শেষ পর্যন্ত কী-বোর্ড ইস্যুতে কী-বোর্ডে ঝড় তুলে ফেললো সকলে। ঝড়ের সূচনাকারী যুগ যুগ ধরে পরিচিত আইটি-সেলিব্রিটি, বিজয় কী-বোর্ডের জনক মোস্তফা জব্বার। গত ৮ই এপ্রিল জনকণ্ঠে ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন। এর মধ্যে ইউএনডিপি, নির্বাচন কমিশন এবং ওমনিক্রনল্যাবের অভ্র কী-বোর্ডও ছিল। মোস্তফা জব্বারকে অনেকেই বিনোদন হিসেবে নেন, ফলে তার কথার ভুল হলে বিপরীতে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় বিশাল। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। মোস্তফা জব্বারের অভিযোগ ছিল অভ্র সফটওয়্যার কেন্দ্রীক। তিনি একে পাইরেটেড সফটওয়্যার বলে অভিহিত করেন। অভ্র টিম এর প্রতিবাদ করার আগেই মোস্তফা জব্বার বিমুখ সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানে প্রতিবাদের ধরণে টেকি-তথ্য উঠে আসার সুযোগ থাকলেও তার বদলে বেশীর ভাগই আবেগে কাতর হয়ে গেল। এবং মোস্তফা জব্বারের ভুলের মাশুল দিতে শূলে চড়ানো হলো বিজয়কে। এবং বিপরীতে অভ্রকে রীতিমত নায়কোচিত আসন দেয়া হলো। ফেসবুকে গুঞ্জন উঠে গেল- অভ্রের পাশে দাঁড়াই। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ব্লগের মূল ব্যানারে জায়গা করে নিল অভ্র। এরপর পাল্টে গেল অনেকের প্রোফাইল পিক একে একে। ব্লগ থেকে শুরু করে ফেসবুকে একই আহ্বান- অভ্রের পাশে দাঁড়াই। অথবা বিজয়কে না বলুন এবং অভ্রকে হ্যাঁ। বুঝে না বুঝে এই হুজুগে সবাই মেতে উঠলাম। ফলে খুবই প্রয়োজনীয় একটি ইস্যু, যা বিস্তারিত তথ্যাকারে উপস্থিত হলে আইটি ইউজার এবং ডেভেলপাররা উপকৃত হয়, নিদারুণভাবে মিস-লিড হলো।
মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই এভাবে বলছিলেন, আমরা অভ্র ইউজার, তাই অভ্রের পাশে দাঁড়াবো। প্রথমত, মোস্তফা জব্বারের বক্তব্যের বিরোধীতা করার জন্য অভ্র ইউজার হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। দ্বিতীয়ত, মোস্তফা জব্বারের বালখিল্য বক্তব্যের বিপরীতে বিজয় এবং অভ্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটিকে বিলুপ্ত প্রায় করার এবং অপরটিকে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়ার মত আরেকটি উদ্ভট প্রচারণার সূত্রপাত ঘটলো ব্যাপক আকারে। তৃতীয়ত, মোস্তফা জব্বার যে অভিযোগ করেছেন, সেটিকে ভীত্তিহীন বলার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নিয়ে আলোচনার শূণ্যতা ছিল আমাদের মধ্যে।
জল অনেকটা গড়ানোর পর ওমনিক্রনল্যাবের পক্ষ থেকে মোস্তফা জব্বারের ৮ই এপ্রিলের বক্তব্যের প্রথম প্রতিবাদ পাওয়া যায় ২০শে এপ্রিল। (অবশ্য মাঝের এই বিরতীর একটি ব্যাখ্যা সম্ভবত তাঁরা দিয়েছেন বলে শুনেছি) অভ্রটিমের বক্তব্য প্রকাশিত হয় সচলায়ন ব্লগে। এরপর গ্লোবাল ভয়েসে (অনলাইন) বেশ দীর্ঘ আরেকটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়, যেখানে কিছু ব্লগারদের অভ্রের প্রতি ভালবাসাময় সমর্থনও উল্লেখ ছিল। প্রযুক্তিগত বিষয় হওয়া স্বত্বেও, যতদূর মনে হয় টেকি-ব্লগ বলে পরিচিত টেকটিউনস এবং কম্পিউটার জগত ব্লগে তারা, অভ্র-টিম, কোন প্রতিবাদ-বক্তব্য-পোস্ট প্রদান করেননি। হতে পারে এ দু’টি ব্লগ তুলনামূলকভাবে ততটা সরব নয় বলেই। আবার এই দু’টি ব্লগের কোনটিই তাদের ব্যানারে অভ্রকে ধারণ করেনি। টেকটিউনসব্লগে কিছু আলোচনা দেখা গেলেও কম্পিউটার জগৎ ব্লগে ৮ই এপ্রিল পরবর্তী পোস্টগুলোতে বিজয়-অভ্র পুরোপুরিই অনুপস্থিত ছিল। তারপরও ব্যাপক প্রচারণার কারণে অভ্র-টিম যখন যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে, তখন মোস্তফা জব্বার রীতিমত তোপের মুখে।
২৩শে এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকাতে দু’পক্ষের বক্তব্য পাশাপাশি স্থান পায়। টেকি-জগতে বিচরণের পরও মোস্তফা জব্বার এমন সব অসম্পূর্ণ বক্তব্য রাখেন যা দ্রুতই একরকম টেকি-জোক্সে রুপান্তরিত হয়। অন্যদিকে তার বক্তব্যে তিনি যে হারে আইনি উমুক-তমুক ধারা গড়গড়িয়ে বলে যান তাতে বোঝা যায় তিনি বরং একটু বেশী আইনি-বিশেষজ্ঞ। হবেন নাই বা কেন? বিজয়কে নিয়ে তার রক্ষণশীলতা সন্তানের প্রতি কোন পিতামাতার পজেসিভনেসকেও ছাড়িয়ে যাবে। ২০০৮ সালে এক আইনি লড়াই জিতে গর্বভরে বিজয়কে আগলে রাখার প্রমাণ দেখালেন। এ ছিল তার দু’দশকের পরিশ্রম। বিজয় তার এবং তারই থাকবে, এই বোধ থেকেই বোধহয় তিনি ১৯৮৮ সালে বিজয় পেটেন্ট করিয়ে রাখেন। এবং যেহেতু এটি তার পেটেন্টকৃত সফটওয়্যার ফলে তার পক্ষে পাইরেসিজনিত অভিযোগ তোলা সুবিধাজনক হয়ে ওঠে। তারই ফলাফলস্বরূপ অভ্রকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন। নিজের বক্তব্যকে আরো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই পরিস্কার করেন যে, তার আসল খেদ রয়েছে ইউনিজয়ের প্রতি, কারণ তার মতে, ইউনিজয় বিজয়ের নকল এবং অভ্র একে অনুসরণ করে বলেই তিনি অভ্রকে পাইরেটেড বলেছেন। উল্লেখ করে নেয়া দরকার, আমরা যারা দাবি করি মোস্তফা জব্বার মিথ্যাচার করেছেন, তারা কেবল অভ্র-কেন্দ্রীক হৈ-চৈ করছি, ইউনিজয়কে নিয়ে নয়। জনকন্ঠে প্রকাশিত মিথ্যাচারে উনি অভ্র ছাড়াও ইউএনডিপি, নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি তার খেদ ২০০৮ সালেও প্রকাশ করেছিলেন। তখন তার অভিযোগ ছিল, নির্বাচন কমিশন তাদের ১০ হাজার ল্যাপটপে তার অনুমতি ব্যাতীত বিজয় ব্যবহার করছে। এ প্রসংগে তখন তিনি বলেছিলেন, "I don't seek any royalty from the election commission. I just want to get official acknowledgment from the government" । কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাঁর কথা শুনলো না, শুনলো অভ্রের কথা। সে যাই হোক, মিথ্যাচারের প্রতিবাদে অভ্রের পাশে দাঁড়ানোর হিসেব মোতাবেক আমাদের উচিৎ ছিল ইউএনডিপি ও নির্বাচন কমিশনের পাশেও দাঁড়ানো। এমনকি যেহেতু মোস্তফা জব্বার মূলত ইউনিজয়কে নিয়েই তার আপত্তি রাখেন, তাহলে আমাদের উচিৎ ছিল ইউনিজয়ের পাশেই দাঁড়ানো। কিন্তু আমরা যেন গল্পটাকে অভ্রমুখী রাখতেই আগ্রহী বেশী ।
