দেশী-বিদেশী-প্রবাসী পাঠক-লেখক-গবেষক-উৎসুক শ্রেনীর তথ্য পিপাসুদের জন্য তথ্য ভাণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ১৯৬৫ সালে ইন্টারনেট উদ্ভাবন এবং ১৯৮৯ সালে স্যার টিম বার্নার্স-লি’র ’ওয়েব’ প্রস্তাবনার ফলস্বরূপ দ্রুতগতিতে তথ্য প্রাপ্তি ও আদান-প্রদানের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠল আন্তর্জাল । এখন চাইলেই বিদেশে বসে দেশ নিয়ে জানা যায়। দেশে থেকে বিদেশের পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। বর্তমানে বসে অতীত থেকে আরো অতীতের ইতিহাস উদঘাটন করা যায়। তথ্যের জানাজানি আর খোঁজখবরে সময় ক্ষেপন হ্রাস পেয়েছে আন্তর্জালের কারণে। পত্রিকার জন্য লেখা লিখবেন, হাতের কাছে রেফারেন্স বইটি নেই। অনলাইনে খুঁজলে কাংখিত বইটি পেয়ে যেতেও পারেন। হয়ত কোন ব্লগ লিখছেন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে। পাঠকের সুবিধার্তে সাথে গুরুত্বপূর্ণ ছবি যোগ করতে চান ব্যক্তি বা স্থানের। আপনার সংগ্রহে ছবি না থাকলে তাও খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়না অনলাইনে।
একজন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকবেই। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপটই আমাদের মূল প্রতিপ্রাদ্য জুড়ে থাকে। ১৯৭১ সালে তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি এখনকার মত অত্যাধুনিক ছিলনা নিঃসন্দেহে। তাই পরবর্তীতে সেসময়ের যোগাড় করা ছবি, দলিল, পত্রিকা ইত্যাদিকে সহজলভ্য করতে আন্তর্জালে এগুলো একে একে ডিজিটাল ফরম্যাটে যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন উদ্যোগে। তথ্য যোগ হতে থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। ব্যক্তিগতভাবেও। । স্বাধীনতার বিরোধীশক্তিদের ইচ্ছাকৃত তথ্যবিকৃতি একটি সতর্ক পর্যবেক্ষণমূলক বিষয় কিন্তু এর বাইরেও আমাদেরই বেখেয়ালে তথ্যবিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।
অভিজ্ঞতাটি ব্যক্তিগতই। বছর খানেক আগে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের আটত্রিশতম শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁর স্বরণে আমার লেখা ব্লগে এই সূর্যসন্তানের কিছ দূর্লভ ছবি সংযুক্ত করার ইচ্ছে পোষণ করি। সেরকম কিছু না পেয়ে অবশেষে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে তাঁর নামে পাওয়া একটি ছবিকেই ব্লগে ব্যবহার করি । আসলে একটি চলমান ভুলকেই অনুসরণ করেছিলাম। অনলাইন থেকে প্রাপ্ত সেই ছবিটি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ছিলনা । ছিল বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন -এর। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদকে নিয়ে লেখা ব্লগে পাঠক-ব্লগাররা তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেও ছবি বিভ্রাটটুকু কারোরই নজরে আসেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্লগার ’মলিকিউল’ ছবিটি নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করেন। ব্লগার ’মলিকিউল’ তার সংশয়ের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাল ঘেঁটে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি নিয়ে আরো বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পান। বিষয়টি সবার নজরে আনার নিমিত্তে নাম ও ছবি সঠিকভাবে তুলে ধরেন তার ব্লগে ।
এরপর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অথচ ওয়েব সাইটে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম ও ছবি বিভ্রাট তেমনই রয়ে গেছে। বলা ভালো, অজান্তেই এই ছবি বিভ্রাটের শিকার হয়ে আমরাই বিভ্রান্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছি। আরো ছড়িয়ে দিয়েছি ইতিমধ্যে। অনলাইনে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম দিয়ে ছবি খুঁজতে গেলে ’সার্চ রেজাল্ট’ থেকে প্রাপ্ত ওয়েব লিংকগুলোতে ছবি বিভ্রান্তি চোখে পড়ছে । বীরশ্রেষ্ঠ রূহুল আমিন -এর ক্ষেত্রে তাঁর সঠিক ছবির পাশাপাশি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান -এর ছবিকেও বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন নামকরণে দেখা যায়। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন -এর ছবির নামকরণ অনেক ওয়েব সাইটে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ হিসেবে দেখা যায়। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের ছবি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জালে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ছবির বদলে অনেক ক্ষেত্রেই বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ছবি ব্যবহার হচ্ছে। কেবলমাত্র বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. এম মতিউর রহমান এবং বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ছবি নিয়ে এই বিভ্রান্তি চোখে পড়েনা। সম্ভবত পেশাগত উচ্চপদবী সহায়ক ছিল এঁদের সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ ও প্রাপ্তিতে।
(মূল গ্রাফিক্সটি ব্লগার মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী'র পোস্ট থেকে নেয়া- Click This Link)
