সেই কবে বড় হয়ে গেছি। এখন তাই এক কোণে পড়ে থাকে এককালের তুমুল বন্ধুরা। যারা ডাকলেই ছুটে যেতাম। আর এখন ধুলোর আস্তর জমে গেছে ওদের পোষাকে। বেলাঅবেলায় চোখ যায় যদিও। ভাবি একবার অন্তত ছুঁয়ে দেই ওদের। কানামাছি ভোঁ ভোঁ। অলস দুপুরে আলস্যভরে ওদের নিয়ে বসা। বহুদিন পর। শেলফের ভেতরে মুখ দিয়ে দেখি সারি সারি বন্ধুরা। আমি বদলে গেছি। ওরা তেমনি আছে। আমাকে পেয়েই ডাকলো সেই আগের মত ...। আলোছায়ায় হাত বাড়াই আমি। দুম করে ফিরে আসে শৈশব...সাদাকালো নয় রঙিন, রহস্যময়, রোমাঞ্চকর ...।
পাতা উল্টেপাল্টে প্রায়ই দেখতাম। একটা কিশোর ছেলে কোথায় না কোথায় যাবার জন্য, কি না কি রহস্যের জট খোলার জন্য ডাকাডাকি করছে। আমি শৈশবে মাথার দীঘল চুলের জট ছাড়াতেই ব্যস্ত থাকতাম বেশী। ওই ছেলেদের দলে যাবো কেন?
একদিন স্কুলে দু'বান্ধবীকে ওদের নিয়ে অনেক আলাপ করতে শুনলাম। ওরা ওই ছেলেদের দলে যোগ দিয়েছে! একটু হিংসে হলো। বাসায় ফিরে একটু উঁকি দিলাম ওদের রাজ্যে। ইত:স্তত করে হাত ধরে ফেললাম কিশোর নামের ছেলিটির ...বন্ধুত্বের শুরুটা সেই থেকে ...
সাগরসৈকত, রক্তচক্ষু, প্রেতসাধনা দিয়ে তিন গোয়েন্দার সাথে যোগাযোগ। এরপর রীতিমত লোভী হয়ে গেলাম ওদের সাথে উটকো এ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার। এলাকায় তখন 'হাবিব বুক হাউজ' -ই এই খোরাক মেটাতে সক্ষম। নতুন-পুরনো বইয়ের খোঁজ-দি সার্চ শুরু হয়।
তৃষ্ণা এতেও মিটলো না। বই মেলে ধরলেই চোখে পড়ে পুরনো নামের তালিকা। কেমন ছিল ওরা শুরুতে? কেমন করে একত্র হলো? কেন হলো? কি করে এই ভুত চাপলো? কত আগ্রহ। হাবিব বুক হাউজের আর্কাইভে এতো পুরনো কাসুন্দি নেই। শেষ পর্যন্ত বাড়ির বড়দের দিয়ে নীলক্ষেত থেকে পুরনো বইয়ের ছোটখাট লট কেনা হলো। বেশীর ভাগ বইয়ের ভেতরে পাতায় পাতায় পূর্ববর্তী মালিকের নাম লেখা - ইশারাত নাজনীন সিদ্দিকী। কেটে, মুছে, আঠা দিয়ে নতুন কাগজ বসিয়ে নতুন নিজের অস্তিত্ব ঘোষনা দেই।
অত:পর জানা গেল তিন গোয়েন্দার শুরুর গল্পটা।
এরপর তো তিন গোয়েন্দার ইন্দ্রজালে আটকা পড়লাম একে একে।
মনের ভেতর কিশোর, মুসা, রবিনের বিভিন্ন ছবি আঁকাআঁকি শুরু হয়ে গেছে সেই প্রথম দিন থেকেই। তারপরও খুব শখ, কেমন ওরা? 'হারানো উপত্যকা' তে ষ্পষ্ট দেখলাম ওদের। এমনিতে কিশোরের জন্য পাগল। কিন্তু সেদিন রবিন মিলফোর্ড -সেই আইরিশ ছেলেটাকে অনেক বেশী পছন্দ হলো। ওদের সাথে জিনাও ছিল। জিনাকে দেখে ওদের থেকে একটু বয়স্ক মনে হওয়াতে কোথাও যেন একটু হালকা বোধ করছিলাম। তবে রাফিয়ানকে দেখে দারুণ মজা পেয়েছিলাম।
যতই হালকা বোধ করি না কেন, জিনাকে নিয়ে অস্বস্তি কিন্তু একদম কাটেনি। গোলাপীমুক্তো হাতে পেয়ে প্রচ্ছদে জিনাকে দেখে একেবারে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলাম।
অবশ্য এতো হিংসার পরও অভিমান করে তিন গোয়েন্দার সাথে সম্পর্কহীন হয়নি। বরং কোন এক খোঁড়া গোয়েন্দা'র বুদ্ধির ঝিলিক দেখে আরো মজে যেতাম।