মোস্তফা জব্বারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওমনিক্রনল্যাব অর্থ্যাৎ অভ্র-টিম কী বলছে? একটি ভূমিকা- যেখানে আবেগ ও জনপ্রিয়তার কথা আছে, অনুমতি বিষয়ক মোস্তফা জব্বারের সাথে অতীতে কিছু ব্যক্তিগত আলাপাচারিতার প্রয়োজনীয় বর্ননা, এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- একটি মাত্র কী -এর পার্থক্যই জন্ম দেয় নতুন একটি কীবোর্ড লে-আউটের। এই অন্তত্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি নিয়ে খুব বেশী বিস্তারিত না থাকলেও, মূলত এখানেই কিন্তু প্রচুর আলোচনার সুযোগ আছে। এখানেই অভ্র, ইউনিজয়, বিজয়ের পার্থক্য বা সাদৃশ্যের হার নির্ণিত হবে, মোস্তফা জব্বার কতটা ভুলে বাস করেন এবং অভ্র পাইরেটেড নয় বিষয়গুলো দিবালোকের মত পরিস্কার হবে।
ওমনিক্রনল্যাব সাইটে পরিস্কার বলা আছে, ”eyboard layouts those are added with the current release are - UniBjoy (99% match with popular Bijoy keyboard layout)” , তার অর্থ হলো ১% বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ওমনিক্রনল্যাব তাদের বক্তব্যে বলছে, ইউনিজয় অন্তত আটটি কী’তে বিজয় থেকে আলাদা। তাহলে ধরে নেই ওই ১% -ই সেই ৮টি কী-স্ট্রোক। এখন যেহেতু ইউনিজয়ের মিল-অমিলের অংক কষা হচ্ছে, তাই এই আলোচনায় ইউনিজয়-টিমের নিজেদের বক্তব্য আসাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। অভ্র-টিম, ইউনিজয়-টিম সহকারেই বক্তব্য দিতে পারতো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ইউনিজয়-টিম অনুপস্থিত। ইউনিজয় তাদের সাইটে অবশ্য একটি ডিসক্লেইমার জাতীয় নোটে বহু আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছে যে, মোস্তাফা জব্বারের এইধরনের প্রোপাইটরশীপ পদক্ষেপে তারা সমর্থন করেনা এবং তারা এও জানিয়েছে, We have no affiliation with Mr. Jabbar or with Ananda Computers।
এদিকে আমরা মঞ্চে এখনো অভ্রকেই দেখছি, আর বিজয়কে ক্রমেই ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। বারবার বিজয় আর অভ্রের তুলনা উঠে আসছে। কোনটা বেশী ব্যবহার-বান্ধব ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা হলো, অভ্র যদি আজকে ব্যবহার-বান্ধব না হতো তাহলে কী মোস্তফা জব্বারের এই মিথ্যাচার সঠিক হয়ে যেতো? বলা হচ্ছে যে, এখন কেউ বিজয় দিয়ে লেখেনা। আমরা যারা এই কথা বলছি,সেই আমাদের অধিকাংশই ভার্চুয়াল জগতে বাংলা টাইপ করি। মুদ্রণজগতের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। তবে কেউ কেউ যখন বললেন, অভ্র এখনো মুদ্রন মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য নয়, তখন হঠাৎ করেই অভ্রের ডিটিপি বিষয়ক ফিচারগুলোর উপর আলোকপাত করা হলো। আশ্চর্য এই যে, ঠিক এই মূহূর্তেই আমাদের হুশ হলো আমাদের মুদ্রণে জগতে একটু পরিবর্তনের, আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানো জরুরী। মানে বিজয়ের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরী। কারণ এখন আমাদের কেবলি অভ্রের পাশে দাঁড়াতে হবে!