ছবি বিভ্রান্তির সূত্রপাত কোথা থেকে তা বলা মুশকিল। এক সময় মূর্চ্ছনা.কম ওয়েব সাইটটিতে বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে এই ছবি বিভ্রাট দেখা গিয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৪শে মার্চ বিডিনিউজ২৪.কম -এর ’কিডজ’পাতায় সাতজন বীরশ্রেষ্ঠদের সংক্ষিপ্ত সচিত্র বিবরণী দেয়া হয়। এখানে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সম্পর্কিত তথ্যের সাথে ছবি ব্যবহার করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের । বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ছবি । বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুনশী আবদুর রউফের ছবি। অর্থ্যাৎ সেই গতানুগতিক ছবি বিভ্রাটে বিভ্রান্ত একটি সন্দর্ভ। এছাড়াও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্মসাল লেখা হয়েছে ১৯৪৫। অথচ বাঙলা উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্ম তারিখ ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ উল্লেখ করা আছে। উল্লেখ্য যে, রচনাটির শেষে তথ্যসূত্র হিসেবে বাঙলা একাডেমী চরিতাবিধান এবং সম্পাদনায় সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলামের নাম ছিল। তবে ব্যবহৃত ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় তা আন্তর্জাল থেকে সংগ্রহিত।
(বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জন্মসাল ১৯৪৫ নাকি ১৯৫৩? দু'রকম তথ্যই পাওয়া যাবে বিভিন্ন লেখনীতে)
তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে উইকিপিডিয়া যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য সবার কাছে । তথাপি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এর মৃত্যু তারিখ নিয়ে এই সাইটে স্পষ্ট অসংগতি চোখে পড়ে। বর্ণনায় মৃত্যুর তারিখ হিসেবে ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ উল্লেখ থাকলেও পাশাপাশি এই বীর সিপাহীর সমাধি শিলালিপির ছবি দেয়া আছে, যেখানে স্পষ্ট করে মৃত্যু তারিখ হিসেবে খোদিত রয়েছে ১৮ই এপ্রিল ১৯৭১। আন্তর্জালে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের জন্মসাল কোথাও ১৯৩৪ আবার কোথাও ১৯৩৫ পাওয়া যায়। নামের বানানেও ভিন্নতা লক্ষ্য করার মত। বাঙলা ব্লগের ব্লগাররাও অজান্তে এধরণের বিভ্রান্তির পরিসর বৃদ্ধি করছেন। কমিউনিটি ব্লগগুলোতে বেশ কিছু ব্লগারের লেখায় বীরশ্রেষ্ঠদের নাম ও ছবি অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়বে। ওয়ার্ডপ্রেসে অনেকের ব্যক্তিগত ব্লগগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এই তথ্য বিভ্রান্তি। বাঙলা উইকিপিডিয়াতে পৃথক পৃথক লিংকে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠদের সংক্ষিপ্ত জীবনি পাওয়া গেলেও সাথে ছবি না থাকায় এই বিভ্রাট নিরসনে আপাতত নির্ভরযোগ্য কোন ওয়েব সাইট তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না ।
মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই এর যে কোন তথ্যের ভুল প্রচার কাম্য নয় কোনভাবেই। কাম্য নয় মুক্তিযুদ্ধের সূর্যসেনাদের নিয়ে কোন প্রকার তথ্য বিভ্রান্তি। এ ধরনের তথ্য বিভ্রান্তি সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় এবং তথ্য মন্ত্রনালয় কতটুকু অবগত তা বোধগম্য নয়। যদি বিষয়টি তাদের জানার বাইরে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখনও ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখার মত উপযোগী হয়ে ওঠেনি এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়। এই দুই মন্ত্রনালয়ের সমন্বয়ে একটি ’মনিটরিং সেল’ গঠন করা উচিৎ যেখানে আন্তর্জালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে কোন তথ্যবিভ্রান্তি পর্যবেক্ষণ করা হবে। এবং তা নিরসনে উপযুক্ত উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি সঠিক তথ্য প্রচারে অনলাইন পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকগণের এবং কমিউনিটি ব্লগের ব্লগারগণের সামান্য পড়াশোনা ও সতর্কতা এই বিভ্রান্তির আশু অবসান ঘটাতে পারে।
(বীরশ্রেষ্ঠ "রুহুল আমিন" নাকি বীরশ্রেষ্ঠ "রূহুল আমিন"? এবং জন্মসাল ১৯৩৪ নাকি ১৯৩৫? নামের বানান ও জন্মসালের দু'রকম প্রচলনই পাওয়া যায় আন্তর্জালে। )
সঠিক তথ্য একজন অনুসন্ধিৎসুকে সঠিকভাবে জ্ঞানবান করতে পারে। তথ্য আদান-প্রদান, প্রচার ও ব্যবহারে দ্বায়িত্ববান হওয়াটা তাই জরুরী এবং তা নিজেদের স্বার্থেই। আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ুক সাত বীরশ্রেষ্ঠদের সঠিক তথ্য । বিজয়ের মাসে বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতি এই হোক আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য।
-------------------------------
লেখাটির পরিমার্জিতরূপ প্রকাশিত হয়েছে আজকের (১২ই ডিসেম্বর ২০১০) দৈনিক সমকালে। - Click This Link
--------------------------------
বছর খানেক আগে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদকে নিয়ে লেখা ব্লগ পোস্ট-
Click This Link
--------------------------------
সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা- Click This Link