বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার মানুষ গৌরবময় অবদান রেখে ইতিহাসের একটি সম্মানজনক পৃষ্ঠা দখল করে রেখেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর জেলা থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাধিনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গাবাসীর মুক্তিচেতনা ও দেশপ্রেমের স্বীকৃতি হিসেবেঃ
* চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হয় ( ১০ই এপ্রিল হতে ১৭ই এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত)
* বাংলাদেশ টেলিফোনের জন্ম হয় চুয়াডাঙ্গায়।
*রেডক্রস বাংলাদেশের জন্ম হয় চুয়াডাঙ্গায়।
*পাকিস্তানিরা প্রথম নাপাম বোমা ফেলে চুয়াডাঙ্গায়।
*যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মহকুমা শহর চুয়াডাঙ্গা।
*কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করার কৃতিত্ত্ব চুয়াডাঙ্গাবাসীর।
*অন্যান্য মহকুমা শহর মুক্ত হবার পূর্বেই চুয়াডাঙ্গা মুক্ত হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পরই সক্রিয় হয়ে ওঠে চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসী। ৮ই মার্চ থেকেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গৃহশীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন, শহরে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠন, সরকারি ও আধা সরকারি অফিস আদালত বন্ধ, অভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ, সামরিক বাহিনির সাথে যেকোন ধরনের যোগাযোগ ব্যাবস্থায় অসহযোগ, সবরকম কর প্রদান স্থগিত, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠানো বন্ধ, প্রভৃতি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য চুয়াডাঙ্গার মানুষ প্রানপন চেষ্টা অব্যহত রাখে। ফলে আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, জীবননগর সহ সব ইউনিয়ন ও বাজারে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ৮ই মার্চ চুয়াডাঙ্গা শহরে লাঠি মিছিল বের হয়। বন্দুক সহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র নিয়েও স্থানীয়রা মিছিলে যোগ দেয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ আহবানের পর পরই চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সামনের বাগানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনির উদ্যোগে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই কাজে ওবায়দুল হক জোয়ার্দারকে সহযোগীতা করেন আলমডাঙ্গার কাজী কামাল। এছাড়া আলমডাঙ্গায় স্টেশন পাড়ায় আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে একদল যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি নিয়ে যুবকেরা প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। চুয়াডাঙ্গায় অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসক থাকায় এ কাজটি অতিগোপনে করতে হয়। যদিও ৭ই মার্চের ভাষনের পর কার্যত সংগ্রাম কমিটির নির্দেশেই প্রসাশনিক কর্মকান্ড সংঘটিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে মহকুমা প্রশাসক ইকবাল বাহার চৌধুরী সংগ্রাম কমিটির কাজের হুমকি হয়ে দাড়ালে তাকে বন্দী করে তার স্থলে সার্কেল অফিসার হাবিবুর রসুলকে সংগ্রাম কমিটি মনোনীত মহকুমা প্রশাসক করা হয়।
২৩শে মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের প্রতিরক্ষা বাহিনির কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গানের সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ঢাকার সকল দূতাবাসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ওইদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা চুয়াডাঙ্গা চৌরাস্তার মোড়ে (বর্তমান শহীদ হাসান চত্ত্বর) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর অনেক পূর্ব থেকেই চুয়াডাঙ্গার দু এক স্থান ছাড়া সর্বত্র পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে কালো পতাকা ওড়ানো হচ্ছিলো। ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষনার তারবার্তাটি পৌছায় এখানকার আওয়ামীলীগ সম্পাদক সংসদ সদস্য ইউনিস আলি এডভোকেটের হাতে।
২৫শে মার্চ রাত্রে পাকবাহিনি অতর্কিতে ঢাকার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ব্যাপক গনহত্যা শুরু করে। পাক সেনারা ঐ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে করাচীতে পাঠিয়ে দেয়। ঢাকায় পাকবাহিনি বাঙ্গালীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে এবং ব্যাপক গনহত্যা শুরু করেছে, টেলিফোনে রাতেই এ সংবাদ পেয়ে চুয়াডাঙ্গাস্থ ইপিআর ক্যাম্পে বাঙ্গালীদের মধ্যে উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়। ক্যাম্পের অধিনায়ক তখন কুষ্টিয়াতে। ক্যাম্পের দুজন সহকারী উইং কমান্ডারের মধ্যে অবাঙ্গালী একজন ও বাঙ্গালী একজন। অবাঙ্গালী সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন সাদেক ২৫শে মার্চ বিকালেই যশোর চলে যান। ফলে ক্যাম্পে তখন নির্দেশ দেবার মতো অফিসার আছেন বাঙ্গালী সহকারী উইং কমান্ডার এ আর আজম চৌধুরী।
এই পরিস্থিতিতে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নির্দেশের জন্য আজম চৌধুরী অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু, ক্যাম্পের হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান কোন অফিসারের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই উইং হেডকোয়ার্টারের সকল অবাঙ্গালী সেনাদের কৌশলে আটক করেন এবং অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখেন ও বাঙ্গালী সেনাদের সশস্ত্র অবস্থায় প্রস্তুত রাখেন। দুপুরে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া থেকে পালিয়ে এসে নেতৃত্ব হাতে নেন। তিনি হাবিলদার মেজর মজিবর রহমানের নেয়া পদক্ষেপের প্রসংশা করেন। মেজর ওসমান দুপুরেই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এসোসিয়েশন হলে (বর্তমান শহীদ আলাউল হক) মহকুমা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী ঘোষনা দিয়ে পাকবাহিনির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে “দক্ষিন পশ্চিম কমান্ড কাউন্সিল” গঠন করেন এবং নিজে কমান্ডারের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। সংসদ সদস্য ডাঃ আসহাব-উল হক এই কমান্ড কাউন্সিলের প্রধান উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার বাদল রশীদ ও সংসদ সদস্য ইউনুস আলী এডভোকেট উপ প্রধান উপদেষ্টা হন।
লেখক পরিচিতিঃ ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী।
সূত্র: আন্দোলন সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গা
এক মুঠো রোদ্দুর প্রকাশনা সংস্থা।