অতি আবেগে কেউ কেউ বলছেন, কেবল অভ্রেরই রয়েছে বাংলা ভাষার প্রতি অশেষ-বিশেষ অবদান। এবং বিজয়ের ভয়ের চোটে কেউ টাইপই করতো না। অথচ অভ্র প্রথম কী-বোর্ড নয়। ২০০৩ সালে অভ্র’র আবির্ভাব। ভার্চুয়াল জগতে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায় মূলত বাংলা ব্লগ এবং এরও পরে আমাদের ফেসবুক নির্ভরশীলতার কারণে। ধরে নেই ২০০৫ এর পরবর্তী আমাদের এই অভ্র-নির্ভনশীলতা। বাংলা ভাষা কি এর আগে বিস্তার লাভ করেনি- মুদ্রণে বা ওয়েবে? ১৯৮৪ থেকে ২০০২ পর্যন্ত প্রায় ২০টির মত বাংলা কী-বোর্ড সফটওয়্যার ছিল। এবং এক্ষেত্রে সমসামায়িক অন্যান্য কী-বোর্ডের চেয়ে বিজয় এগিয়ে ছিল। অবশ্য তাই বলে পুরো অবদান বিজয়ের একার নয়। বিজয়ের আগে-সমসাময়িককালে-পরে আমরা পেয়েছি মুনীর কী-বোর্ড (প্রফেসর মুনীর চৌধুরী একটি আধুনিক বাংলা টাইপ রাইটার ডেভেলপড করেন), রূপালী কী-বোর্ড, প্রভাত কী-বোর্ড, একুশে কী-বোর্ড। একুশে কী-বোর্ড শুরু থেকেই বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং একে ওপেন সোর্সও রাখা হয়। একুশে কী-বোর্ডের জনক Dr. Robin Upton নিজ উদ্যোগে ইমেইল করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার বাংলা টাইপ করার এই কী-বোর্ডটি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন। একজন ফিরিঙ্গির এই অবদানটাও তো কম ছিল না। প্রতিটি কী-বোর্ড লে-আউট প্রযুক্তির জগতে বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে একেকটি ধাপ হিসেবে কাজ করেছে। দুই-তিন ধাপের পর আমরা বিজয় পেয়েছিলাম, তারপর আরো অনেক ধাপ পার হয়ে আমরা অভ্র পেয়েছি। এবং আগামীতেও নতুন কিছু পাবো। ভাষাকে উন্মুক্তকরণে প্রতিটা ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। এটা উন্নয়নের ধাপ। তাই অবদান সবার, একার নয় ।
আবারো বিজয়-অভ্রতে কিংবা আসলে বিজয়-ইউনিজয়ে ফিরে আসি। ইউনিজয় বিজয়ের ৯৯% অনুরূপ, ১% ফাড়াক, অর্থ্যাৎ ৮টি কী লে-আউট ভিন্ন। কিছু বৈসাদৃশ্যগুলো দেখা যাক-
১. বাংলা স্বরবর্ণগুলো একটিভেট করতে AltGr (alternate graphic; ইংরেজীছাড়া অন্য ভাষা টাইপ করতে ব্যবহৃত কী-স্ট্রোক। সাধারণত নন-ইউএস মার্কেটে বেশী প্রচলিত। উইনডোজে Ctrl+Alt থেকে একই সুবিধা পাওয়া যায়) চাপতে হবে
২. AltGr ব্যবহার করে "" এবং "।" টাইপ করা যায়
৩. সাধারণ লেআউটে ~ (tilde sign) ও ` (single quotation mark) পাওয়া যায়। AltGr লে-আউটে এগুলো ZWNJ (zero-width non-joiner) ও ZWJ (zero-width joiner) রূপে কাজ করে।
