
প্রিয় বন্ধু শাহেদ মারা যাওয়ার এক মাসের মাথায় ফোনটা এলো। ঢাকায় এবার তীব্র শীত পড়েছে। আমি লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। নায়লা গেছে তার বাপের বাড়ি। সাথে নিয়ে গেছে নিশিকে। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার তার যাওয়া চাই। পুরো ফ্ল্যাটটা খালি। মাত্র ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম, এমন সময় সেলফোনটা বেজে উঠলো। ধুর, এতো রাতে আবার কে!
“হ্যালো?”
“হ্যালো, সুমন?”
“কে?”
“আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি শাহেদ।”
সেলফোনটা যেন আমার হাতে জমে গেল।
“শাহেদ এক মাস আগে মারা গেছে,” কোনমতে বললাম।
“এক মাস না ... ঠিক বলতে কী একমাস দুই দিন এগার ঘন্টা তেইশ মিনিট আগে।”
“আপনি কে বলছেন?” রাগ চেপে জিজ্ঞেস করলাম।”
হাসির শব্দ শোনা গেল অপরপ্রান্তে। অতি পরিচিত এই হাসি অনেকবার শুনেছি।
“ঐ শালা, তুই আমার কোন কালের ফ্রেন্ড। আমাকে চিনিস নাই?”
“এতো রাতে কে ভাই মশকরা করেন?”
“না দোস্ত, মশকরা করি না। তুই ওখানে, বেঁচে আর আমি এখানে, মরা। একটা কথা বলি, আমি সত্যি খুব খুশি কাজটা করেছিলাম বলে।”
“কী করেছেন !”
“নিজেই নিজেকে মেরেছি বলে। যেমনটা ভেবেছিলাম ... মৃত্যু ঠিক তাই। কোমল, শান্ত একটা ব্যাপার, কোন চাপ-টাপ নাই।”
“শাহেদ গাড়ি এ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। আরিচা রোডে একটা কালভার্টের রেলিং ভেঙ্গে গাড়িটা নিচে পড়ে গিয়েছিল ... সাথে সাথে মৃত্যু।”
“আমি ইচ্ছা করেই রেলিং এ ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমি তখন ১২০ স্পীডে ছিলাম। ঐটা কোন এ্যাক্সিডেন্ট ছিল না দোস্ত”, শীতল কণ্ঠটা বলে চললো, “আমি মরতে চেয়েছিলাম, শিওর।”
এবার আমি হেসে উঠলাম, “আপনি কে ভাই জানি না, তবে মরা মানুষতো ফোন করে না।”
“সত্যি কথা। আক্ষরিক অর্থে আমিও ফোন ইউজ করছি না। এটা বলতে পারিস যে তোর সাথে কথা বলার জন্যই সেল ফোনটা মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছি ... টেলিপ্যাথিক শক্তি ব্যবহার করে, যা সব আত্মাদের থাকে। আমি তোর বাসার কাছের মোবাইল ফোন টাওয়ারটার ভাইব্রেশনের সাথে আমার কসমিক ভাইব্রেশনটা ম্যাচ করিয়ে দিয়েছি, ব্যাস ... খুব সহজ, সত্যি!”
“সত্যি?” সরু গলায় ভেংচি কাটলাম।
“তোর মন সন্দেহে ভরা আমি জানি। এখন যা বলি মন দিয়ে শোন ব্যাটা।”
আমি শুনতে থাকলাম ফোনের ওপাশের ফিসফিসে ঠান্ডা কণ্ঠ। গত পঁচিশ বছরে ঘটে যাওয়া অতি ব্যক্তিগত সব ঘটনা, যা কিনা শুধু আমি আর শাহেদই জানি। শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই শোয়া থেকে উঠে বসেছি। লেপ খসে পড়েছে কোমরের কাছে। তীব্র ঠান্ডা, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না। এক সময় থামলো ও।
আমি ততক্ষণে নিশ্চিত, এ শাহেদ ছাড়া আর কেউ না ... কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। কিন্তু নড়তে পারছি না। শরীরের পেশি যেন জমে গেছে। চেষ্টা করছি অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা হজম করতে।
“ঠিক আছে, আমি ভূত-টুত বিশ্বাস করি না যদিও কিন্তু ... এ ব্যাপারটা মানতেই হচ্ছে।”
“আমি এতেই খুশি সুমন দোস্ত। তোর সাথে কথা বলাটাই আসল,” দীর্ঘ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল ও, “আমি জানি তোর সময়টা এখন কত খারাপ যাচ্ছে!”
