলে, দশ মিনিটের পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে। বাজারের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাবার সময় তার চারপাশ ঘিরে ছিল অজস্র নাগরিক কোলাহল... এর মাঝেই পেছন থেকে সেই হারিয়ে যাওয়া ক্ষীণ ডাক ভেসে এলো, রূ...প...সা...!
রূপসা? চমকে পেছনে তাকালো তৃষা। এই ডাক তো ছিল কেবল একজনেরই... অনিরুদ্ধ। কোথায় সে? ব্যাগটাকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে পিছন ফিরে জোরে চলতে লাগলো এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে। ভিড় ঠেলে বড় রাস্তার কাছে এসে হাঁফাতে লাগলো তৃষা। কেউ নেই! অনিরুদ্ধ নেই, অনিরুদ্ধ থাকতে পারে না, হারিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অনেকদিনের গুঁড়ো গুঁড়ো ম্লান শব্দবন্ধ। ঘিঞ্জি শহরতলীর সরু গলিতে স্ট্রীটলাইট গুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে এক এক করে। অন্য কাউকেও তো ডাকতে পারে কেউ। কি যে হয়ে গেল বুকের মধ্যে... ছন্দহীন পায়ে ফিরে এসে তালা খুলে বাসায় ঢোকে তৃষা। ব্যাগ থেকে পরীক্ষার খাতাগুলো বার করে টেবিলের উপর রাখে। মোবাইলে মায়ের অনেকগুলো মিস্ড কল। পোশাক নিয়ে বাথরুমে ঢোকে তৃষা। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নিচে কাটায়। সারা শরীর জুড়ে শীতল জলের ধারা কিছুতেই ধুয়ে ফেলতে পারে না অনিরুদ্ধর ছড়িয়ে রাখা কিছু ঘনিষ্ঠ শব্দের সুবাস। একচিলতে ম্লান অথচ মায়াবী জ্যোৎস্নার মত মাখামাখি হয়ে থাকে চেতনার প্রান্তর জুড়ে।
বিবর্ণ তারা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ টিলাদের ঘুমচোখ,
বুকের ভিতরে কাঠকুটো জ্বালা, আকাশ ছুঁয়েছে ধোঁয়া,
ছেঁড়া মেঘ সরে টিট্টি পাখির ঘুম ভাঙা ডাক গুলো
ডানা ঝাপটিয়ে চলে যাবে কোন রূপসা নদীর চর।
কত গুলো বছর চলে গেল, সেকেন্ড ইয়ারের শুরু তখন। বন্ধুদের সাথে প্রথম এক্সকার্সান ঘাটশিলায়। কি যে মজা হয়েছিল। অনির সাথে পরিচয় ফার্স্ট ইয়ারেই। তখন ও ছিল মেকানিক্যালের পাসআউট। কিছুদিন পরেই চাকরি পেয়ে চলে গেছিল রামিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের যশিডি প্ল্যান্টে। সেবার ছুটি নিয়ে ঘাটশিলায় চলে এসেছিল সেও। উজানি হাওয়ায় উড়ে যাওয়া বুনো শালপাতার মতই কেটেছিল সময়গুলো। কলেজে থাকতেই অনির কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন থেকে নামী পত্র পত্রিকায়। তার অনেক কবিতায় ছিল রূপসা নদীর কথা। ঘাটশিলার শেষ রাত্রে সুবর্ণরেখা নদীর পাশে ক্যাম্পফায়ারের পরে কি ভাবে যেন ওরা দুজন অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেছিল। আধখানা চাঁদের আলো ভেঙে ভেঙে সুবর্ণরেখার জল বেয়ে চলে যাচ্ছিল কলকল করে... কথা প্রসঙ্গে তৃষা জিগ্যেস করেছিল, এটাই কি তোমার রূপসা নদী? অনি হেসে উঠেছিল, ধ্যাত এটা তো সুবর্ণরেখা। তারপর একটু চুপ থেকে গভীর চোখে চোখ রেখে বলেছিল, তুই আমার রূপসা নদী! একটু পর তৃষার গলায় ঝোলানো ছোট্ট লকেটটা ঠিক যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখানে আলতো আঙুল ছুঁইয়ে অতলস্পর্শী কন্ঠে বলেছিল, আর এইখানে রূপসা নদীর চর! গাঢ় অনুভবে শুনিয়েছিল কবিতার পংক্তিগুলি। তৃষা যেন হারিয়ে গিয়েছিল দূরের টিলায় মিশে থাকা সবুজ অন্ধকার আর শালবন থেকে ভেসে আসা মাদলের শব্দের সাথে।
এর পরের ইতিহাস বড়োই অসংলগ্ন। ময়লা জামা, একমাথা উষ্কোখুষ্কো চুল, আর তার মাঝে জ্বলন্ত আগুনের মত চোখদুটো নিয়ে যখন শেষ দেখা হয়েছিল অনির সাথে ততদিনে সে চাকরি ছেড়ে মাওবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে পচা গলা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাল্টাতে চেয়েছিল একদল মানুষ। কি এক অজানা দৃঢ়তায় এক বুক দাবানল নিয়ে সব পিছুটান ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা। হাতে তুলে নিয়েছিল মারণাস্ত্র। অনি আর ফিরে আসে নি। সরকারীভাবে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। কেউ বলে আধা সামরিক বাহিনীর সাথে এনকাউন্টারে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কেউ বলে পার্টির গোষ্ঠীদ্বন্দে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এইসবে তৃষার আর কিছুই যায় আসে না। সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একা পেয়িং গেস্ট রয়েছে স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই। আজ রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় সে। পাশের জানালা থেকে একফালি চাঁদের আলো চুপিসাড়ে বিছানায় উঠে এসে তৃষার মুখে বুলিয়ে দেয় অনেকদিন আগের হারিয়ে যাওয়া এক স্পর্শ। অনিরুদ্ধের হাত ধরে তৃষা হাঁটতে থাকে সুবর্ণরেখার জ্যোৎস্নাময় তীর ধরে। শালবনের সবুজ অন্ধকার ছিন্ন করে একটা চাপা অথচ ভরাট কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়তে থাকে তৃষার শিরায় শিরায়।
লালমাটি বুকে তুলে নেয় যত শুকনো পাতার দল,
জ্যোৎস্না ধুয়েছে মাদল বাজানো মহুয়ার সেই ঘ্রাণ,
জোনাকিরা ওড়ে শালবন শুধু আঁধার ঘনিয়ে পথ,
ভালোবাসা খোঁজে একলাই কোন রূপসা নদীর চর।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৫৯