৪. যুগল দাঁড়ি নেই
৫. গতানুগতিক বিজয়ে এরকম ব্যতিক্রমী AltGr পদ্ধতি একেবারেই নেই
মোস্তফা জব্বার আপাতভাবে দুটো কী-বোর্ড লে-আউটের মিল-অমিলের কথা যতই বলুন না কেন। একটু বিশ্লেষণ করলে তার গাত্রদাহের মূল কারণস্বরূপ দেখা যাবে সফটওয়্যারের ফ্রিওয়্যার, ওপেনসোর্স পদ্ধতি। ঠিক এই মূহূর্তে হুজুগে না মেতে আমরা প্রয়োজনীয় কিছু টপিক তুলে এই দ্বন্দের সুরাহা করে আগামীর ডেভেলপারদের উৎসাহিত করতে পারতাম, ফলে আইটি ইউজার হিসেবে লাভবান হতাম আমরাই।
১. একটি কী এর পার্থক্য থেকে একটি নতুন লেআউট
QWERTY এবং QWERTZ এর সামান্য পার্থক্য তাদের নাম থেকেই বোঝা যায়। Dvorak কী-বোর্ড লে-আউটে অবশ্য বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। আগেই বলেছি, অভ্র-টিমের প্রদত্ত তত্ত্ব, একটি কী এর পার্থক্য একটি নতুন লে-আউটে জন্ম দেয়, তা কতটা গ্রহণযোগ্য এ ব্যাপারে তাদের আরো বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নিতে হবে এবং করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের মত সাধারণ ব্যবহারকারীদের চেয়ে বিভিন্ন ডেভেলপারদের মন্তব্য অত্যন্ত জরুরী। এই বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা মূলত কেবল অভ্রকে বৈধতা দেয়ার জন্য নয়। এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে নতুন কী-বোর্ড লে-আউট নিয়ে গবেষণারত ডেভেলপারগণ সম্ভাব্য বিতর্ক এড়াতে পারবেন।
২. সফটওয়্যার পেটেন্ট কতটা জরুরী
যেহেতু মোস্তফা জব্বার বিজয়ের পেটেন্ট করিয়েই নিয়েছেন, তাই উনার অনুমতি ব্যতিরেকে কিছু হলেই আইনগতভাবে উনি যখন-তখন হাইকোর্ট দেখানোর অধিকার রাখেন। আমাদের মত দেশে এরকম প্রপাইটরশীপ দেখে আমরা অভ্যস্ত নই বলে আমরা অতি দ্রুতই ক্ষেপে যাই। "I hope that if I can continue my success the example will encourage many local software developers to get patent rights and earn royalty from their products", নিজের পেটেন্ট বিষয়ক পদক্ষেপে এমনই আস্থা প্রকাশ করেন মোস্তফা জব্বার। QWERTY, Dvorak এর মত বিশ্বজনিন ব্যবহৃত কী-বোর্ডের পেটেন্ট জরুরী হতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষত বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট পেটেন্ট করানো কতটা জরুরী? বা কতটা লাভজনক? এতে কী পরবর্তী গবেষণা বাধাগ্রস্থ হয়? আইসিটি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কী ভাবে?