কেবল যে গোয়েন্দাবন্ধুদের দেখতে মন চাইতো তা তো নয়। ওদের শক্ররাই বা কেমন তা দেখার জন্যও ঠিক ঠিক চোখ রাখতাম। বিশেষত টেরিয়াল ডয়েল ওরফে শুটকি টেরি দু'চোখের বিষ ছিল বলে চিন্তার সাথে ওরা চেহারা মিলিয়ে নেয়ার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু যুতসই কোন কিছু মেলাতে পারিনি।
বিদেশবিভূঁইয়ে ছেলেমেয়েগুলো পড়ে আছে । ছুটে বেড়াচ্ছে। ওদের একটু দেশে ঘুরিয়ে নিলে কি হয়? কত অনুযোগ সেবা প্রকাশনীর কাছে পৌঁছলো আনাচেকানাচে থাকা বন্ধুদের কাছ থেকে। অত:পর ঢাকায় তিন গোয়েন্দা এলো । শীতকালে। সেই ভ্রমনটা খুব বেশী রোমাঞ্চকর হয়নি যদিও তবে খুশীর কমতি ছিল না।
কিশোরের প্রতি প্রথম থেকেই আগ্রহের কথা তো আগেই বলেছি। ওর ছবি এবারের কোন বইয়ের প্রচ্ছদে এলো কি এলোনা তাই থাকতো গবেষনায়। ঈশ্বরের অশ্রু'র প্রচ্ছদে ওকি কিশোর না কে? কিশোর হলে এখানে ভাল লাগছে না! ধুর! মন খারাপ। অন্য কোন ছবি দিতে পারতো। এই ছবিটাই কেন!
কিশোরের প্রেমে ডুবে আছি। রবিনের প্রতি অন্যরকম ভাললাগা। মুসার সাথে দারুণ বন্ধুত্ব। জিনাকে হিংসে। অথচ ওদের থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে, রেজা মুরাদ আর সুজা মুরাদ। এই দুই ভাই যখন হুট করে উদয় হলো একটু ড্যাশিং ভাব নিয়ে, তখন মন ক্ষণিক সময় ওদের জন্যই নেচে উঠেছিল।
আরো কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম। গোয়েন্দা রাজু। দস্যি। অস্থির, চঞ্চল বালক-বালিকার দল। ওদের মধ্যে রাজু ছেলেটা যে কি সুইট! গোয়েন্দা রাজু'র বইগুলো প্রথম দিকে বেশ পাতলা পাতলা ছিল। পড়তে সময় লাগতো না বেশী। কিন্তু মজা ছিল অনেক।
উহু! তিন গোয়েন্দাকে এতো বন্ধুদের ভিড়ে মোটেও ভুলে যাইনি। তবে কাছের বন্ধুরাও মাঝে মাঝে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। ওরাও মাঝে মাঝে কি সব ভুয়া ভুয়া রহস্য নিয়ে মেতে উঠতো। খুব রাগ হতো তখন!
একটা সময় ইত্তেফাকে সাধারণত এক ইঞ্চি কলামে সেবার নতুন বইগুলোর বিজ্ঞাপন আসতো। তারপরই হাবিব বুক হাউজে দৌড়। এখন আর সে সময় সেই। একটু নস্টালজিক হওয়ার বাসনায় বইমেলাতে গেলে এখন বড়জোর সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে একটু দাঁড়াই। অনেক ভিড় দেখা যায়। এটা দেখতে ভাল লাগে। এই হাইটেক যুগেও ছেলেমেয়েরা আমাদের মত বোকা বোকা ভাললাগায় তিন গোয়েন্দা পড়ে তাহলে? যদিও অনেকেই বলছে, এখন আর সেই তিন গোয়েন্দা একেবারেই নেই। লেখক বদল হয়েছে। লেখার ধারা বদল হয়েছে। হাবিব বুক হাউজে আগের মত বিশাল তাক জুড়ে সেবার বই থাকে না এখন। দোকানে কলম-পেন্সিল-খাতা কিনতে গেলে ছোট হয়ে আসা তাকটার দিকে উৎসুক চোখ তারপরও ছুটে যায়। নতুন কি বই বেরুল? কি নাম ? কেনা হয় না। কি করে হবে! এখন তো মোটা মোটা, ভারী ভারী বই পড়তে হয়!
তারপরও অবেলায়, অকাজে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে শৈশব জেগে উঠল। কাছের বন্ধুদের মনে পড়ে গেল।কি আশ্চর্য না? শৈশবের একটা অংশ জুড়ে গোয়েন্দা বাহিনী জাঁকিয়ে বসে আছে!
গ্রেট কিশোরিয়োসো। গ্রেট মুসাইয়োসো। গ্রেট রবিনিয়োসো। ওরাই আমার থমতম কৈশরের রডোডেনড্রন।