"এই আমার মেয়ে। ৩০ বছর বয়স। যেদিন ও জন্ম নিলো, ডাক্তার বললেন, ওর আয়ু মাত্র ১ বছর। সেই ১টা বছর আমি কত জায়গায় যে গেছি! কত ডাক্তার, কত ওষুধ! সবারই এক কথা। মেয়েটা আর বাঁচবে না। আমি কারও কথা বিশ্বাস করিনি। দেখতে দেখতে বছরটা পেরোলো। কাকতালীয় হলেও সত্যি, আমার মেয়ে বেঁচে গেল। ডাক্তাররা অবাক হলেন। বললেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়! তাঁরা ভবিষ্যৎবাণী করলেন, এই মেয়ে এবার বেঁচে গেলেও ওর অনেক দুঃখ, সামনে অনেক বিপদ! আমি ভয়ে ভয়ে ওকে বড় করতে লাগলাম।
ডাক্তারদের কথা সত্যি হল। আমার মেয়ের একের পর এক স্ট্রোক হল, মোট- ৫ বার। ও বাকশক্তি হারাল, বুদ্ধি হারাল, একেবারে ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে গেল। শেষ স্ট্রোকে ওর ব্রেনের যে অংশ মানুষের ক্ষুধার উদ্রেক করে, সেটাও নষ্ট হয়ে গেল। তারপর থেকেই পাকস্থলীতে ইনজেকশন দিয়ে খাবার দিতে হয়। আমি হতাশ হইনি কখনোই। আমি জানি, যে বাঁচার সে বাঁচবেই। আর যার সময় শেষ, তাকে চলে যেতে হবে। আমার ছোট ভাইয়ের কথাই বলি। ২ বছর আগের কথা। সুস্থ-সবল ভাইটা ঘুমাতে গেল রাতে। সেই ঘুমই তার শেষ ঘুম হবে, কে জানত? পরদিন সকালে তাকে আর ঘুম থেকে তোলা গেল না! ২ মাস পর আমার ভাতিজি হানিমুনে গিয়ে সাগরে হারালো, তার ১ মাস পর আমার মা মারা গেল। সেই বছরটা সত্যিই খুব বেদনার ছিল আমার জন্য। তারপরও, আমি তো জানতাম, যে যাবার সে যাবেই, কে তাকে আটকাবে?
আমি আমার মেয়েটার নিষ্পাপ হাসি দেখে সব ভুললাম। কিন্তু হঠাৎ, ৪ মাস আগে, ওর ভয়ংকর ঠাণ্ডা লাগল। ডাক্তার বললেন, ফুসফুস ছোট হয়ে গেছে। বললেন, ওর আয়ু আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা। আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আড়াই ঘণ্টা পার হল। মেয়েটা আমার বেঁচে রইল। আমি বিজয়ীর হাসি হাসলাম। আমি জানি, যে থাকার সে থাকবেই। কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারবে না।
মেয়েটা আমার আসলেই খুব লক্ষ্মী। হাতে একটা খেলনা দিলেই ও চুপটি করে খেলতে থাকে। মা'কে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। আমার আদরের মামণিটা! "
-----এ পর্যন্ত বলেই তিনি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার সামনে একজন অসীম মমতাময়ী মা, ৩০ বছর ধরে অনেক কষ্ট সয়ে মেয়েকে আগলে রাখা মা, জীবনযুদ্ধে হেরে না যাওয়া একজন মা। আমিও মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখে রুমাল ঘঁষলাম। রুমালটা বেশ ময়লা হয়ে গেছে, আজকেই পরিস্কার করতে হবে!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:৪৭