৩. ফ্রি-ওয়্যার যখন লাভজনক এবং ফ্রিওয়্যার যখন অলাভজনক
আইটি-ইউজার হিসেবে আপনি যে ফ্রি -তে যে কোন সফটওয়্যার পেতে আগ্রহী হবেন এতে কোনরকম সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি পরিশ্রম করে কিছু উৎপাদন (আবিস্কার) করছেন, তিনি তার শ্রমের, মেধার মূল্য চাইলে তাকে বেনিয়া বলে আখ্যায়িত করাটা কতটা ন্যায্য? যত যাই বলেন, মূলে কিন্তু অর্থই। আপনার (আইটি ইউজার) গাঁটের পয়সা বাঁচানোর জন্যই আপনি উচ্চবাচ্য করবেন এবং অন্যজনও (আইটি ডেভেলপার/ব্যবসায়ী) গাঁটে পয়সা ভরার জন্যই ব্যতিব্যস্ত থাকবেন। বাংলাভাষার প্রসারে অথবা যে কোন ক্ষেত্রেই একটি ফ্রি-ওয়্যার সফটওয়্যার নিঃসন্দেহে শুভ উদ্যোগ। কিন্তু সব কিছু তো ফ্রি তে দেয়া যায় না। তাহলে কী ধরনের এপ্লিকেশন ফ্রি-তে দেয়া যায়? অথবা কী ধরনের এপ্লিকেশনে কত মূল্য ধার্য হওয়া উচিৎ? অথবা সাধারণত মূল্য ধার্য থাকলেও ব্যবহারের ক্ষেত্র বুঝে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে কেবল ফ্রিতে দেয়া যায় কিনা? যেমন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি।
৪. ওপেন সোর্স যখন প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা সহায়ক
প্রযুক্তিগত গবেষণাকে এগিয়ে নিতে ওপেন সোর্স কার্যকরী পদক্ষেপ। বিজয় এবং অভ্র দুটোই কিন্তু ক্লোজড-সোর্স। মোস্তফা জব্বার যে বিজয়কে ওপেন সোর্স করবেন না তা নিশ্চিত, তবে হালের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বারবার শোনা যাচ্ছে যে অভ্র শীঘ্রই ওপেন সোর্স হতে যাচ্ছে। এটা ভবিষ্যৎ ডেভেলপারদের জন্য সহায়ক হবে । এবং এতে পরিশেষে আইটি ইউজাররা লাভবান হবে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব আবিস্কারগুলোকে ওপেন সোর্স রাখতে আমরা কতটা আগ্রহী ? কোন ধরনের সফটওয়্যারগুলো ওপেন সোর্স হয় ও হওয়া উচিৎ? বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলোর কত ভাগ জনপ্রিয়, ব্যবহার বান্ধব, মানসম্মত?
৫. কী-বোর্ড লে-আউটের ক্ষেত্রে কী কী মনে রাখা জরুরী
Dvorak কী-বোর্ডের জনক August Dvorak একজন শিক্ষাবিদ ও মনস্তাত্তিক ছিলেন। তিনি QWERTY কী-বোর্ডের বেশ কিছু অসুবিধা নির্ণয় করেন। যেমন- QWERTY কী-বোর্ডে ৩০% লেখা টাইপ করতে হয় নীচের সারিতে, যা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর এবং এতে টাইপিং গতি ধীর হয়ে যায়। ৫২% কী-স্ট্রোকগুলো উপরের সারিতে থাকায় আঙ্গুলকে উপরের দিকে চালনা করতে দূরত্ব পার করতে হয়।বেশীর ভাগ টাইপিং বাম হাত নির্ভর, যেখানে অনেকেই খানিকটা দূর্বল হয়ে থাকে। এগুলো লক্ষ্য করে জনাব Dvorak তার কী-বোর্ডের যে লে-আউট করেন তাতে ৭০% কী-স্ট্রোকগুলো হোম-সারিতে রাখেন। এতে সর্বোচ্চ টাইপিং গতি পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত অক্ষরগুলোকে নীচের সারিতে রাখা হয়। ডান হাতকে বেশী গতিশীল রাখা হয়। ইংরেজী বর্ণমালা আমাদের বাংলার চেয়ে সরল। তারপরও যদি ইংরেজী কী-বোর্ড নিয়ে এতো গবেষণা হয়ে থাকে, তো আমাদের স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জণবর্ণ, যুক্তাক্ষর, এবং ’কার’ নিয়ে কী পরিমাণ গবেষণা করা দরকার এবার বুঝুন। এবং এখন পর্যন্ত যতগুলো কী-বোর্ড এসেছে, তা কতটা চাহিদা মোতাবেক তা ভাবুন।