“মানে কী?”
“আমি ভালো করেই জানি তোর সমস্যাগুলো। আমি তোকে হেল্প করতে চাই।”
“উমম, হ্যাঁ ... মানে ...!”
“গত কয়েকদিন ধরেই তোর মন ভালো নেই, ঠিক?”
“হুমম, অল্প-সল্প।”
“তোর দোষ নেই। কারণ আছে মন খারাপের, বেশ জোরালো কারণ। বিশেষ করে বকেয়া টাকা-পয়সার বিষয়টা।”
“আগামী সপ্তাহেই সব বিল পাওয়ার কথা, তমা প্লাস্টিকের সিরাজ সাহেব দিবে বলেছিল।”
“তুই ঐটা কোনদিনই পাবি না। সে তোর কাছে মিথ্যা বলেছে। র’ম্যাটেরিয়ালের জন্য সে অন্য কোম্পানীর খোঁজ করছে। তোর কাছ থেকে আর নিবে না, বকেয়া বিলও দিবে না।”
“তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ! বিল না পেলে ব্যাংকের লোন ফেরত দিব কীভাবে?”
“তারপর দেখ তোর বউ নায়লা, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া করে। এটা একটা লক্ষণ, তোর বিয়েটা টিকবে না। ও শিঘ্রি ডিভোর্স চাইবে তোর কাছে। তাছাড়া ও আরেক জনের সাথে প্রেম করছে।”
“ হারামজাদাটা কে?” রাগে কেঁপে উঠলাম।
“চিনবি না। আর চিনলেও লাভ নাই। ওরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।”
“গত কয়েকমাস ধরেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারি নাই। আমার ধারণাই ছিল না ...।”
“তোর মেয়ে নিশি ... আবার ধরেছে। এইবার আরো খারাপ পর্যায়ে আছে ও।”
আমি জানি ও কী বোঝাতে চাচ্ছে। শিঁড়দাড়া বেয়ে একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল। নিশি আমার একমাত্র মেয়ে, মাত্র ১৭ বছর বয়স। গত ৩ বছর ধরে মাদকের কবলে পড়ে যা তা অবস্থা। টিনএজ হলে যা হয়, আবেগপ্রবণ, খেয়ালি।
আমি তখন মাত্র চাকরী ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকেছি। প্লাস্টিক শিল্পে লাগে এ রকম কেমিকেলের দুইটা বিদেশি কোম্পানীর সোল এজেন্ট হয়েছি মাত্র। অল্প দিনেই জমিয়ে ফেললাম। টাকা বানানোর নেশায় সব ভুলে গেলাম, এমনকি একমাত্র মেয়েকেও। ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়েই মনে করলাম দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ও যে অসৎ সংগে পড়ে মাদকের নীল বিষে আক্রান্ত, বুঝলাম অনেক পরে। দ্রুত ওকে একটা নামকরা ক্লিনিকে ভর্তি করালাম। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ায় ওর মাদকাসক্তি সেরে গিয়েছিল অল্প দিনেই। ওহহ আল্লাহ, আবার ঐ নরকে ও ঢুকেছে?