৬. বর্তমানে প্রচলিত কী-বোর্ডগুলোর সুবিধা-অসুবিধা কী কী
অসুবিধা নিয়ে অবগত না হলে পরবর্তী বিকাশ ঘটেনা। তাই এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত, প্রচলিত, কম জনপ্রিয় এবং অধিক জনপ্রিয় কী-বোর্ডে যে লে-আউট অনুসরণ করা হয়, এর বাইরে আর কত রকম করে কী-বোর্ডে বাংলা বর্ণমালাকে সাজানো যায় যা বাংলা টাইপিং গতিকে আরো তরান্বিত, আরো সহজায়িত করবে। আব্দুস সাত্তার, মুক্তাদির খান পাঠান, আমীর আলী’র DEVELOPMENT OF AN OPTIMAL BANGLA KEYBOARD LAYOUT BASED ON CHARACTER AND FINGERING FREQUENCY নামক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, আমাদের বাংলা কী-বোর্ডের অনেক লে-আউটই ব্যবহারকারীর টাইপিং গতি এবং একেকটি অক্ষরের ফ্রিকোয়েন্সি বুঝে নকশাকৃত নয়। বেশী ফ্রিকোয়েন্সির ক্যারাক্টারকে কম ফিক্রোয়েন্সির ক্যারেক্টারের জায়গায় বসানো হয়েছে। এতে ইউজাররের টাইপিং গতি ও সাচ্ছন্দ্য যথেষ্টই হ্রাস পায়। তাদের টিমের একটি জরিপে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে জানা যায়- Shift + Char ইউজারকে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ দেয়না টাইপিংয়ে।
৭. ফোনেটিক কী-বোর্ড কতটা গুরুত্বপূর্ণ
"amar" লিখলে যখন ’আমার’ হয়, এর চেয়ে সোজা আর কি হতে পারে বাংলা টাইপিংয়ের বেলায়! ফোনেটিক কী-বোর্ড দিয়ে বাংলা টাইপ করার ভয় কাটিয়ে উঠেছেন অসংখ্য ইউজার। কিন্তু ফোনেটিকে কী আর কোন পরিবর্তন আনা যেতে পারে? ফোনেটিক শিক্ষানবিশ পর্যায়ে স্বাগত হতে পারে কিন্তু পরিণত ক্ষেত্রে একে কি গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়? অথবা ফোনেটিক নির্ভরশীলতা কি আমাদের সম্ভাব্য হরেকরকম বাংলা কী-বোর্ড লে-আউট গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করেনা?
মোস্তফা জব্বার যখন মৌচাকে ঢিল মেরেই বসলেন, সে সুযোগে আমরা মধুচাকের গড়ন দেখতে পারতাম, মধুচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ কিভাবে হয় তা জানতে পারতাম, মধু চেখেও দেখতে পারতাম। কিন্তু মৌমাছিরা তাকে কামড়ালো কিনা এটা দেখতেই আমরা উৎসুক ছিলাম বেশী। বিজয়কে অচ্ছুৎ করে দিতে আমরা মনপ্রাণ সঁপে একরকম অভ্রের প্রচারণায় নেমে গেলাম। অথচ এ কাজটি আমাদের (আইটি ইউজারদের) নয় একেবারেই। ভোক্তা এভাবে পণ্যের ক্যাম্পেইন করেনা, এ কাজটি শেষ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদনকারীরই।
ফলে যে গল্পটা দূর্দান্ত সাই-ফাই হতে পারতো, তা শেষ পর্যন্ত সাধারণ একটা রূপকথা হয়ে গেল...!!!