“ নিশি সম্মন্ধে কী জানিস তুই?” প্রায় চিৎকার করলাম। আমার সম্বোধনের পরিবর্তন খেয়াল করলাম না।
“এবার অবস্থা আরো খারাপ। তাছাড়া তোকে ঘৃণা করে, সবকিছুর জন্য তোকেই দায়ী করে।”
“কী! হ্যাঁ, স্বীকার করছি একসময় ওকে কোন সময় দিতে পারি নাই। ঐটা ছাড়া ওর জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।”
“না যথেষ্ট করিস নাই। তুইও জানিস, আমিও জানি। ওকে তুই হারিয়েছিস।”
রুমের অন্ধকার যেন চেপে বসলো আমার উপর।
শাহেদ বললো, “শোন, যত দিন যাবে, অবস্থা ততো খারাপ হবে। যখন বেঁচে ছিলাম তখন আমিও এই নরকের মধ্যে দিয়া গিয়েছিলাম।”
“সব ছেড়েছুড়ে আমি গ্রামে চলে যাব। অনেক জমি আছে আমাদের। খামার বানাবো, পুরোদস্তুর চাষী হয়ে যাব।”
“ঐখানে তোর এক চাচা আছে না? অলরেডি সে সব জমি নিজের নামে করে নিয়েছে। তুই গেলে তোরে থাকতে দিবে ভাবছিস? চিন্তা করে দেখ তোর চাচা কবে শেষ তোর খোঁজ নিয়েছে ...।”
শাহেদ একঘেয়ে গলায় বলতে থাকলো মধ্য বয়সের সংকটের কথা। এ বয়সে নতুন করে কিছু করা সম্ভব না, তাছাড়া অসুখ-বিসুখ, একাকিত্ব, বিষন্নতা ... আমার হয়ে গেল। মনের যেটুকু প্রতিরোধ ছিল সব ভেসে গেল। হতাশায় নুয়ে পড়লাম আমি।
“মাত্র একটাই উপায় আছে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, দেখিস। তোর বেডরুমে স্টীলের আলমারিটার উপরের ড্রয়ারে যে পিস্তলটা আছে ঐটা বের কর। কেনার পর তো কোনদিন ব্যবহার করিস নাই। মনে আছে কতো দৌড়াদৌড়ি করে আমার এক বন্ধু, পুলিশের এক বড় অফিসার, লাইসেন্সটা বের করে দিল? ঐটা এবার তুই ইউজ করবি ... প্রথম ও শেষ বারের মতো।” হালকা হাসির আওয়াজ পেলাম।
“ আ-আমি পারবো না।”
“কেন পারবি না? তোর হাতে আর কোন উপায় আছে? নেই, নেই ... নেই ! যা আলমারিটা খুল, পিস্তলটা বের কর। লোড করাই আছে। আমি তোর বাসার নিচে আছি। আবার আমরা একসাথে আড্ডা দিবো। ঠিক পুরনো দিনের মতো। বিশ্বাস কর দোস্ত, মৃত্যু অ™ভুত সুন্দর ... অদ্ভুত ! বেঁচে থাকাটাই বরং কুৎসিত একটা ব্যাপার। পিস্তলটা বের করেছিস? বের কর, বের কর ... বের কর ... বের কর। বেশ, এবার নলটা মুখে পুরে ট্রিগারটা টিপে দে ...।”
একমাস হলো আমি মারা গেছি। শাহেদ ঠিকই বলেছিল। এখানে অনেক আরাম ... কোন চাপ নেই, দুর্ভাবনা নেই। শান্ত, সুন্দর ... আহ্।
এই যে পাঠক, আপনাকে বলছি, জী আপনাকেই! আমি জানি এখন কী কঠিন সময় আপনি পার করছেন। কতো সমস্যা - আয় ও ব্যয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক, ট্রাফিক জ্যাম, চাকুরীর ঝামেলা, ছিনতাই ... কতো কী! বিবাহিত হলে তো আরো কঠিন ... বউয়ের মুখ ঝামটা, এটা নাই ওটা নাই, ছেলে-মেয়ে নিয়ে অশান্তি। আরো তিক্ত সত্য হলো, এ অবস্থার কোন উন্নতি হবে না।
দেখুন তো আপনার ফোনটা বেজে উঠলো কিনা? কলটা ধরুন ... আমাদের কথা হওয়া দরকার !
--------------------------------------------------------------
William F. Nolan ছোটগল্প Dead Call এর ছায়া অবলম্বনে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:০১